নাজিয়া আমিন: মুসলিম আইনের বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ের মধ্যে বিবাহ বিচ্ছেদ বা তালাক একটি। আমরা সবাই এ সম্পর্কে অবগত যে, একজন মুসলিম পুরুষ তার স্ত্রীকে বৈধ কারণ সাপেক্ষে তালাক প্রদান করতেপারেন। তবে একজন মুসলিম নারী তার স্বামীকে তালাক প্রদান করতে পারেন কিনা বা একজন মুসলিম নারীর নিজ উদ্যোগে তালাক দেয়ার অধিকার আছে কিনা সে সম্পর্কে অনেক সময় ধোঁয়াশা দেখা যায়। বাংলাদেশে প্রচলিত মুসলিম আইনের অধীনে কতগুলো শর্ত আছে, যেগুলো পূরণ হলেই কেবল একজন নারী তালাক দিতে পারেন।
একজন নারী যেভাবে তালাক দিতে পারেন
মুসলিম সমাজে নারীকে কতিপয় ক্ষেত্রে বিবাহ বিচ্ছেদের অধিকার দেয়া হয়েছে। তবে এক্ষেত্রে কতগুলো বিষয় আছে। তার উপর নির্ভর করেই সিদ্ধান্ত হয় যে, কোন প্রক্রিয়া অনুসরণ করে তালাক সম্পন্ন হবে। সে প্রক্রিয়াগুলো হচ্ছে –
ক) তালাক-ই-তৌফিজ
কাবিন নামার ১৮নং কলামের মাধ্যমে স্ত্রীকে তালাকের যে ক্ষমতা প্রদান করা হয় সেটা ‘তালাক-ই-তৌফিজ’ নামে পরিচিত। এ ক্ষমতা বলে বিবাহ বিচ্ছেদ করতে চাইলে মুসলিম পারিবারিক আইন অধ্যাদেশ, ১৯৬১ এর ৭ ধারা অনুসরণ করে তালাক প্রক্রিয়া সম্পন্ন করতে হয়।এখানে স্ত্রী তার স্বামীকে তালাক দেয়ার পর বা বিবাহ ছিন্ন করার পর তালাক রেজিষ্ট্রেশন করবেন। এরপর তালাকের নোটিশের এক কপি পৌর/সিটি করপোরেশনের চেয়ারম্যানকে পাঠাবেন এবং এক কপি স্বামীর ঠিকানায় প্রেরণ করবেন। পৌর/সিটি করপোরেশনের নিকট নোটিশ প্রেরণের পর ৯০ দিন অতিবাহিত হলে তালাক কার্যকর হবে।
খ) খুলা তালাক
স্বামী-স্ত্রীর উভয়ের সম্মতিতে যে তালাক হয় সেটা খুলা তালাক। এখানে স্ত্রী কর্তৃক তালাকের প্রস্তাব দেয়া হবে এবং স্বামী কর্তৃক তা গ্রহণ হবে। অর্থ্যাৎ, দুই পক্ষই এখানে সংসার ছিন্ন করার ব্যাপারে সম্মত থাকবেন।এ ধরনের তালাকের ক্ষেত্রে উভয়পক্ষকেই কাজী অফিসে উপস্থিত হয়ে কার্যক্রম সম্পন্ন করতে হয়।
গ) মুবারত
মুবারত হচ্ছে এমন একটি প্রক্রিয়া যার মাধ্যমে উভয়পক্ষ বিচ্ছেদের জন্য সম্মত থাকবেন। বিস্তারিতভাবে বলতে গেলে বিষয়টি হচ্ছে এ রকম যে, উভয়পক্ষ এখানে ঐক্যমতের ভিত্তিতে তালাকের সিদ্ধান্তে উপনীত হবেন। অনেকে মনে করেন যে, মুবারতের ক্ষেত্রে পক্ষগণ একে অপরকে ক্ষতিপূরণ দিতে বাধ্য। তবে এ ধারণা সঠিক নয়। কোন পক্ষকেই এখানে কোন মূল্য দিতে হয়না এবং এ বিষয়ে আদালতের সিদ্ধান্ত আছে। (মোসাম্মৎ গুলাম সখিনা বনাম উমর বখশ এবং অন্যান্য ১৯৬৪, ১৬ ডিএলআর, ৩৮৯)
ঘ) আদালতের মাধ্যমে বিচ্ছেদ
একজন মুসলিম নারী যদি তালাক-ই-তৌফিজ, খুলা বা মুবারতের মাধ্যমে তালাক দিতে না পারেন, তাহলে আদালতের মাধ্যমে বিচ্ছেদ চাইতে পারেন। মুসলিম বিবাহ বিচ্ছেদ আইন, ১৯৩৯ এর ২ ধারা অনুসারে, কতগুলো বিষয় আছে যা প্রমাণ করতে পারলে একজন বিবাহিত মহিলা আদালত থেকে বিবাহ বিচ্ছেদের ডিক্রি পাওয়ার অধিকারী হবেন।
স্বামী যদি নিষ্ঠুর আচরণ করেন তাহলে এ মর্মে বিবাহ বিচ্ছেদের মামলা করা যাবে। এখানে নিষ্ঠুর আচরণ বলতে শারীরিক ও মানসিক নির্যাতনকে বোঝায়। নারীর সম্পত্তি জোরপূর্বক হস্তান্তর করা, সম্পত্তি ভোগে বাধা দেয়া, অনৈতিক জীবনযাপনে বাধ্য করা, ধর্ম কর্ম পালনে বাধা প্রদান, আইনগত অধিকার প্রয়োগে বাধা এসবই নিষ্ঠুর আচরণের আওতাভুক্ত।এই নিষ্ঠুর আচরণের কারণে স্ত্রী গৃহত্যাগ করলে স্বামী দাম্পত্য সম্পর্ক পুনরুদ্ধারের মামলা করলেও ডিক্রি পাবেন না।
অনেক সময় এরকম কঠিন অবস্থা দেখা যায় যে, বিয়ের পর স্বামী নিরুদ্দেশ হয়েছেন। তখন এধরনের পরিস্থিতিতে স্ত্রী আদালতের মাধ্যমে বিচ্ছেদ চাইতে পারেন। আইন অনুযায়ী, স্বামীর যদি চার (৪) বছর যাবত কোন খোঁজ-খবর না পাওয়া যায়, তাহলে স্ত্রী বিচ্ছেদের জন্য আদালতের আশ্রয় নিতে পারেন। তবে আদালত ডিক্রি প্রদান করলে তা ছয় (৬) মাসের আগে কার্যকর হবে না। তাছাড়া স্বামীর যদি সাত (৭) বছর বা তার চেয়ে বেশি সময়ের জন্য কারাদন্ড হয়, তাহলেও স্ত্রী বিচ্ছেদ চাইতে পারেন।
আদালতের মাধ্যমে বিচ্ছেদের আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ কারণ হল স্বামী কর্তৃক ভরণপোষণ না দেয়া। ভরণপোষণ পাওয়া প্রতিটি বিবাহিত নারীর আইনি অধিকার। সে ভরণপোষণ যদি দুই (২) বছর যাবত না দেয়া হয়, তাহলে স্ত্রী আদালতের মাধ্যমে বিবাহ বিচ্ছেদ চাইতে পারেন।এ মর্মে সালমা খাতুন বনাম মোসলেম উদ্দিন ১৯ ডিএলআর (হাইকোর্ট) পৃষ্ঠা ৫৫৩ মামলায় বলা হয়েছে যে, স্ত্রী নির্যাতনের ভয়ে গৃহত্যাগ করে যদি ভরণপোষণ না পান, তাহলেও তিনি বিবাহ বিচ্ছেদের ডিক্রি পাবার অধিকারী হবেন।
স্ত্রী কর্তৃক তালাক হলে দেনমোহর পরিশোধ যোগ্য কিনা
আমাদের দেশে অনেকেই মনে করেন যে, একজন স্ত্রী তালাক প্রদান করলে তার দেনমোহরের অধিকার খর্ব হয়। আসলে বিষয়টি সেরকম নয়। তালাক স্বামী বা স্ত্রী যেই দিয়ে থাকুক না কেন দেনমোহর পরিশোধ করতে হবে। এখানে উল্লেখ্য যে, তালাকের সাথে দেনমোহরের কোন সম্পর্ক নেই। এটা স্ত্রীর আইনী অধিকার। তালাক না হলেও দেনমোহর পরিশোধ করতে হয়।
শেষ কথা
সবশেষে বলা যায় যে, ইসলামিক ও রাষ্টীয় আইন উভয়ই মুসলিম নারীকে কতিপয় ক্ষেত্রে তালাক প্রদানের ক্ষমতা দিয়েছে। তালাক বা বিবাহ বিচ্ছেদের বিষয়টি যদিও আপাত দৃষ্টিতে সন্তোষজনক নয়, তারপরও পরিস্থিতি ক্ষেত্রে অনেক সময় এধরনের পদক্ষেপ নেয়ার প্রয়োজন হয়।
লেখক: আইনজীবী, জজকোর্ট, ঢাকা। Email – aminnazia@gmail.com