৭০ অনুচ্ছেদ যে কারণে সংস্কার করা উচিত
মোঃ ইব্রাহীম খলিলুল্লাহ্

৭০ অনুচ্ছেদ যে কারণে সংস্কার করা উচিত

মোঃ ইব্রাহীম খলিলুল্লাহ্: সংবিধান একটি দেশের মূল চালিকা শক্তি। আমেরিকার ১৬ তম প্রেসিডেন্ট আব্রাহাম লিঙ্কন এর মতে, “সংবিধান হলো স্বাধীনতার একমাত্র রক্ষাকবচ।” আবার, বলা হয়ে থাকে সংবিধান হলো মানুষের আশা-আকাঙ্ক্ষার প্রতিফলন। ১৯৭১ সালের মহান মুক্তিযুদ্ধের পর জনসাধারণের ঠিক এই আশা-আকাঙ্ক্ষার প্রতিফলন ঘটানোর উদ্দেশ্যেই গঠণ করা হয় গণপরিষদ এবং সংবিধান রচনা কমিটি। গণতন্ত্র, বৈষম্যহীনতা ও অসাম্প্রদায়িকতাকে কেন্দ্র করে রচনা করা শুরু হয় বাংলাদেশের সংবিধান। এমনকি সংবিধানের প্রস্তাবনাতেও গণতন্ত্র, সামাজিক সাম্য ইত্যাদিকে বিশেষভাবে স্বীকৃতি দেওয়া হয়।
তবে, যেই মূলনীতিকে কেন্দ্র করে গঠণ করা হয় গণপরিষদ, জনগণের যেই  আশা-আকাঙ্ক্ষাকে বাস্তব রূপ দিতে রচনা করা হয় সংবিধান, সেই মহান উদ্দেশ্য পূরণে সংবিধান আদৌ কি সমর্থ হয়েছে? মনে প্রশ্ন জাগে, যেই গণতন্ত্র ও সত্যিকার অর্থেই জনগণের শাসন প্রতিষ্ঠার লক্ষে মহান মুক্তিযুদ্ধ সংঘঠিত হয়েছে সেই মহান উদ্দেশ্য তথা গণতন্ত্রের সাথে সংবিধানের ৭০ অনুচ্ছেদ কি পরিপন্থি নয়? চলুন, ৭০ অনুচ্ছেদের বিশদ বিশ্লেষণ এবং যুক্তিযুক্ত আলোচনার মাধ্যমে প্রশ্নগুলোর উত্তর খোজার চেষ্টা করি।
গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশের সংবিধানের অনুচ্ছেদ ৭(১) অনুযায়ী  প্রজাতন্ত্রের সকল ক্ষমতার মালিক জনগণ। অর্থাৎ, বাংলাদেশের সার্বভৌম ক্ষমতা কেবলমাত্র বাংলাদেশের সাধারণ জনগণের। এক লক্ষ সাতচল্লিশ হাজার পাঁচশত সত্তর বর্গকিলোমিটার বিস্তৃত এই দেশটিতে বসবাস করে প্রায় ১৬ কোটি জনতা। এবং এই প্রায় ১৬ কোটি সার্বভৌম ক্ষমতা সম্পন্ন সাধারণ জনগণের সার্বভৌম ক্ষমতা প্রয়োগের জন্য সংবিধানের ৬৫(১) নং অনুচ্ছেদে জাতীয় সংসদ গঠণের বিধান রাখা হয়। তবে কি এই ১৬ কোটি সাধারণ জনগণ তাদের সার্বভৌম ক্ষমতা প্রয়োগে উপস্থিত হবে পার্লামেন্টে এবং রচনা করবে দেশ পরিচালনার জন্য প্রয়োজনীয় আইন! এথেন্স, স্পার্টার মতো নগর-রাষ্ট্রের ক্ষেত্রে বিষয়টি হয়তোবা সম্ভব হলেও বাংলাদেশের মতো বৃহৎ রাষ্ট্রে জনগণের প্রত্যক্ষভাবে সংসদে উপস্থিত হয়ে আইন প্রণয়ন করা সম্ভব নয়।
মূলত এই বিষয়টি মাথায় রেখেই সংবিধানের ৬৫(২) অনুচ্ছেদে বাংলাদেশকে মোট তিনশত নির্বাচনী অঞ্চলে বিভক্ত করা হয় এবং এই তিনশত নির্বাচনী অঞ্চল থেকে মোট তিনশত নির্বাচিত সদস্য বা নির্বাচিত জনপ্রতিনিধি নিয়ে সংসদ গঠনের বিধান রাখা হয়। এই তিনশত নির্বাচিত সদস্যের মৌলিক ও প্রধান দায়িত্ব হলো তাঁরা যেই নির্বাচনী অঞ্চল থেকে জনগণ কর্তৃক নির্বাচিত হয়েছেন সংসদে সেই নির্বাচনী অঞ্চলের প্রতিনিধিত্ব করা তথা সেই নির্বাচনী অঞ্চলের সাধারণ জনগণের আশা-আকাঙ্ক্ষা ইত্যাদি সংসদে উপস্থাপন করা। কিন্তু, দূর্ভাগ্যজনক হলেও সত্য এই যে, সংবিধানের ৭০ অনুচ্ছেদ সাধারণ জনগণের আশা-আকাঙ্ক্ষা ইত্যাদির প্রতিনিধিত্ব করতে নির্বাচিত জনপ্রতিনিধিবৃন্দ তথা সাংসদদের বাধা প্রদান করে।
বাংলাদেশের সংবিধানের অনুচ্ছেদ ৭০(খ) অনুযায়ী, ”কোন নির্বাচনে কোন রাজনৈতিক দলের প্রার্থীরূপে মনোনীত হইয়া কোন ব্যক্তি সংসদ-সদস্য নির্বাচিত হইলে, তিনি যদি সংসদে উক্ত দলের বিপক্ষে ভোটদান করেন, তাহা হইলে সংসদে তাঁহার আসন শূন্য হইবে।” গণতান্ত্রিক সরকার পদ্ধতিতে রাজনৈতিক দলের ভূমিকা অনস্বীকার্য। গণতন্ত্রের অলিখিত নীতি অনুযায়ী সাধারণত রাজনৈতিক দল কর্তৃক মনোনীত এবং নির্বাচিত সংখ্যাগরিষ্ঠ সদস্যের সমর্থনে প্রধানমন্ত্রী নির্বাচিত হয়ে থাকেন। ফলশ্রুতিতে, উল্লিখিত ৭০(খ) অনুচ্ছেদ অনুযায়ী কোনো সাংসদ সংসদে গিয়ে, যদি না স্বতন্ত্র প্রার্থী হয়ে থাকেন, তার দল যেই সিদ্ধান্ত নিয়েছে সেই সিদ্ধান্তে অটল থাকতে বাধ্য থাকবেন।
কেননা রাজনৈতিক দলের ব্যানারে নির্বাচিত হওয়া উক্ত সাংসদ যদি তাঁর নির্বাচনী এলাকার সার্থ রক্ষার জন্য বা রাজনৈতিক দলের কোনো সিদ্ধান্ত তাঁর নির্বাচনী এলাকার সাধারণ জনগণের আশা-আকাঙ্ক্ষার বিপক্ষে গেলে তা নিয়ে উক্ত রাজনৈতিক দলের বিরোধিতা করেন তাহলে ৭০(খ) অনুচ্ছেদের প্রভাবে সংসদে তাঁর আসন শূন্য হবে। অর্থাৎ, এক্ষেত্রে নির্বাচিত সংসদ-সদস্যগণ সংসদে তাদের বাক-স্বাধীনতার প্রয়োগ ও তাদের নির্বাচনী এলাকার সাধারণ সার্বভৌম জনগণের প্রতিনিধিত্ব করতে ব্যর্থ হচ্ছেন। এটি দেশের গণতান্ত্রিক ব্যবস্থা এবং যেই মহান উদ্দেশ্যে ও জনগণের শাসন প্রতিষ্টার লক্ষে মহান মুক্তিযুদ্ধ সংঘঠিত হয়েছে তাঁর পরিপন্থী বলেই মনে করছি।
সংসদ ভবনে জনগণের নির্বাচিত প্রতিনিধি যদি তাঁর নির্বাচনী অঞ্চলের সাধারণ জনগণের আশা-আকাঙ্ক্ষাটিই ভোটের মাধ্যমে ব্যক্ত না করতে পারেন তাহলে সেই সংসদ-সদস্য পদটি কেবলমাত্র প্রহসনমূলক বললেও ভুল হবেনা। আবার, সরকারপ্রধান যিনি সংসদের সংখ্যাগরিষ্ঠ সদস্যের আস্থাভাজন ও দলীয় ব্যানারে নির্বাচিত সংখ্যাগরিষ্ঠ সাংসদ এর নেতা, তাঁর উত্থাপিত কোনোকিছুর বিপক্ষে ভোটদান দলের আচরণ বিধি লঙ্ঘন হিসেবে গণ্য হবে ও ৭০(খ) অনুচ্ছেদ অনুযায়ী তার সংসদ সদস্য পদটি বাতিল বলে গণ্য হবে। ফলে প্রধানমন্ত্রী কর্তৃক উত্থাপিত যেকোনো বিষয়ের পক্ষে সংসদ সদস্যগণ পক্ষ ভোট বা হ্যা ভোট দিতে পরোক্ষভাবে বাধ্য। অর্থাৎ, সিদ্ধান্ত গ্রহণের ক্ষেত্রে প্রধানমন্ত্রীর একক সিদ্ধান্তই ঘুরেফিরে সংসদের অধিকাংশ সদস্যের সিদ্ধান্ত বলে চালিয়ে দেওয়া হয় যেটি একটি নির্বাচিত একনায়কতন্ত্র ছাড়া অন্যকিছু নয়।
অবশেষে বলা যায়, সংবিধানের ৭০ অনুচ্ছেদটি গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশে সত্যিকারের গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠার ক্ষেত্রে একটি বড় বাধা। এবং, গণতন্ত্রের শাসন প্রতিষ্টার লক্ষে ১৯৭১ সালে যে মহান মুক্তিযুদ্ধ সংঘঠিত হয়েছে সেই মহান মুক্তিযুদ্ধের উদ্দেশ্য এবং জনগণের আশা-আকাঙ্ক্ষার প্রতিফলনকে কার্যকর করবার জন্য সংবিধানের ৭০ অনুচ্ছেদটি সংস্কারের দাবি রাখে।
লেখক: সহ-সভাপতি, বাংলাদেশ ল অ্যালায়েন্স, এবং শিক্ষার্থী, আইন বিভাগ, বাংলাদেশ ইউনিভার্সিটি অব প্রফেশনালস্।