সুপ্রিম কোর্টের বিচারক নিয়োগের অধ্যাদেশ জারি এবং বাস্তবতার নিরিখে সমালোচনা
মোঃ ওবাইদুল্যাহ আল মামুন সাকিব

বিচার বিভাগ সংষ্কার কমিশনের সংবিধান লঙ্ঘন এবং আদালত অবমাননা

মোঃ ওবাইদুল্যাহ আল মামুন সাকিব : গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশের সংবিধানের ১০০ নং অনুচ্ছেদে সুপ্রিম কোর্টের স্থায়ী আসন সংক্রান্ত বলা হয়েছে, “রাজধানীতে সুপ্রীম কোর্টের স্থায়ী আসন থাকিবে, তবে রাষ্ট্রপতির অনুমোদন লইয়া প্রধান বিচারপতি সময়ে সময়ে অন্য যে স্থান বা স্থানসমূহ নির্ধারণ করিবেন, সেই স্থান বা স্থানসমূহে হাইকোর্ট বিভাগের অধিবেশন অনুষ্ঠিত হইতে পারিবে।”

১৯৭২ সালের ১৬ই ডিসেম্বরে কার্যকর হওয়া দেশের মূল সংবিধানের সুপ্রীম কোর্টের স্থায়ী আসন নির্ধারণ করা হয়। অনুচ্ছেদ ৫(১) এর অধীন প্রতিষ্ঠিত রাজধানী ঢাকায় সুপ্রীম কোর্টের স্থায়ী আসন নির্ধারণ করে সুপ্রীম কোর্টের কার্যক্রম পরিচালনা করার বিধান রাখা হয়েছে।

পরবর্তীতে ১৯৮৮ সালের ৭ জুন সামরিক শাসক হুসেইন মুহম্মদ এরশাদের সামরিক শাসনামলে সংবিধানের অষ্টম সংশোধনী পাশ করা হয়। এই সংশোধনীর মাধ্যমে সংবিধানের মৌলিক কয়েকটি গুরুত্বপূর্ণ অনুচ্ছেদে যেমন ২, ৩, ৫, ৩০ ও ১০০ এর পরিবর্তন করা হয়।

রাষ্ট্রধর্ম হিসেবে ইসলামকে স্বীকৃতি প্রদান করা ও ঢাকার বাইরে ৬টি জেলায় হাইকোর্টের স্থায়ী বেঞ্চ স্থাপন করার বিধান চালু করা হয়।

Dacca-এর নাম Dhaka এবং Bangali-এর নাম Bangladeshi-তে পরিবর্তন করা হয় এই সংশোধনীর মাধ্যমে। তৎকালীন সংসদ নেতা ব্যারিস্টার মওদুদ আহমেদ কর্তৃক উত্থাপিত এই বিলটি ২৫৪-০ ভোটে পাস হয়। পরবর্তীতে ১৯৮৯ সালের ৯ জুন রাষ্ট্রপতির অনুমোদন পায়।

অষ্টম সংশোধনী পাশ হওয়ার পর এর বৈধতা চ্যালেঞ্জ করে সুপ্রীম কোর্টের হাইকোর্ট ডিভিশনে রীট দায়ের করা হয়। এই মামলা আনোয়ার হোসেন চৌধুরী বনাম বাংলাদেশ মামলা যা অষ্টম সংশোধনী মামলা হিসেবে বহুল আলোচিত।

সামরিক শাসক কর্তৃক পাশকৃত সংবিধানের বিরুদ্ধে রীট দায়ের করা হয় যা ৪১ ডিএলআর (এডি) ১৬৫ এবং ১৯৮৯ বিএলডি(স্পেশাল) ১ এ রিপোর্টেড জাজমেন্ট হিসেবে স্থান লাভ করে।

এই রীটের পিটিশনারের পক্ষে সুপ্রীম কোর্টের এ্যাপিলেট ডিভিশনে শুনানি করেন প্রখ্যাত আইনজীবী ডঃ কামাল হোসেন, ব্যারিস্টার সৈয়দ ইশতিয়াক আহমেদ এবং ব্যারিস্টার এম আমিরুল ইসলাম এবং রাষ্ট্র পক্ষে শুনানি করেন এটর্নি জেনারেল মোঃ নুরুল্লাহ এবং এমিকাস কিউরি হিসেবে ছিলেন আসরারুল হক এবং মাহবুব উদ্দিন আহমেদ।

দীর্ঘ শুনানি শেষে আদালত ৩-১ এর ভিত্তিতে অষ্টম সংশোধনীর হাইকোর্ট স্থানান্তর সংক্রান্ত বিধান অবৈধ বলে ঘোষণা করেন।

বাংলাদেশ একটি এককেন্দ্রিক রাষ্ট্র। এখানে কোন প্রদেশ কিংবা প্রাদেশিক সরকার ব্যবস্থার কোন সুযোগ সংবিধান রাখেনি। সংবিধান অনুসারে সুপ্রীম কোর্ট একটি একক প্রতিষ্ঠান। সুপ্রীম কোর্টের দুইটি ডিভিশন হাইকোর্ট ডিভিশন এবং এ্যাপিলেট ডিভিশন। এখানে কোন আলাদা হাইকোর্ট নেই বরং সংবিধান অনুসারে সুপ্রীম কোর্টের একটা ডিভিশন হলো হাইকোর্ট।

উপমহাদেশের ভারত ও পাকিস্তান প্রদেশ ভিত্তিক রাষ্ট্র কাঠামো হওয়ার কারণে সেখানে প্রাদেশিক হাইকোর্ট রয়েছে। এখানে ভারত কিংবা পাকিস্তানের মত রাষ্ট্র কাঠামো না হওয়ার কারণে হাইকোর্ট স্থানান্তরের কোন সুযোগ নেই।

সংষ্কার কমিশনের প্রস্তাব অনুযায়ী যদি হাইকোর্ট স্থানান্তর করা হয় তাহলে এটি সংবিধানের সাথে সাংঘর্ষিক হবে। কেননা অষ্টম সংশোধনী মামলায় প্রধান বিচারপতি বদরুল হায়দার চৌধুরী উল্লেখ করেছিলেন, বাংলাদেশের সংবিধানে উচ্চ আদালতের বিচারিক কার্যক্রমের বিকেন্দ্রীকরণ করণের সুযোগ নেই।

বিচারপতি এম এইচ রহমান উল্লেখ করেছেন, উচ্চ আদালতের বিচারিক কার্যক্রম দোরগোড়ায় পৌঁছে দিতে হবে এরকম কোন প্রয়োজন নেই কেননা সুপ্রিম কোর্ট একটা এককেন্দ্রিক আদালত এবং সাংবিধানিক আদালত। সাংবিধানিক আদালত হিসেবে এবং রাষ্ট্রের সংবিধানের অভিভাবক হিসেবে সুপ্রীম কোর্টের স্থায়ী আসন রাজধানী থেকে অন্যত্র সরিয়ে নেয়া সংবিধানের স্পষ্ট লঙ্ঘন।

বিবিসি বাংলার ০৫/০২/২০২৫ ইং তারিখে প্রকাশিত “বিভাগীয় পর্যায়ে হাইকোর্টের স্থায়ী বেঞ্চের সুপারিশ কতটুকু যৌক্তিক” শিরোনামে খবরে সাবেক জেলা জজ এবং বিচার বিভাগ সংষ্কার কমিশনের সদস্য জনাব মাসদার হোসেন মনে করেন “কিছু স্বার্থান্বেষী আইনজীবীদের কারণেই ওই রায় হয়েছিল”।

অষ্টম সংশোধনী মামলার যারা আইনজীবী ছিলেন তাদের মধ্যে একজন ছিলেন বর্তমান প্রধান বিচারপতির পিতা মরহুম সৈয়দ ইশতিয়াক আহমেদ।

জনাব মাসদার হোসেন ওনার মন্তব্যে আইনজীবীদের স্বার্থান্বেষী বলে আখ্যায়িত করেছেন! প্রকারান্তরে তিনি সুপ্রিম কোর্টের সকল আইনজীবীদেরকেই অবজ্ঞা করেছেন এমনকি বর্তমান মাননীয় প্রধান বিচারপতি সৈয়দ রেফাত আহমেদের পিতা স্বনামধন্য আইনজ্ঞকেও অবজ্ঞা করতে পিছপা হননি!

বিচার বিভাগ সংষ্কার কমিশন নামে গঠিত এই কমিশনের প্রধান সাবেক বিচারপতি শাহ আবু নাঈম মোমিনুর রহমান এবং অন্য যারা সদস্য আছেন তারা অধিকাংশই জেলা ও দায়রা আদালতের জজ ছিলেন এবং আইনের শিক্ষক রয়েছেন। তারা সংষ্কারের নামে যে সুপারিশ করেছেন তার দিকে তাকালে মনে হবে সম্ভবত সুপ্রীম কোর্টের মৌলিক সমস্যা নিয়ে কথা বলেন নি। কিংবা তারা জানেন না সুপ্রীম কোর্টের মৌলিক সমস্যা কী কী?

কমিশনের সদস্যগন মনগড়া রিপোর্ট প্রকাশ করে বিচার বিভাগের প্রতি নাগরিক, আইনজীবী এবং বিচারপতিদের অবজ্ঞা করেছেন। সুপ্রীম কোর্টের মৌলিক সমস্যা নিয়ে আলোচনা না করে সামরিক শাসক হুসেইন মুহম্মদ এরশাদের মনগড়া চিন্তাকে সুপ্রীম কোর্টের বিচারক এবং আইনজীবীদের উপর চাপিয়ে দিলেন যা সুপ্রীম কোর্ট কর্তৃক ঘোষিত অবৈধ সংশোধনীকে পুনর্জীবীত করছে!

প্রকৃত অর্থে জনগণের জন্য ন্যায়বিচার নিশ্চিত করতে হলে বর্তমান বিচার বিভাগকে বিশেষ করে সর্বোচ্চ আদালতকে আধুনিকায়ন করতে হবে। সুপ্রীম কোর্টের বিচারক সংখ্যা বাড়াতে হবে। নির্দিষ্ট সংখ্যক বেঞ্চে মামলা পরিচালনা করার জন্য উন্মুক্ত থাকতে হবে।

প্রতিটি ম্যাটারের জন্য যেমন ৪৯৮ এর জন্য কয়েকটি বেঞ্চ, ৫৬১ এর জন্য কয়েকটি বেঞ্চ, জেনারেল ফৌজদারী মামলার জন্য কয়েকটি বেঞ্চ, ডেথ রেফারেন্সের জন্য আলাদা হেয়ারিং বেঞ্চ, জেনারেল রীটের জন্য আলাদা বেঞ্চ, বিশেষ রীটের জন্য আলাদা বেঞ্চ, কোম্পানি, বাণিজ্যিক, এডমিরালটি, ভ্যাট ট্যাক্সের জন্য আলাদা বেঞ্চ গঠন সময়ের দাবী।

বর্তমান কাঠামোয় সুপ্রীম কোর্টের বিচারকের সংখ্যা এবং আদালতের কার্যক্রম বৃদ্ধি করলেই জনগণ অতিদ্রুত ন্যায় বিচার পাবেন। ছয়টি ডিভিশনে হাইকোর্ট স্থানান্তর করা একদিকে সংবিধানের মৌলিক স্পিরিটের সাথে সাংঘর্ষিক, অষ্টম সংশোধনী মামলার রায়ের অবমাননা, অপরদিকে এটা ব্যাপক ব্যয় সাপেক্ষ। সুপ্রীম কোর্টের বর্তমান কাঠামোয় সংষ্কার করে বিচারক সংখ্যা বাড়িয়ে সকল সুযোগ নিশ্চিত করলেই সংবিধান সমুন্নত থাকবে।

লেখক: রাজনীতি বিশ্লেষক এবং অ্যাডভোকেট, বাংলাদেশ সুপ্রীম কোর্ট।