সংবিধান সংস্কার কমিশনের প্রতিবেদন: জাতীয় সাংবিধানিক কাউন্সিল গঠনের সুপারিশ ও বিতর্ক
মোঃ ইব্রাহীম খলিলুল্লাহ্

বিচার বিভাগ সংস্কার কমিশনের বিচারপতি নিয়োগ প্রস্তাবনার বিশ্লেষণ

মোঃ ইব্রাহীম খলিলুল্লাহ্‌ : বিগত ৮ ফেব্রুয়ারি ২০২৫ ইং তারিখে বিচার বিভাগ সংস্কার কমিশনের ৩৬৩ পৃষ্ঠার প্রতিবেদন মন্ত্রিপরিষদ বিভাগের ওয়েবসাইটে প্রকাশিত হয়। প্রতিবেদনের তৃতীয় অধ্যায়ে, বিচার বিভাগের স্বাধীনতা নিশ্চিতকরণ ও নির্বাহী বিভাগ থেকে বিচার বিভাগের পৃথকীকরণের লক্ষ্যে, সুপ্রিম কোর্টের বিচারক নিয়োগ ও শৃঙ্খলা সম্পর্কিত একাধিক সংস্কার প্রস্তাব উপস্থাপন করা হয়। প্রস্তাবনাগুলোর মধ্যে অন্যতম হলো, প্রধান বিচারপতি নিয়োগে প্রবীণতাকে মানদণ্ড হিসেবে গ্রহণ করে রাষ্ট্রপতির একক ক্ষমতা হ্রাস, অন্যান্য বিচারপতি নিয়োগের জন্য স্বতন্ত্র কমিশন গঠন এবং অতিরিক্ত বিচারক নিয়োগে ৯ সদস্য বিশিষ্ট নিয়োগ কমিটিকে ক্ষমতা প্রদান।

বিদ্যমান সংবিধানের ৪৮(৩) অনুচ্ছেদ অনুযায়ী, রাষ্ট্রপতি অন্য কারোর পরামর্শ ব্যতিরেকে প্রধান বিচারপতিকে নিয়োগ করতে পারবেন। তবে, অতীতের বিভিন্ন সময়ে প্রধান বিচারপতি নিয়োগে নির্বাহী বিভাগের উল্লেখযোগ্য প্রভাব দেখা গেছে, যা বিচার বিভাগের স্বাধীনতা, কার্যকারিতা এবং নিরপেক্ষতা নিয়ে প্রশ্ন তুলেছে। জ্যেষ্ঠতা না মেনে প্রধান বিচারপতি নিয়োগের ঘটনা এদেশে নতুন নয়।

যেমন ২০২৩ সালের ৩০ এ ডিসেম্বরের আইন, বিচার ও সংসদ বিষয়ক মন্ত্রণালয়ের প্রজ্ঞাপন অনুযায়ী, জ্যেষ্ঠতা না মেনে বিচারপতি মোহাম্মদ ইমান আলীর পরিবর্তে ২৩-তম প্রধান বিচারপতি হিসেবে নিয়োগ দেওয়া হয় বিচারপতি হাসান ফয়েজ সিদ্দিকীকে। আবার, আপিল বিভাগের জ্যেষ্ঠ বিচারপতি মো. রুহুল আমিনকে ডিঙিয়ে ২০০৩ সালের ২৩ জুন বিচারপতি কে এম হাসানকে নিয়োগ দেওয়ার ঘটনাও ঘটে।  এ নিয়ে বিভিন্ন সরকারের শাসনামলে, জ্যেষ্ঠতা উপেক্ষা করে প্রধান বিচারপতি নিয়োগের ঘটনা ঘটেছে মোট নয়বার।

বাংলাদেশের রাজনৈতিক প্রেক্ষাপটে, সরকার-সমর্থিত রাষ্ট্রপতি নিয়োগের প্রবণতা প্রায়শই দেখা যায়, ফলে প্রধান বিচারপতি নিয়োগে সরকারপক্ষের প্রভাবের সম্ভাবনা সবসময়ই বিদ্যমান। বিচার বিভাগ সংস্কার কমিশন এই প্রেক্ষাপটে সংবিধানের ৪৮(৩), ৫২(২) এবং ৯৫(১) অনুচ্ছেদ সংশোধনের প্রস্তাব করেছে, যেখানে রাষ্ট্রপতি আপিল বিভাগের প্রবীণতম বিচারককেই প্রধান বিচারপতি হিসেবে নিয়োগ করবেন। এর ফলে, প্রধান বিচারপতি নিয়োগের প্রক্রিয়ায় রাষ্ট্রপতির স্বেচ্ছাধীন ক্ষমতা বা নির্বাহী বিভাগের প্রভাব থাকবে না বলে মনে করে বিচার বিভাগীয় সংস্কার কমিশন।

আরও পড়ুন: সংবিধান সংস্কার কমিশনের প্রতিবেদন: জাতীয় সাংবিধানিক কাউন্সিল গঠনের সুপারিশ ও বিতর্ক

সংস্কার কমিশনের উপর্যুক্ত প্রস্তাবটি নিঃসন্দেহে বিচার বিভাগের স্বাধীনতা নিশ্চিতকরণে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করবে। তবে কিছু বিষয় এখানে যোগ না করলেই নয়। প্রধান বিচারপতি বিচার বিভাগের নেতৃত্বদানকারী শীর্ষব্যক্তি। নিয়োগের ক্ষেত্রে শুধুমাত্র প্রবীণতাকে মানদণ্ড হিসেবে গ্রহণ করলে বিচারকের দক্ষতা, সততা, এবং পেশাগত উৎকর্ষতার মতো গুরুত্বপূর্ণ গুণাবলীর প্রতি যথাযথ গুরুত্ব প্রদান নাও হতে পারে। আবার, কখনও কখনও প্রবীণতার ক্রম নির্ধারণে বিতর্ক সৃষ্টি হতে পারে, বিশেষ করে যদি বিচারকদের নিয়োগের তারিখ একই হয় বা অন্যান্য জটিলতা থাকে।

আবার, প্রধান বিচারপতি ব্যতীত অন্যান্য বিচারপতি নিয়োগের ক্ষেত্রে সুপারিশ করা হয়েছে একটি স্বাধীন নিয়োগ কমিশন গঠনের। প্রতিবেদন অনুযায়ী এটি “সুপ্রিম কোর্টের বিচারক নিয়োগ কমিশন”নামে অভিহিত হবে যার সদস্য সংখ্যা হবে ৯ জন। উক্ত কমিশনের সদস্য হবেন, বাংলাদেশের প্রধান বিচারপতি, আপিল বিভাগের কর্মে প্রবীণতম দুজন বিচারক, হাই-কোর্ট বিভাগের কর্মে প্রবীণতম দুজন বিচারক, একজন অবসরপ্রাপ্ত প্রধান বিচারপতি, অ্যাটর্নি জেনারেল, সুপ্রিম কোর্ট বার অ্যাসোসিয়েশনের সভাপতি ও একজন আইনজীবী। এই নিয়োগ কমিশন সুপ্রিম কোর্টের অতিরিক্ত বিচারক নিয়োগে এখতিয়ার প্রয়োগ করতে পারবে।

বিদ্যমান সংবিধানের ৯৮ অনুচ্ছেদ অনুযায়ী, রাষ্ট্রপতি প্রয়োজনবোধ করলে অনধিক দুই বছরের জন্য যথাযথ যোগ্যতাসম্পন্ন ব্যক্তিকে অতিরিক্ত বিচারক নিযুক্ত করতে পারেন। কমিশনের রিপোর্ট অনুযায়ী বিগত সময়ে অতিরিক্ত বিচারক নিয়োগে ক্ষমতাসীন রাজনৈতিক দলের প্রতি আনুগত্য বা প্রভাবশালী দলীয় ব্যক্তির পছন্দ-অপছন্দ মুখ্য ভূমিকা পালন করে এসেছে। এমনকি বিগত আওয়ামী লীগ সরকারের দীর্ঘ শাসনামলে আমলে সংবিধান এর ৯৫(১) অনুচ্ছেদের ক্ষমতাবলে রাষ্ট্রপতি হাইকোর্ট এ ৭০ জন এর অধিক অস্থায়ী বিচারক নিয়োগ দেন বলে জানা যায়।

এসকল অস্থায়ী বিচারক নিয়োগের ক্ষেত্রে সবচেয়ে আশঙ্কাজনক বিষয়টি হলো রাষ্ট্রপতি কোন বিচারককে স্থায়ী নিয়োগ-প্রদান করবেন তা অজানা থেকে যায়। প্রায়শই অতিরিক্ত বিচারকদের স্থায়ী নিয়োগ দেওয়া হয় যদি তারা নিয়োগকারী সরকারের এজেন্ডা সফলভাবে বাস্তবায়ন করতে পারে। আবার এক সরকারের আমলে নিয়োগকৃত অস্থায়ী বিচারপতি পরবর্তী সরকারের আমলে স্থায়ী বিচারক হিসেবে নিয়োগপ্রাপ্ত না হওয়ার নজিরও রয়েছে।

আরও পড়ুন: রিট পিটিশন এবং নাগরিকের মৌলিক অধিকার রক্ষায় চ্যালেঞ্জ ও সম্ভাবনা

উদাহরণস্বরূপ, ১৯৯৬ সালে আওয়ামী লীগ সরকারের সময় ডেপুটি অ্যাটর্নি জেনারেল হিসেবে নিয়োগপ্রাপ্ত শামসুদ্দিন চৌধুরী মানিককে পরবর্তীতে হাইকোর্টের অস্থায়ী বিচারক হিসেবে নিয়োগ দেওয়া হয়। তবে, ২০০১ সালে বিএনপি সরকার ক্ষমতায় আসার পর তার নিয়োগ স্থায়ী করা হয়নি। পরে, ২০০৯ সালে আওয়ামী লীগ পুনরায় ক্ষমতায় আসার পরে তিনি পুনর্বহাল হন এবং ২০১৩ সালে আপিল বিভাগে পদোন্নতি পান।

এই ধরনের ঘটনা বিচার বিভাগের নিয়োগ প্রক্রিয়ায় রাজনৈতিক প্রভাবের উপস্থিতিকে নির্দেশ করে, যা বিচার বিভাগের স্বাধীনতা ও নিরপেক্ষতার জন্য হুমকিস্বরূপও বটে। সুতরাং, বিচার বিভাগীয় সংস্কার কমিশন কর্তৃক অতিরিক্ত বিচারক নিয়োগের জন্য একটি স্বতন্ত্র নিয়োগ কমিশন গঠনের প্রস্তাবনা একটি স্বাধীন, নিরপেক্ষ, রাজনৈতিক প্রভাবমুক্ত ও কার্যকর বিচার বিভাগ গঠনে কার্যকর ভূমিকা রাখবে বলে আশা করা যায়।

পাশাপাশি, হাই-কোর্ট বিভাগের স্থায়ী বিচারপতি নিয়োগ ও আপিল বিভাগে বিচারপতি নিয়োগের জন্য যথাক্রমে ৬ ও ৪ সদস্য বিশিষ্ট কমিশন গঠণের সুপারিশ করা হয়।  হাই-কোর্ট বিভাগের স্থায়ী বিচারপতি নিয়োগের ক্ষেত্রে বাংলাদেশের প্রধান বিচারপতি, আপিল বিভাগের কর্মে প্রবীণতম দুজন বিচারক, হাই-কোর্ট বিভাগের কর্মে প্রবীণতম দুজন বিচারক ও একজন অবসরপ্রাপ্ত প্রধান বিচারপতি নিয়ে ০৬ সদস্য বিশিষ্ট কমিশন গঠনের কথা বলা হয়।

আবার, আপিল বিভাগে বিচারপতি নিয়োগের ক্ষেত্রে প্রধান বিচারপতি, আপিল বিভাগের কর্মে প্রবীণতম দুজন বিচারক ও একজন অবসরপ্রাপ্ত প্রধান বিচারপতি  নিয়ে ৪ সদস্য বিশিষ্ট কমিশন গঠনের প্রস্তাবনা দেওয়া হয়। প্রস্তাবনায় আরও বলা হয়, উপযুক্ত প্রক্রিয়া অনুসরণ করে যথাযথ আলোচনার পর সদস্যদের গোপন ব্যালটের মাধ্যমে চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত গ্রহণ করা হবে। প্রস্তাবিত এই প্রক্রিয়াটি নিঃসন্দেহে রাজনৈতিক প্রভাবমুক্ত রেখে বিচারক নিয়োগে উল্লেখযোগ্য ভূমিকা রাখবে। তবে এক্ষেত্রেও দেখা দিতে পারে জটিলতা।

আরও পড়ুন: ৭০ অনুচ্ছেদ যে কারণে সংস্কার করা উচিত

প্রস্তাবনা অনুযায়ী হাই-কোর্ট ও আপিল বিভাগ উভয় ক্ষেত্রেই যথাক্রমে ৬ ও ৪ জন্য সদস্য বিশিষ্ট কমিটি গঠণের কথা বলা হয়। তবে চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত গ্রহণকালে যদি গোপন ব্যালটে সমান সমান পরিমাণে ভোট জমা পরে সেক্ষেত্রে সিদ্ধান্ত গ্রহণের প্রক্রিয়া কেমন হবে তা প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়নি। ফলে চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত গ্রহণের ক্ষেত্রে জটিলতার সম্মুখীন হতে পারে নিয়োগ কমিশন। এক্ষেত্রে জটিলতা নিরসনে সুপ্রিম কোর্টের একজন নিরপেক্ষ সিনিয়র আইনজীবীকে কমিশনের অন্তর্ভুক্ত রাখা যেতে পারে। অথবা প্রধান বিচারপতিকে কাস্টিং ভোট প্রদানের ক্ষমতা প্রদানের মাধ্যমে সমস্যা সমাধান করা যেতে পারে।

পরিশেষে বলা যায়, বিচার বিভাগ সংস্কার কমিশনের প্রস্তাবিত বিচারপতি নিয়োগ ব্যবস্থার পরিবর্তন বিচার বিভাগের স্বাধীনতা ও নিরপেক্ষতা রক্ষায় একটি গুরুত্বপূর্ণ পদক্ষেপ হতে পারে। বিশেষত, প্রবীণতার ভিত্তিতে প্রধান বিচারপতি নিয়োগ এবং একটি স্বতন্ত্র কমিশনের মাধ্যমে বিচারক নির্বাচন রাজনৈতিক প্রভাব হ্রাসে সহায়ক হতে পারে, যদিও শুধুমাত্র প্রবীণতাকে মানদণ্ড হিসেবে গ্রহণ করলে বিচারকের দক্ষতা ও সততা মূল্যায়নের সুযোগ সীমিত হতে পারে।

একইভাবে, গোপন ব্যালটের মাধ্যমে সিদ্ধান্ত গ্রহণের ক্ষেত্রে সমান ভোটপ্রাপ্তির সম্ভাব্য জটিলতা নিরসনের উপায় প্রতিবেদনে স্পষ্ট করা হয়নি, যা বাস্তবায়নের সময় বিবেচনায় নেওয়া প্রয়োজন। সামগ্রিকভাবে, প্রস্তাবিত সংস্কার বাস্তবায়িত হলে এটি বিচার বিভাগের স্বচ্ছতা, নিরপেক্ষতা ও কার্যকারিতা বাড়াতে সাহায্য করতে পারে, তবে এর যথাযথ প্রয়োগ নিশ্চিত করতে সুস্পষ্ট নীতিমালা প্রণয়নের প্রয়োজনীয়তা রয়েছে।

লেখকঃ মোঃ ইব্রাহীম খলিলুল্লাহ্‌, সহ-সভাপতি, বাংলাদেশ ল অ্যালায়েন্স (বিএলএ)। ই-মেইলঃ ibrahimkhalilullah010@gmail.com