অ্যাডভোকেট সিরাজ প্রামাণিক : একটি সংবাদ পড়ে মন ভাল হয়ে গেলো। বিচার বিভাগ স্বাধীনতার সুখ আস্বাদন করছেন। বিচার বিভাগ প্রজাতন্ত্রের হৃৎপিণ্ড তা স্মরণ করিয়ে দিতে এ আদেশটি মাইলফলক হয়ে থাকবে।
রাজবাড়ী আদালতের একজন সিনিয়র জুডিসিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট নির্বাহী প্রকৌশলী, গণপূর্ত অধিদপ্তর, রাজবাড়ীকে সাতদিনের সশ্রম কারাদন্ডে দন্ডিত হওয়ার আদেশ দিয়েছেন।
ঘটনার বিবরণে জানা যায়, গত ১১ আগস্ট’২০২৪ ইং তারিখে জনৈক দেলু মিয়া বাদী হয়ে ঝন্টু খন্দকারসহ মোট ২১ জন এবং অজ্ঞাতনামা ১৫/২০ জনের বিরুদ্ধে ‘আইন শৃঙ্খলা বিঘ্নকারী অপরাধ (দ্রুত বিচার) আইন, ২০০২ এর ৪ ও ৫ ধারায় একটি নালিশী দরখাস্ত দাখিল করেন। বিচারক মহোদয় নালিশী দরখাস্তের সত্যতা যাচাইয়ের জন্য ঘটনার বিষয় তদন্ত করে ২৫ আগস্ট’২০২৪ ইং তারিখের মধ্যে প্রতিবেদন দাখিলের জন্য নির্বাহী প্রকৌশলী গণপূর্ত বিভাগ, রাজবাড়ীকে নির্দেশ প্রদান করেন।
আমাদের ফৌজদারী কার্যবিধি’র ২০২ (১) ধারায় স্পষ্ট বলা আছে যে, কোন ম্যাজিস্ট্রেট যে অপরাধ আমলে নেওয়ার জন্য ক্ষমতাসম্পন্ন, সে অপরাধের অভিযোগ পাওয়ার পর অভিযোগের সত্য—মিথ্যা নিরূপণের উদ্দেশ্যে তিনি যাকে উপযুক্ত বলে মনে করেন এরূপ কোন ব্যক্তিকে এই বিষয়ে অনুসন্ধান বা তদন্ত করার নির্দেশ দিতে পারেন।
আইনের এ ক্ষমতা বলে বিচারক মহোদয় যথারীতি এ আদেশ প্রদানের ৩টি ধার্য্য তারিখ অতিক্রান্ত হওয়া সত্ত্বেও প্রতিবেদন দাখিল না করে বরং তিনি বিচারকের এ আদেশে নাখোশ হয়ে নানা মন্তব্য করতে থাকেন।
পরবর্তীতে বিচারক মহোদয় ৩ অক্টোবর ২০২৪ ইং তারিখে প্রতিবেদন দাখিলের জন্য পুনরায় নির্দেশ প্রদান করে আদেশের অনুলিপি নির্বাহী প্রকৌশলী, গণপূর্ত বিভাগ রাজবাড়ীকে প্রদান করেন।
অতঃপর নির্বাহী প্রকৌশলী অত্যন্ত ঔদ্ধত্যপূর্ণ আচরণ দেখিয়ে নিজে তদন্ত কার্য সম্পন্ন না করে তার অধীনস্থ দুজন উপ—সহকারী প্রকৌশলী স্বাক্ষরিত প্রতিবেদন আদালতে দাখিল করেন। যা আদালতের নির্দেশের সুস্পষ্ট লঙ্ঘন।
শুধু এখানেই শেষ নয়। তিনি উক্ত তদন্ত প্রতিবেদন প্রেরণ সংক্রান্ত ফরোয়ার্ডিং এ উল্লেখ করেছেন যে, ‘জঁষব ড়ভ ইঁংরহবংং’ মোতাবেক গণপূর্ত অধিদপ্তর রাষ্ট্রীয় স্থাপনা নির্মাণ, মেরামত, রক্ষণাবেক্ষণের কাজে নিয়োজিত। কাজেই এমন আদেশ প্রদানের পূর্বে যথাযথ ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তার সাথে পরামর্শ করতঃ সিদ্ধান্ত গ্রহণ প্রয়োজন বলে তিনি মনে করেন।
ফরোয়ার্ডিং এ এমন শব্দচয়ন স্বাধীন বিচার বিভাগের হস্তক্ষেপের শামিল উল্লেখ করে বিচারক মহোদয় ওই নির্বাহী প্রকৌশলীর বিরুদ্ধে কেন উপযুক্ত আইনানুগ ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে না সে বিষয়ে ২০ নভেম্বর’ ২০২৪, সকাল ১১.০০ ঘটিকায় অত্র আদালতে হাজির হয়ে লিখিত ব্যাখ্যা প্রদানের আদেশ প্রদান করেন।
প্রকৌশলী মহোদয় আদেশটি যথাসময় প্রাপ্ত হলে আদারতের আদেশের প্রতি ভ্রম্নক্ষেপও করলেন না। তিনি আদালতে হাজিরও হলো না, কোনো লিখিত ব্যাখাও দিলেন না। এমনকি তিনি আদালতের এ আদেশকে একটি ‘পত্র’ উল্লেখ করে জেলার একজন গুরুত্বপূর্ণ দপ্তর প্রধান ও একই সাথে কোর অফিসার এর সহিত এমন আচরণ অশোভন, অমূলক আচরণ এবং একজন বিচারকের কাছ থেকে এমন আচরণ তিনি কামনা করেন না বলে উল্লেখ করে একখানা চিঠি পাঠান, যার অনুলিপি বিভিন্ন দপ্তরেও প্রেরণ করেন।
এমতাবস্থায় বিচারক মহোদয় আদালতের আদেশের সুস্পষ্ট লঙ্ঘন এবং আদালতের স্বাধীন বিচারিক কার্যক্রমের হস্তক্ষেপের কারণে এবং আদালতের নির্দেশ মোতাবেক প্রকৌশলী মহোদয় আদালতে হাজির হয়ে ব্যাখ্যা প্রদান না করা এবং তার কর্তৃক প্রেরিত পত্রের ভাষায় আদালতের প্রতি অবজ্ঞা, অশ্রদ্ধা এবং ঔদ্ধত্যপূর্ণ আচরণ প্রকাশ পাওয়ায় এবং আদালতের নির্দেশ মোতাবেক ঘটনার তদন্ত না করে তার অধীনস্থ কর্মকর্তাদের দিয়ে দায়সারা তদন্ত করিয়ে রিপোর্ট দাখিল করিয়ে বিচারপ্রার্থীকে হয়রানি এবং ন্যায় বিচার পেতে অন্তরায় সৃষ্টি করায় উক্ত তদন্তকারী কর্মকর্তা প্রকৌশলীকে ফৌজদারী কার্যবিধির ৪৮৫ ধারার অধীনে শাস্তি প্রদান করার পর্যপ্ত কারণ বিদ্যমান থাকায় অভিযুক্ত এ.এম ইফতেখার মজিদ, নির্বাহী প্রকৌশলী, গণপূর্ত, রাজবাড়ী’কে ০৭ (সাত) দিনের বিনাশ্রম কারাদন্ডে দন্ডিত করেন।
পাঠক, নিশ্চয়ই আপনাদের মনে আছে পুলিশপ্রধান শাহাদুল হকের চাকরিচ্যুতির গল্পের কথা। সেই ২০০৩ সালের ১৯ জুন। আইজি তার জবাবে বিচার বিভাগ ও সুপ্রিম কোর্ট নিয়ে বিভিন্ন আকার—ইঙ্গিতে কটূক্তি করেন। জবাবের কপি আমলে নিয়ে বিচারপতি মো. আবদুল মতিন এবং বিচারপতি সৈয়দ রিফাত আহম্মেদ স্বপ্রণোদিতভাবে আইজিপির বিরুদ্ধে আদালত অবমাননার রুল ইস্যু করেন। একই সঙ্গে আইজিপিকে স্বশরীরে আদালতে উপস্থিত হওয়ার নির্দেশ দেন। আইজিপি সশরীরে উপস্থিত হয়েছিলেন। হাইকোর্ট ডিভিশন আইজিপিসহ চারজন পুলিশ অফিসারের জবাবে সন্তুষ্ট না হওয়ায় তাদের বিভিন্ন মেয়াদে সাজা ও জরিমানা প্রদান করেন।
হাইকোর্ট ডিভিশনের আদেশের পরে দেশের বিশিষ্ট আইনজ্ঞরা অভিমত দেন, দ্য পাবলিক সার্ভেন্ট অর্ডিন্যান্স, ১৯৮৫ অনুযায়ী পুলিশ প্রধানের চাকরিতে থাকার সুযোগ নেই। রায় প্রদানের সময় আইজিপি ফ্রান্সে ইন্টারপোলের সদর দপ্তরে ছিলেন একটা আন্তর্জাতিক সম্মেলনে। সে যখন দেশে আসেন সে সময় তাকে বিমানবন্দরে পুলিশ প্রধান হিসেবে প্রোটোকল দেওয়া হয়নি। তাকে সাময়িক পদ থেকে সরিয়ে দিয়ে ডিএমপির কমিশনারকে চার্জে রাখা হয়। পরে সাসপেন্ড করা হয়। হাইকোর্ট ডিভিশন এ রায়ে জুডিশিয়ারির মর্যাদা ও অবস্থান সম্পর্কে গুরুত্বপূর্ণ কিছু অবজারভেশন প্রদান করেন। পরে কলেবরে পাঠকের জ্ঞাতার্থে ওই পর্যবেক্ষণগুলো ব্যাখ্যা করা হবে।
হাইকোর্ট ডিভিশন সুস্পষ্টভাবে বলে, সংবিধানের ১১২ অনুচ্ছেদ অনুযায়ী পুলিশসহ নির্বাহী বিভাগ আদালতকে সহায়তা করতে বাধ্য। তা ছাড়া আদালত বলতে শুধু গম্বুজাকৃতির বিল্ডিংকেই বোঝাবে না, বরং ফৌজদারি কার্যবিধির ২৫ ধারা অনুয়ায়ী সুপ্রিম কোর্টের বিচারপতির এখতিয়ার সমগ্র বাংলাদেশ। সমগ্র বাংলাদেশেই এখতিয়ার প্রয়োগের ক্ষমতা রয়েছে। এ রায়ের বিরুদ্ধে আপিল বিভাগে যায় পুলিশ প্রধানসহ বিবাদীপক্ষ। আপিল বিভাগ হাইকোর্টের রায়ে হস্তক্ষেপের কোন যুক্তি না থাকায় আপিল খারিজ করে দেয়।
ফৌজদারি কার্যবিধি ১৮৯৮—এর ২৫ ধারায় বিধান অনুযায়ী, পদাধিকারবলে সুপ্রিম কোর্টের বিচারকরা সারা বাংলাদেশের জন্য, দায়রা বিচার, চিফ জুডিশিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট, মেট্রোপলিটন ম্যাজিস্ট্রেট নিজ নিজ অধিক্ষেত্রের মধ্যে জাস্টিস অব পিস হিসেবে ক্ষমতা প্রয়োগ করতে পারবেন।
একটি ছোট্ট কেস স্টাডি দিয়েই লেখাটি শেষ করতে চাই। ১৯৪৮—৪৯ সালের ঘটনা। আপনারা নিশ্চয়ই তৎকালীন বিশিষ্ট রাজনীতিক মাওলানা আব্দুর রশিদ তর্কবাগীশ এর নাম শুনে থাকবেন। একজন আদর্শ রাজনীতিক হিসেবে এ উপমহাদেশে তাঁর নাম স্বর্ণাক্ষরে লেখা আছে।
একদা স্থানীয় এমএলএ মাওলানা আব্দুর রশিদ তর্কবাগীশ তার এলাকা পাবনায় গেলে সরকারী প্রকৌশলীর বাসভবনে স্থানীয় সরকারী কর্মকর্তাদের সাথে সৌজন্য সাক্ষাতে বসেন। ধর্মপ্রাণ মাওলানা সাহেব মাগরিবের নামাজ শেষে সবার সাথে চা পানের ফাঁকে ওই বৈঠকে হাজির সাব ডিভিশনাল মুন্সেফ (বর্তমানে সহকারী জজ) কে একটা চলমান দেওয়ানী মামলা খারিজ করে দেয়ার জন্য বলেন।
স্থানীয় এমএলএর এহেন কাজ বিচারকাজে মারাত্মক হস্তক্ষেপ উল্লেখে মুন্সেফ সাহেব মাননীয় জেলা জজের মাধ্যমে ঢাকা হাইকোর্টের রেজিস্ট্রার বরাবর লিখিত অভিযোগ করলেন। এর প্রেক্ষিতে হাইকোর্ট মাওলানা আব্দুর রশিদ তর্কবাগীশ সাহেবের বিরুদ্ধে আদালত অবমাননার রুল ইস্যু করেন।
অভিযুক্ত তার আইনজীবী শেরে বাংলা এ কে ফজলুল হকসহ আদালতে এসে নিঃশর্ত ক্ষমা প্রার্থনা করে নিজেকে আদালতের দয়ার উপর ছেড়ে দেন। শেরে এ বাংলা উপনিবেশ বিরোধী আন্দোলনে মাওলানা আব্দুর রশিদ তর্কবাগীশ এর মহান অবদান আর ধর্মনিষ্ঠ রাজনীতিকের আইনের প্রতি অবিচল শ্রদ্ধার কথা জানিয়ে অভিযুক্তকে অব্যাহতি প্রদানের জন্য নিবেদন করেন।
বিচারপতি ইলিস রীতিরকম মাওলানা আব্দুর রশিদ তর্কবাগীশ এর এরকম দুঃখ প্রকাশকে গ্রহণ না করে যাতে ভবিষ্যতে কেউ আদালতের কাজে হস্তক্ষেপ না করে সে বিবেচনায় মাওলানাকে আদালত অবমাননার দায়ে দোষী সাব্যস্ত করে পাঁচশ রুপি জরিমানা অনাদায়ে সাত দিনের বিনাশ্রম কারাদণ্ডের আদেশ দেন। (১ ডিএলআর ১৭৮ পৃষ্ঠা)।
বিচারকদের প্রতি আকুল আবেদন, বুকে সাহস নিয়ে এরকম সাজা দিয়ে দৃষ্টান্ত স্থাপন করুন। সাধারণ মানুষদের মধ্যে বিচার বিভাগের পুনরায় আস্থা ফিরিয়ে আনুন।
লেখক: বাংলাদেশ সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবী, আইনগ্রন্থপ্রণেতা ও সম্পাদক—প্রকাশক ‘দৈনিক ইন্টারন্যাশনাল’। ই-মেইল: seraj.pramanik@gmail.com