বিচার বিভাগের সংস্কারের জন্য ২৮ দফা সুপারিশ করেছে এ উদ্দেশ্যে গঠিত সংস্কার কমিশন। কমিশনের ২৮ দফা সুপারিশের মধ্যে আইন পেশার সংস্কারের সুপারিশ করা হয়েছে।সুপারিশে আইনজীবী তালিকাভুক্তি পরীক্ষার সিলেবাসে সংস্কার করার প্রস্তাব করেছে কমিশন। বিষয়টি কমিশনের ২৩ নং সুপারিশে স্থান পেয়েছে।
এতে বলা হয়েছে, আইনজীবীরা একটি আধুনিক গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রের বিচার ব্যবস্থার অবিচ্ছেদ্য অংশ। সংবিধানের ৩৩(১) অনুচ্ছেদের গ্রেফতার ও আটক সংক্রান্ত বিধানে, সুপ্রীম কোর্টের বিচারক নিয়োগ সংক্রান্ত ৯৫(২) অনুচ্ছেদে এবং বিচার পদ্ধতি সংক্রান্ত নানাবিধ আইনে আইন পেশার স্বীকৃতির প্রতিফলন দেখা যায়। সুতরাং, বিচার বিভাগ বিষয়ক যে কোনো সংস্কার প্রচেষ্টায় আইনজীবীদের প্রসঙ্গটি অপরিহার্য। তবে, নানাবিধ সীমাবদ্ধতার কারণে এই প্রতিবেদনে মূলত তিনটি বিষয়ের উপরে আলোকপাত করা হয়েছে, যথা: আইনজীবী হিসাবে সনদ প্রাপ্তি, প্রশিক্ষণ এবং বিচার কার্যক্রমে তাদের আচরণ।
সনদপ্রাপ্তির বর্তমান পদ্ধতি
নাগরিকত্ব বয়স ও শিক্ষাগত যোগ্যতা
Bangladesh Legal Practitioner and Bar Council Order 1972 এর অনুচ্ছেদ ২৭ অনুযায়ী একজন ব্যক্তিকে আইনজীবী অন্তর্ভুক্তি পরীক্ষায় অবতীর্ণ হওয়ার জন্য নিম্নোক্ত শর্তাবলি পূরণ করতে হবে:
(ক) তাকে বাংলাদেশের নাগরিক হতে হবে;
(খ) তাকে ২১ বছর বয়সী হতে হবে;
(গ) বাংলাদেশে স্বীকৃত কোনো বিশ্ববিদ্যালয় হতে অথবা বার কাউন্সিল স্বীকৃত বাংলাদেশের বাইরের কোনো বিশ্ববিদ্যালয় হতে তার আইনের ডিগ্রিথাকতে হবে অথবা তাকে ব্যারিস্টার-এট-ল’ হতে হবে।
শিক্ষানবিশ পর্যায়
বাংলাদেশে এলএলবি পাশ করার পর একজন ব্যক্তি শিক্ষানবিশ হওয়ার যোগ্য হন। তাকে কমপক্ষে ১০ (দশ) বছরের অভিজ্ঞতাসম্পন্ন একজন প্র্যাকটিসিং অ্যাডভোকেটের অধীনে পিউপিলেজ চুক্তি সম্পাদনক্রমে ছয় মাসের জন্য শিক্ষানবীশ হিসেবে কাজ করতে হয়।
আইনজীবী অন্তর্ভুক্তি পরীক্ষা ও সিলেবাস
বর্তমানে মোট ৭টি বিষয়ের ওপর আইনজীবী তালিকাভুক্তির পরীক্ষা অনুষ্ঠিত হয়ে থাকে। এগুলো হলো: ১। দেওয়ানি কার্যবিধি, ১৯০৮
২। দণ্ডবিধি, ১৮৬০
৩। ফৌজদারি কার্যবিধি, ১৮৯৮
৪। সুনির্দিষ্ট প্রতিকার আইন, ১৮৭৭
৫। তামাদি আইন, ১৯০৮
৬। সাক্ষ্য আইন, ১৮৭২ ও
৭। বার কাউন্সিল অর্ডার এন্ড রুলস, ১৯৭২
পরীক্ষা পদ্ধতি
আইনজীবী অন্তর্ভুক্তি পরীক্ষার মোট তিনটি ধাপ রয়েছে:
(ক) বহু-নির্বাচনি (এমসিকিউ)
(খ) লিখিত পরীক্ষা
(গ) মৌখিক পরীক্ষা।
অন্তর্ভুক্তি পরীক্ষার প্রার্থীদের প্রথমেই ১০০ নম্বরের এমসিকিউ পরীক্ষা নেওয়া হয়। এমসিকিউ পরীক্ষায় উত্তীর্ণ প্রার্থীরা এরপর ১০০ নম্বরের লিখিত পরীক্ষায় অংশ নেয়। এমসিকিউ এবং লিখিত দুইটি পরীক্ষাতেই পাস নম্বর ৫০। লিখিত পরীক্ষায় উত্তীর্ণ প্রার্থীরা পরবর্তীতে ৫০ নম্বরের মৌখিক পরীক্ষায় অংশ নেয় যার পাশ নম্বর ২৫। মৌখিক পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হওয়ার মাধ্যমেই একজন প্রার্থী চূড়ান্তভাবে আইনজীবী হিসেবে সনদপ্রাপ্তির জন্য যোগ্য বলে গণ্য হন।
পার্শ্ববর্তী দেশে আইনজীবী সনদপ্রাপ্তি পদ্ধতি
ভারত
ভারতে আইনজীবী হতে হলে একজনকে রাজ্য বার কাউন্সিলে নিবন্ধন করতে হয় এবং অল ইন্ডিয়া বার এক্সামিনেশন (AIBE) পাস করতে হয়, যা বার কাউন্সিল অফ ইন্ডিয়া (BCI) দ্বারা নিয়ন্ত্রিত। প্রার্থীদের অবশ্যই BCI স্বীকৃত বিশ্ববিদ্যালয় বা কলেজ থেকে এলএলবি (৩ বছরের বা ৫ বছরের) ডিগ্রি অর্জন করতে হয়। ভারতে আইন পেশা চর্চার জন্য অল ইন্ডিয়া বার এক্সামিনেশন (AIBE) একটি বাধ্যতামূলক সনদ পরীক্ষা। AIBE পরীক্ষায় একজন প্রার্থীকে ১০০ মার্কের MCQ পরীক্ষায় অংশগ্রহণ করতে হয় যেখানে তিনি আইনের সরকারি প্রকাশনা (Bare Act)-এর সহায়তা নিয়ে পরীক্ষা দিতে পারেন। বাংলাদেশের তুলনায় বেশ বিস্তৃত এবং ব্যবহারিক দৃষ্টিভঙ্গিসম্পন্ন AIBE পরীক্ষার সিলেবাসের মধ্যে অন্তর্ভুক্ত রয়েছে সাংবিধানিক আইন, ফৌজদারি কার্যবিধি, দেওয়ানি কার্যবিধি, ভারতীয় দণ্ডবিধি, সাক্ষ্য আইন, পেশাগত নৈতিকতা, পারিবারিক আইন, প্রশাসনিক আইন, জনস্বার্থ মামলা, বিকল্প বিরোধ নিষ্পত্তি আইন, পরিবেশ আইন, ইন্টেলেকচুয়াল প্রোপার্টি আইন, সালিশি আইন, কোম্পানি আইন, সাইবার আইন, ইত্যাদি ।
শ্রীলঙ্কা
শ্রীলঙ্কায় Attorney-at-Law বা আইনজীবী তালিকাভুক্তি প্রক্রিয়া এলএলবি এবং নন-এলএলবি শিক্ষার্থীদের জন্য কিছুটা ভিন্ন। সাধারণত, অ্যাটর্নি-এট-ল হতে ইচ্ছুক প্রার্থীদের শ্রীলঙ্কা ল’ কলেজ (SLLC) এর প্রবেশিকা পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হতে হয়। স্বীকৃত বিশ্ববিদ্যালয় থেকে এলএলবি স্নাতকরা ঝখখঈ’র প্রিলিমিনারি এবং ইন্টারমিডিয়েট পরীক্ষা থেকে অব্যাহতি পান, অর্থ্যাৎ তারা সরাসরি ফাইনাল বর্ষে ভর্তি হন। তবে, নন এলএলবি শিক্ষার্থীদের SLLC-তে সম্পূর্ণ তিন বছর অধ্যয়ন করতে হয়। SLLC’র প্রশিক্ষণে বিভিন্ন আইনি বিষয়ের উপর লেকচার, টিউটোরিয়াল এবং ব্যবহারিক অনুশীলন অন্তর্ভুক্ত থাকে, যা ননএলএলবি শিক্ষার্থীদের জন্য তিন বছর এবং এলএলবি স্নাতকদের জন্য এক বছর স্থায়ী হয়। SLLC তে অধ্যয়ন সমাপ্ত করার পরে, শ্রীলঙ্কার সুপ্রীম কোর্ট কর্তৃক Attorney-at-Law হিসাবে তালিকাভুক্ত হওয়ার আগে সকল শিক্ষার্থীকে আট বছরের অভিজ্ঞতাসম্পন্ন একজন সিনিয়র অ্যাটর্নির অধীনে ছয় মাসের শিক্ষানবিশীতে অংশ নিতে হয়। যথাযথ প্রাতিষ্ঠানিক প্রশিক্ষণ এবং মূল্যায়নের ব্যবস্থা রাখার ফলে বাংলাদেশ, ভারতসহ দক্ষিণ এশিয়ার অন্যান্য দেশগুলোর চাইতে শ্রীলঙ্কার আইনজীবী অন্তর্ভুক্তি প্রক্রিয়া বেশ এগিয়ে আছে।
বাংলাদেশে আইনজীবীগণের যোগ্যতা এবং সনদপ্রাপ্তিতে বিদ্যমান সমস্যা
সংক্ষিপ্ত সিলেবাস
বাংলাদেশ বার কাউন্সিলের অন্তর্ভুক্তি পরীক্ষার সিলেবাস একটি গুরুত্বপূর্ণ মাধ্যম যা নতুন আইনজীবীদের পেশাগত জীবনে প্রবেশের যোগ্যতা নির্ধারণ করে। তবে বর্তমানে বার কাউন্সিল পরীক্ষার সীমাবদ্ধ সিলেবাস দেশের পরিবর্তনশীল আইনগত প্রেক্ষাপটের সাথে সামঞ্জস্যপূর্ণ নয়। দেশে আইন প্রতিনিয়ত পরিবর্তিত হচ্ছে, এবং নতুন নতুন আইনগত চ্যালেঞ্জ তৈরি হচ্ছে। বার কাউন্সিলের বর্তমান সিলেবাসে এসব পরিবর্তনের প্রতিফলন দেখা যায় না। এর ফলে প্রার্থীরা শুধু পুরোনো আইনি ধারণাগুলোর উপর নির্ভরশীল থেকে যান, যা তাদের ভবিষ্যত পেশাগত জীবনে সমস্যার সৃষ্টি করে। বর্তমানে মাত্র ৭টি আইন বিষয়ে পরীক্ষা নেয়া হয়।
এক্ষেত্রে আরো কিছু গুরুত্বপূর্ণ আইন সিলেবাসে যোগ করা আবশ্যক, যেমন: সংবিধান, পারিবারিক আইন, অর্থ ঋণ আদালত আইন, Negotiable Instruments Act, 1881, শ্রম আইন, মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ আইন, ইত্যাদি। তাছাড়া, আইন- পেশায় নৈতিকতা (Legal Ethics)) একটি বাধ্যতামূলক পৃথক বিষয় হিসাবে পরীক্ষার সিলেবাসে অন্তর্ভুক্ত থাকা প্রয়োজন।
বিলম্বিত অর্ন্তভুক্তি পরীক্ষা
বাংলাদেশ বার কাউন্সিলের অন্তর্ভুক্তি পরীক্ষা আইনজীবী হিসেবে কর্মজীবন শুরু করার প্রথম পদক্ষেপ। তবে, এই পরীক্ষার প্রক্রিয়ায় বারবার বিলম্ব একটি সাধারণ ঘটনা হয়ে দাঁড়িয়েছে, যা আইনপেশার প্রার্থীদের নানা আর্থিক, মানসিক এবং সামাজিক প্রতিবন্ধকতার সম্মুখীন করছে। বাংলাদেশ বার কাউন্সিল কর্তৃক সাধারণত বছরে একবার অন্তর্ভুক্তি পরীক্ষা নেওয়ার কথা থাকলেও, সংস্থাটিকে প্রায় সবসময় পরীক্ষা আয়োজনে বিলম্ব করতে দেখা যায়। এমনকি দুই থেকে তিন বছর বিরতিতে অনেক সময় পরীক্ষা আয়োজনের উদাহরণ আছে।
বাংলাদেশ বার কাউন্সিল বনাম এ কে এম ফজলুল কমির এবং অন্যান্য (২০১৭) মামলার রায়ে প্রতি বছর অন্তত একবার পরীক্ষা নেয়ার ব্যাপারে ব্যর্থতার কথা উঠে এসেছে। এছাড়া উক্ত মামলার রায়ে বার কাউন্সিলকে প্রতি ক্যালেন্ডার বছরে জেলা আদালতে আইনজীবী হিসেবে অন্তর্ভুক্তির জন্য আবেদনকারীদের অন্তর্ভুক্তি প্রক্রিয়া সম্পন্ন করতে বলা হয়েছে। তবে ২০২০-২৩ সালের মধ্যে পূর্বের অতি বিলম্ব কাটিয়ে তিনবার অন্তর্ভুক্তি পরীক্ষা নেওয়া হলেও সম্প্রতি আবারো অন্তর্ভুক্তি পরীক্ষা গ্রহণে বার কাউন্সিল কালক্ষেপন করছে।
প্রতিবেশী দেশ ভারতে প্রতি বছর দুইবার আইনজীবী অন্তর্ভুক্তি (AIBE) পরীক্ষা নেওয়া হয় এবং পরীক্ষা গ্রহণের দুই মাসের মধ্যেই আইনজীবী হিসেবে অন্তর্ভুক্তি প্রক্রিয়া সম্পন্ন করা হয়। এছাড়া শ্রীলঙ্কাতেও বছরে দুইবার SLLC কর্তৃক Attorney-at-Law অন্তর্ভুক্তি পরীক্ষা নেওয়া হয়। স্পষ্টত ভারত ও শ্রীলঙ্কার তুলনায় বাংলাদেশ বার কাউন্সিল অন্তর্ভুক্তি পরীক্ষা গ্রহণে বেশ পিছিয়ে আছে।
বাংলাদেশে বার কাউন্সিল পরীক্ষার মাধ্যমে আইনজীবীদের তালিকাভুক্তির জন্য বার কাউন্সিল অর্ডার, ১৯৭২ এর অনুচ্ছেদ ১১(খ) এর মাধ্যমে ৫-সদস্য বিশিষ্ট তালিকাভুক্তি কমিটি গঠন করা হয়। আপিল বিভাগের একজন বিচারপতি, হাইকোর্ট বিভাগের দুইজন বিচারপতি , বাংলাদেশের অ্যাটর্নি জেনারেল এবং বার কাউন্সিলের একজন নির্বাচিত সদস্য নিয়ে তালিকাভুক্তি কমিটি গঠিত হয়ে থাকে।
বাস্তবতা হচ্ছে কমিটির বিচারপতি সদস্যরা স্বাভাবিকভাবেই বিশাল সংখ্যক মামলার বিচারিক কার্যক্রমের চাপে ভারাক্রান্তথাকেন। বিচারিক দায়িত্বের বাইরে গিয়ে তালিকাভুক্তি কমিটির দায়িত্ব পালন তাদের ক্ষেত্রে অনেকটাই অসম্ভব হয়ে পড়ে। এছাড়া রাষ্ট্রের সর্বোচ্চ আইন কর্মকর্তা অ্যাটর্নি জেনারেলের পক্ষে তাঁর নির্ধারিত দায়িত্বের বাইরে গিয়ে তালিকাভুক্তি কমিটির কার্যাবলি যথাযথভাবে সম্পাদন করা দুরূহ হয়ে পড়ে। যার ফলে বার কাউন্সিল পরীক্ষা গ্রহণে বিলম্ব বেড়েই চলেছে যা আইনপেশায় যোগদানে ইচ্ছুক প্রার্থীদের জন্য চরম হতাশাজনক একটি বিষয়।
প্রাতিষ্ঠানিক প্রশিক্ষণের অভাব
বাংলাদেশ বার কাউন্সিল কর্তৃক আইনজীবীদের জন্য এখনো কোনো পূর্ণাঙ্গ প্রাতিষ্ঠানিক প্রশিক্ষণ কার্যক্রম নেই। কিন্তু আইনজীবীদের আইন বিষয়ক জ্ঞান ছাড়াও মামলার কৌশল, আদালতের কার্যক্রম পরিচালনা, ক্লায়েন্ট ম্যানেজমেন্ট, এবং পেশাগত আচরণ সম্পর্কে দক্ষতা লাভের জন্য বিশেষ প্রাতিষ্ঠানিক প্রশিক্ষণ একটি অতীব প্রয়োজনীয় বিষয়। এছাড়া এই বিশেষ প্রশিক্ষণ নবীন আইনজীবীদের মানসিকভাবে প্রস্তুত করে এবং তাদের দক্ষতা বাড়িয়ে তুলতে সহায়ক ভূমিকা পালন করে। বিশ্বের উন্নত এবং বর্তমানে উন্নয়নশীল দেশগুলোতে আইনজীবীদের প্রি-এনরোলমেন্ট প্রশিক্ষণ বেশ সাধারণ বিষয়। ইংল্যান্ডে আইনের ডিগ্রির পর Bar Standard Board কর্তৃক এক বছর মেয়াদি BPTC (Bar Professional Training Course) কোর্সে অংশগ্রহণ করা আবশ্যক।
এছাড়া অস্ট্রেলিয়াতে আইনের ডিগ্রিশেষে ২১ সপ্তাহ মেয়াদি বাধ্যতামূলক PLT (Practical Legal Training) কোর্সে উত্তীর্ণ হওয়ার মাধ্যমে আইনজীবী হিসেবে অন্তর্ভুক্ত হওয়া যায়। দক্ষিণ এশিয়ার দেশগুলোর মধ্যে শ্রীলঙ্কায় SLLC কর্তৃক তৃতীয় বর্ষের চূড়ান্ত পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হওয়ার পর আইন পেশায় যোগদানের পূর্ব-যোগ্যতা হিসেবে SLLC প্রদত্ত ছয় মাস মেয়াদি প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষানবীশকাল সম্পন্ন করতে হয়। কিন্তু বাংলাদেশে আইনজীবী অন্তর্ভুক্তি পরীক্ষায় অবতীর্ণ হওয়ার ক্ষেত্রে অন্তত ছয় মাসব্যাপী শিক্ষানবিশ হিসেবে কাজ করার অভিজ্ঞতা চাওয়া হলেও বাস্তবে এই শিক্ষানবীশীর তেমন কার্যকারিতা দেখা যায় না।
পেশাগত শৃঙ্খলা ও বার কাউন্সিল ট্রাইব্যুনালের ভূমিকা
আইনজীবীদের পেশাগত শৃঙ্খলা ও নৈতিকতা অত্যন্তগুরুত্বপূর্ণ। বাংলাদেশ বার কাউন্সিল ট্রাইব্যুনাল এই বিষয়ে নজরদারি করার জন্য গঠিত হলেও, এর কার্যকারিতা এবং আইনজীবীদের মধ্যে শৃঙ্খলার অভাব আইন পেশার মর্যাদাকে ক্ষুণ্ন করছে। পেশাগত নৈতিকতা বিষয়ক বিধি থাকলেও, তাদের প্রয়োগে সুনির্দিষ্ট ব্যবস্থার অভাব রয়েছে। একটি স্বাধীন বিচার ব্যবস্থা নিশ্চিত করার জন্য আইনজীবীদের পেশাগত সংস্কার এবং বার কাউন্সিলের কার্যক্রমের উন্নয়ন করা জরুরি।
পেশাগত শৃঙ্খলার গুরুত্ব
স্বাধীন, নিরপেক্ষ এবং কার্যকর বিচার ব্যবস্থা নিশ্চিত করতে আইনজীবীদের পেশাগত শৃঙ্খলা অত্যন্তগুরুত্বপূর্ণ। বিচার বিভাগে নৈতিকতা, দক্ষতা ও বিশ্বাসযোগ্যতা অনেকাংশে আইনজীবীদের আচরণ ও পেশাগত কর্মকাণ্ডের ওপর নির্ভরশীল। তাদের পেশাগত শৃঙ্খলা নিশ্চিত না হলে আইনের শাসন দুর্বল হয়ে পড়ে এবং বিচার ব্যবস্থার প্রতি জনগণের আস্থা কমে যায়।
সুতরাং, পেশাগত শৃঙ্খলা বজায় রাখা আইনজীবীদের নৈতিক দায়িত্বই শুধুনয়, এটি বিচার বিভাগের স্বাধীনতা ও কার্যকারিতার জন্য অপরিহার্য। তবে বাস্তবতা এই যে, পেশাগত মান রক্ষায় ও আচরণগত বিষয়ে কার্যত রয়েছে অনেক আইনজীবীর মধ্যেই রয়েছে অবহেলা। যার বহিঃপ্রকাশ দেখা যায় নিম্নবর্ণিত কর্মকাণ্ডে:
(১) মামলা পরিচালনায় দীর্ঘসূত্রিতা;
(২) বিচারকের সাথে অপেশাদার অচরণ;
(৩) মামলা পরিচালনায় অবহেলা;
(৪) মক্কেলের অনুরোধ সত্ত্বেও অনাপত্তিপত্র (NOC) প্রদান না করা;
(৫) আইনজীবী সমিতিগুলোতে রাজনৈতিক প্রভাব বিস্তার;
(৬) কোনো মামলায় কোনো আইনজীবী ব্যক্তিগতভাবে জড়িত থাকলে তাঁর বিপক্ষে অন্য আইনজীবীর নিয়োগে বাধাপ্রদান এবং আদালত বর্জন;
(৭) মিথ্যা মামলাকে নিরুৎসাহিত না করা;
(৮) টিআইবি রিপোর্ট অনুসারে বিচার প্রক্রিয়ায় দুর্নীতিমূলক কর্মকাণ্ডে কতিপয় আইনজীবীর অংশগ্রহণ;
(৯) মামলার ফি গ্রহণে রশিদ না দেয়া; ইত্যাদি।
বাংলাদেশে আইনজীবীদের মধ্যে মক্কেলের কাছ থেকে মামলার ফি গ্রহণ করার ক্ষেত্রে কোনো লিখিত রেকর্ড রাখার প্রবণতা খুব কম লক্ষ্য করা যায়। এর ফলে বিভিন্ন সময়ে মক্কেল এবং আইনজীবীর মধ্যে আর্থিক বিরোধ সৃষ্টি হতে দেখা যায়। এছাড়া ফি গ্রহণের রশিদ না থাকার ফলে মামলার কোনো পর্যায়ে মক্কেল কত ফি দিয়েছেন তা নিয়ে ভুল বোঝাবুঝির সুযোগ থাকে। রেকর্ড না থাকায় এই ধরনের অভিযোগ প্রমাণ করা কঠিন হয়ে পড়ে। অধিকন্তু, ফি গ্রহণে কোনো লিখিত রেকর্ড না থাকা আয়কর আইনের বিধানের সাথে অসংগতিপূর্ণ।
অভিযোগ নিষ্পত্তির অসন্তোষজনক পরিস্থিতি
বাংলাদেশ লিগ্যাল প্র্যাক্টিশনার ও বার কাউন্সিল অর্ডার ১৯৭২ (বার কাউন্সিল আদেশ) এর অনুচ্ছেদ ৩২-৩৮ এবং তদধীন প্রণীত বিধিমালায় আইনজীবীদের পেশাগত অসাদাচরণের বিরুদ্ধে অভিযোগ দায়ের এবং ট্রাইবুনাল কর্তৃক অভিযোগ নিষ্পত্তির বিস্তারিত বিধান আছে। বার কাউন্সিল প্রদত্ত তথ্য অনুসারে দেখা যায় ২০২০-২০২৪ সালে দায়েরকৃত অভিযোগের সংখ্যা ৪০১ টি এবং নিষ্পত্তিকৃত অভিযোগের সংখ্যা ৪০টি।
পেশাগত অসদাচরণকে সুনির্দিষ্ট করা
১৯৭২ সালের বার কাউন্সিল অর্ডার কিংবা বার কাউন্সিল বিধিতে আইনজীবীদের পেশাগত অসদাচরণের কোনো সুস্পষ্ট ও সুনির্দিষ্ট সংজ্ঞা দেওয়া নেই। ‘পেশাগত অসদাচরণ’ একটি ব্যাপক ধারণা, যার অন্তর্ভুক্ত বিষয়গুলো স্পষ্টভাবে উল্লেখ না থাকায় ট্রাইব্যুনালকে সিদ্ধান্তগ্রহণে অসুবিধার সম্মুখীন হতে হয়। এই অস্পষ্টতার কারণে বিভিন্ন ক্ষেত্রে ভিন্ন ভিন্ন ব্যাখ্যা তৈরি হতে পারে, যা ন্যায়বিচারের পরিপন্থী। ২০২৩ সালে সুপ্রীম কোর্টের একটি রায়েও বার কাউন্সিল আদেশে আইনজীবীদের পেশাগত অসাদাচরণের সংজ্ঞা না থাকা এবং যথাযথভাবে এর সংজ্ঞা নিরূপণের গুরুত্বের বিষয়টি উঠে আসে।
ট্রাইব্যুনালের প্রশ্নবিদ্ধ নিরপেক্ষতা
বার কাউন্সিল ট্রাইব্যুনালের তিনজন সদস্যের সবাই আইনজীবী হওয়ায় ট্রাইব্যুনালের সিদ্ধান্তে পক্ষপাতিত্বের সম্ভাবনা বেড়ে যায়। ট্রাইব্যুনালের তিনজন সদস্যের মধ্যে দুইজনই বার কাউন্সিলের সদস্য হওয়ায় ট্রাইব্যুনালের বিচারকার্যে বার কাউন্সিলের নির্বাচনী বিবেচনার প্রভাবও কাজ করতে পারে। এই কারণে অভিযোগকারী ন্যায়বিচার থেকে বঞ্চিত হতে পারেন।
তদন্তের সীমিত সুযোগ
বার কাউন্সিল আদেশ কিংবা বিধিতে অভিযোগের তদন্তের জন্য কোনো নির্দিষ্ট তদন্তকারী কর্মকর্তা বা সংস্থার উল্লেখ নেই। ফলে, অভিযোগের সত্যতা যাচাইয়ের জন্য প্রয়োজনীয় মাঠ পর্যায়ের তদন্তের সুযোগ সীমিত। এই কারণে অনেক ক্ষেত্রে সঠিক তথ্য প্রমাণ সংগ্রহ করা কঠিন হয়ে পড়ে, যা বিচারিক প্রক্রিয়ায় বাধা সৃষ্টি করে।
মিথ্যা অভিযোগের ক্ষেত্রে অপ্রতুল জরিমানা
আইনজীবীদের বিরুদ্ধে মিথ্যা ও হয়রানিমূলক অভিযোগ দায়েরের ক্ষেত্রে অনধিক ৫০০ টাকা জরিমানার বিধান অত্যন্ত অপ্রতুল। এই সামান্য জরিমানা অভিযোগকারীদের মিথ্যা অভিযোগ করতে উৎসাহিত করতে পারে, যেহেতেু এর মাধ্যমে তাদের তেমন কোনো ক্ষতির সম্মুখীন হতে হয় না। যার ফলে অনেক ক্ষেত্রেই আইনজীবীদের হয়রানির শিকার হওয়ার সম্ভাবনা থেকে যায়।
সুপারিশ
(ক) প্রচলিত মামলার ধরন বিবেচনায় সনদপ্রাপ্তির পরীক্ষার সিলেবাসে আরো কিছু আইন, যেমন: পারিবারিক আইন, অর্থঋণ আদালত আইন, নেগোসিয়েবল ইন্সট্রুমেন্ট এ্যাক্ট, মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ আইন, শ্রম আইন, ইত্যাদি সংযোজন করা বাঞ্ছনীয়। তাছাড়া বর্তমান রাষ্ট্রীয় কাঠামো, মৌলিক অধিকার সম্পর্কে আইনজীবীদের সম্যক ধারণা প্রদানের জন্য সাংবিধানিক আইনকে সিলেবাসে অন্তর্ভুক্ত করা আবশ্যক।
(খ) আইনজীবীদের পেশাগত মানোন্নয়নের লক্ষ্যে একটি স্থায়ী প্রশিক্ষণ ইনস্টিটিউট স্থাপন করা আবশ্যক। এর মাধ্যমে, আইনজীবী হিসেবে অন্তর্ভুক্তির পর প্রথম ছয় মাসে আর্থ-সামাজিক ও পেশাগত বাস্তবতার নিরিখে বাধ্যতামূলক প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা করা বাঞ্ছনীয়।
(গ) আইনজীবীদের পেশাগত বিধিমালা Canons of Professional Conduct and Etiquette কে যুগোপযোগী করা প্রয়োজন। উক্ত বিধিমালায় বর্তমানে আইন পেশায় বিদ্যমান শৃঙ্খলাজনিত সমস্যাবলিকে বিবেচনায় নিয়ে নতুন বিধি সংযোজন করতে হবে। এছাড়া এই পেশাগত বিধিমালার যথাযথ প্রয়োগে গুরুত্বারোপ করতে হবে।
(ঘ) বার কাউন্সিল আদেশে আইনজীবীদের পেশাগত অসদাচরণের একটি স্পষ্ট সংজ্ঞা থাকতে হবে। উক্ত সংজ্ঞায় আইনজীবীর পেশাগত দায়িত্ব পালনে ইচ্ছাকৃত বা গুরুতর অবহেলা, অসততা, দুর্নীতি, মক্কেলের স্বার্থের পরিপন্থী কাজ, আইন লংঘনের পরামর্শ, আদালতের প্রতি অসম্মান, সহকর্মীদের প্রতি অসদাচরণ, এবং বার কাউন্সিল কর্তৃক প্রণীত Canons of Professional Conduct and Etiquette এর নির্দেশনা ভঙ্গের বিষয়গুলোকে অন্তর্ভুক্ত করতে হবে।
(ঙ) আইনজীবীদের সংখ্যা এবং দাখিলকৃত অভিযোগের সংখ্যা বিবেচনা করে অবিলম্বে ট্রাইব্যুনালের সংখ্যা বৃদ্ধি করা আবশ্যক। ঢাকায় স্থায়ীভাবে ৫টি ট্রাইব্যুনাল এবং ঢাকার বাইরে প্রতিটি জেলায় একটি করে ট্রাইব্যুনাল স্থাপন করা প্রয়োজন, যাতে আইনজীবী এবং অভিযোগকারী তাদের নিজ জেলার ট্রাইব্যুনালে অভিযোগ দায়ের এবং পরিচালনা করতে পারেন।। ট্রাইব্যুনালের গঠন সংশোধন করা উচিত যাতে এর প্রধান হিসাবে একজন বিচারক দায়িত্বপ্রাপ্ত হন এবং অন্য দুইজন সদস্য আইনজীবীগণের মধ্য থেকে নিযুক্ত হন।
(চ) আদালতে এজলাস কক্ষের পাশাপাশি, সেরেস্তা, নেজারতখানা, রেকর্ডরুম, নকলখানা এবং আদালতের গুরুত্বপূর্ণ জায়গায় যথেষ্ট সংখ্যক সিসিটিভি ক্যামেরা স্থাপন করতে হবে। সিসিটিভি ক্যামেরা স্থাপনের পাশাপাশি সেগুলোর যথাযথ পরিচালনা এবং রক্ষণাবেক্ষণ করতে হবে। এর ফলে নিরাপত্তা প্রক্রিয়ার সাথে সাথে আইনজীবী এবং অন্যান্যদের অসদাচরণের অভিযোগের তদন্তসুষ্ঠু ও কাযকর হবে।
(ছ) আইনজীবীর ফি নির্ধারণের ক্ষেত্রে স্বচ্ছতা এবং একটি লিখিত চুক্তি থাকা আবশ্যক। এই চুক্তি অনুযায়ী প্রতিবার ফি পরিশোধের পর আইনজীবীর মক্কেলকে একটি রসিদ প্রদান করবেন। উক্ত রসিদে ফি পরিশোধের তারিখ, পরিশোধিত ফি’র পরিমাণ, কোন মামলার জন্য ফি পরিশোধ করা হয়েছে তার বিবরণ এবং আইনজীবীর স্বাক্ষর থাকতে হবে।
(জ) আইনজীবীর বিরুদ্ধে মিথ্যা বা হয়রানিমূলক অভিযোগ দায়েরের কারণে আইনজীবীর ব্যক্তিগত এবং পেশাগত ক্ষতির পরিমাণ বিবেচনায় নিয়ে জরিমানার বিধান যুগোপযোগী করা প্রয়োজন।
(ঝ) আইনজীবী সমিতিগুলোকে রাজনৈতিক প্রভাবমুক্ত করে রাজনৈতিক দলগুলোর উদ্দেশ্য বাস্তবায়নের হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহার করা বন্ধ করতে হবে। বিচারিক প্রক্রিয়াকে নিরপেক্ষ, স্বাধীন এবং গতিশীল রাখার জন্য আদালত প্রাঙ্গণে দলীয় রাজনৈতিক কর্মকাণ্ড নিষিদ্ধ করতে হবে।