মোঃ তানভীর আহমেদ : জনাব তারেক রহমানের সকল বক্তব্য সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম [Over-the-Top (OTT) Platform] থেকে সরাতে বাংলাদেশ টেলিযোগাযোগ নিয়ন্ত্রণ কমিশনকে (বিটিআরসি) নির্দেশ দিয়েছিল হাইকোর্টের একটি দ্বৈত বেঞ্চ। অতি সাম্প্রতিককালে আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইবুনাল গণঅভ্যুত্থানে সদ্য ক্ষমতাচ্যুত প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার উস্কানি/বিদ্বেষ মূলক বক্তব্য প্রচারে নিষেধাজ্ঞা এবং সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম থেকে সরাতে বিটিআরসিকে নির্দেশ দিয়েছে। আসুন বিষয় দুইটি নিয়ে আমরা কিছু একাডেমিক আলোচনা করি।
প্রথমত, সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম থেকে কোন কনটেন্ট বা কোন একজন ব্যক্তির বক্তব্য সরানোর কি ধরনের নীতিমালা আছে সেটি দেখি, প্রতিটি সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম যেমন ফেইসবুক, টুইটার, ইউটিউব তাদের নিজস্ব কিছু পলিসি/নিয়ম নীতি দ্বারা নিয়ন্ত্রিত, এইসব পলিসি বজায় রেখে যেসকল কনটেন্ট তৈরি করা হয় সেটাকে বলা হয় ‘কমিউনিটি স্ট্যান্ডার্ড’ কনটেন্ট।
অর্থাৎ কমিউনিটি স্ট্যান্ডার্ড কন্টেন্টের বাইরে কেউ যদি কোন কিছু আপলোড করে তাহলে সেটি স্বয়ংক্রিয়ভাবে বন্ধ হতে পারে অথবা কোন ব্যক্তি রিপোর্ট করলে সেই সকল কনটেন্ট গুলি যাচাই-বাছাই পরে বন্ধ করে দিতে পারে, যদি বন্ধ না করে, তাহলে ভুক্তভোগী সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমের বিরুদ্ধে আইনগত ব্যবস্থাও নিতে পারে।
বড় দাগে বলতে গেলে কোন ঘৃণা বাচক বক্তব্য, সহিংসতা মূলক বক্তব্য, কাউকে উদ্দেশ্য করে গালমন্দ করা বক্তব্য, নগ্নতা মূলক ভিডিও কমিউনিটি স্ট্যান্ডার্ডের বাইরের কনটেন্ট।
এখন আসি জনাব তারেক রহমানের বক্তব্য বন্ধ করা নিয়ে, পত্র-পত্রিকার মাধ্যমে যতটুকু জেনেছি তারেক রহমানের সকল বক্তব্য সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম থেকে সরাতে বলা হয়েছিল এবং সামাজিক মাধ্যম থেকে সরানোর পক্ষে আবেদনকারী মূল যে বক্তব্য ছিল, সেটি হচ্ছে একজন পলাতক দন্ড-প্রাপ্ত আসামির বক্তব্য বন্ধ করতে হবে।
যদিও সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে যে পলিসি বা নিয়ম আছে তার মধ্যে কোথাও বলা নাই পলাতক দন্ড-প্রাপ্ত আসামির বক্তব্য সম্প্রচার করা যাবে না, অর্থাৎ জনাব তারেক রহমান সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে কমিউনিটি স্ট্যান্ডার্ড বজায় রেখেও যদি কোন বক্তব্য দেন, সেটিও বন্ধ করতে হবে।
মজার ব্যাপার হচ্ছে, এখানে সরাসরি বিটিআরসি পক্ষ থেকে আইনজীবী নিয়োগ করে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করেন এবং আদেশ প্রাপ্ত হওয়ার পরে, উভয় পক্ষ অর্থাৎ বাদী এবং বিবাদী জনাব তারেক রহমানের বক্তব্য বন্ধের বিষয় যুক্তি তুলে ধরেন। তার মানে বিটিআরসি কনটেন্ট বন্ধ করার সক্ষমতা প্রশ্নাতীত অর্থাৎ আদালত নির্দেশ দিলে তারা কনটেন্ট বন্ধ করতে সক্ষম।
একটি কথা বলা বাঞ্চনীয়, রাজনৈতিক মামলায় অনেক সময় সরকারি আইনজীবী এবং আসামী পক্ষের আইনজীবীরা উভয় মিডিয়ার সামনে একই ভাবে বিজয় উল্লাস করে, ভুলে যায় তারা প্রতিপক্ষ। মহামান্য হাইকোর্টের আদেশের পরেও জনাব তারেক রহমানের বক্তব্য একটিও বন্ধ হয়েছে বলে প্রতীয়মান হয় নাই, বরং তার বক্তব্যের শ্রোতা কয়েকগুন বৃদ্ধি পায়।
এখন প্রশ্ন হচ্ছে, বিটিআরসি কি সক্ষম বক্তব্য বন্ধ করতে অথবা সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম কি বাধ্য আদালতের নির্দেশ মানতে, বিটিআরসি যেটি পারে সেটি হচ্ছে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমকে অবগত করতে আদালতে নির্দেশনার ব্যাপারে, সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম যদি বন্ধ না করে তাহলে সেই মাধ্যমটি (সামাজিক যোগাযোগ) বন্ধ করে দিতে পারে, কিন্তু বিটিআরসির নিজস্ব কোন ক্ষমতা নাই কনটেন্ট বন্ধ করার, বিটিআরসির এই অক্ষমতার কথা সম্ভবত এই মামলায় এড়িয়ে যায়।
অন্যদিকে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম আদালতে নির্দেশ মানতে বাধ্য, তবে রাজনৈতিক বক্তব্যের ক্ষেত্রে সূক্ষ্মভাবে বিচার-বিশ্লেষণ করে তারা সিদ্ধান্ত নেয়, অনেক ক্ষেত্রে মামলায় প্রতিদ্বন্দ্বিতা করে অথবা কনটেন্টটি সীমাবদ্ধ করে শুধুমাত্র সেই দেশের জন্য।
অতি সাম্প্রতিক কালে আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইবুনাল সদ্য ক্ষমতাচ্যুত প্রধানমন্ত্রী হাসিনার উস্কানি/বিদ্বেষ মূলক বক্তব্য সম্প্রচারের ক্ষেত্রে নিষেধাজ্ঞা আরোপ করেছে এবং বিটিআরসিকে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম থেকে উস্কানি/বিদ্বেষ মূলক বক্তব্য সরানোর জন্য নির্দেশ প্রদান করেছেন।
এক্ষেত্রে আদালত ঢালাওভাবে সকল বক্তব্যের ক্ষেত্রে নির্দেশনা প্রদান করেন নাই অর্থাৎ উস্কানি/বিদ্বেষ মূলক বক্তব্যের উপর নিষেধাজ্ঞা দিয়েছে, সেক্ষেত্রে বিটিআরসি আদালতের নির্দেশনা সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমকে অবগত করলে, তারা যথাযথ ব্যবস্থা নিতে পারেন, যদিও রাজনৈতিক বক্তব্যের ক্ষেত্রে কোন বক্তব্য বন্ধ করা প্রায় অসম্ভব।
আমাদের দেশে এখনো পর্যন্ত সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম (ওটিটি) পরিচালনার ক্ষেত্রে কোন ধরনের কার্যকরী নীতিমালা প্রণয়ন করা হয় নাই, যদিও জনস্বার্থে আমার করা ওটিটি নীতিমালা নিয়ে মহামান্য হাইকোর্টের নির্দেশে বিটিআরসি এবং তথ্য মন্ত্রণালয় দুটি আলাদা নীতিমালা জমা দিয়েছেন, কিন্তু এখনো পর্যন্ত কোনটিই বাস্তবায়ন হয় নাই, এক্ষেত্রে ওটিটি প্লাটফর্মে বিটিআরসি নিজের সীমাবদ্ধতা সম্পর্কে কোর্টকে অবগত না করা অন্যায় বলে আমি মনে করি।
লেখক: আইনজীবী, বাংলাদেশ সুপ্রীম কোর্ট।