হেফাজতে মৃত্যু : বিচারের মুখ দেখা যায় কী
মো: বাঁধন মল্লিক

হেফাজতে মৃত্যু : বিচারের মুখ দেখা যায় কী

মো: বাঁধন মল্লিক : কোন ফৌজদারি অপরাধে অভিযুক্ত ব্যক্তি বিচারের সম্মুখীন হওয়া বা আদালতের মুখোমুখি হওয়ার পূর্বাবস্থা পর্যন্ত সাধারণত পুলিশ হেফাজতে থাকেন। এছাড়া আদালতের আদেশে জিজ্ঞাসাবাদের জন্য অভিযুক্ত ব্যক্তি পুলিশ হেফাজতে থাকতে পারেন। অবার সাজা ভোগ বা মামলা চলার সময় কারা হেফাজতে থাকেন আসামীরা।

এই হেফাজত অবস্থায় জোর করে কোনো শিকারক্তী মূলক জবানবন্দি বা নির্যাতন আইনে অবৈধ। আইনে অবৈধ হলেও এ নির্যাতনের ঘটনা কম নয় এবং তা দিনে দিনে বৃদ্ধিও পাচ্ছে।

দিনের পর দিন হেফাজতে নির্যাতন একধরনের প্রথাগত সমস্যা হিসেবে দাঁড়িয়েছে। বিগত আওয়ামীলীগ সরকারের সময়ে এর প্রবণতা যেমন ছিলো অর্ন্তবর্তী সরকারেরর সময়ও তা একই রকমভাবে চলছে। অন্তবর্তী সরকারের পাঁচ মাসে হেফাজতে মৃত্যুর ঘাটনা ঘটেছে ১৭টি। আইন ও সালিশ কেন্দ্রের তথ্য মতে ২০২৪ সালে ১২ মাসে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর হেফাজতে মোট ২১ জনের মৃত্যুর ঘটে।

বিগত বছরের আলোচিত ২ জুন, ২০২৪ যশোরের অভয়নগরে থানা হেফাজতে এক নারীর মৃত্যুর ঘটনা বেশ আলোড়ন সৃষ্টি করেছে। এছাড়াও পত্রিকা খুললেই দেখা যায় এধরনের সংবাদ।

বিভিন্ন সময়ে গণমাধ্যমে প্রকাশিত কয়েকটি সংবাদ শিরোনাম দেখা যাক:

১. নির্যাতনে ব্যবসায়ীর মৃত্যুর অভিযোগ, পুলিশ বলছে ‘ভয়ে হার্ট অ্যাটাক’: বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম, ৭ নভেম্বর ২০২৩
২. বগুড়ায় ডিবি হেফাজতে মৃত্যু-ময়নাতদন্তে হার্ট অ্যাটাকের তথ্য: আজকের পত্রিকা, ২১ অক্টোবর ২০২৩
৩. পুলিশ হেফাজতে দুদকের সাবেক উপপরিচালকের মৃত্যু, পরিবারের দাবি হত্যা: দৈনিক বাংলা, ৪ অক্টোবর ২০২৩
৪. অভিযানে নিয়ে যাওয়া সাক্ষীর মৃত্যু, পুলিশ বলছে হার্ট অ্যাটাক: ঢাকা পোস্ট, ০৯ ডিসেম্বর ২০২২
৫. হেফাজতে যুবকের মৃত্যু, ‘গণপিটুনিতে হার্ট অ্যাটাক’ দাবি পুলিশের: সারা বাংলা ডটনেট, ২৩ সেপ্টেম্বর ২০২১
৬. থানায় ‘নির্যাতনে’ মৃত্যু, পুলিশের দাবি হার্ট অ্যাটাক: ডেইলি স্টার বাংলা, ৩০ সেপ্টেম্বর ২০১৯

প্রতিটা সংবাদ শিরোনাম দেখলে একটি সাধারণ ব্যাপার লক্ষ্য করা যায়, পরিবারের পক্ষ থেকে দাবি করা হচ্ছে তাদের স্বজন কে হত্যা করা হয়েছে কিন্তু পুলিশ স্বাভাবিক মৃত্যু বলে দাবি করে আসছে।

সাধারণত প্রতিটা ঘটনার ক্ষেত্রে পুলিশ দায় এড়ানোর চেষ্টা করে। যশোরের অভয়নগর উপজেলায় পুলিশ হেফাজতে এক নারীর(আফরোজা বেগম) মৃত্যুর ঘটনায়, পরিবারের পক্ষ থেকে অভিযোগ করা হয় পুলিশ তাকে ইয়াবা দিয়ে আটকের পর টাকা না পেয়ে নির্যাতন চালিয়ে হত্যা করেছে। ফ্যানের সঙ্গে চুল বেঁধে নির্যাতনের অভিযোগও পাওয়া যায়।

কিন্তু পুলিশের পক্ষ থেকে উক্ত ঘটনার পুরোপুরিভাবে অস্বীকার করা হয়, পুলিশ দাবি করে আফরোজা বেগমকে রাত দেড়টার দিকে ৩০টি ইয়াবাসহ আটক করা হয়। রাতে তাকে নারী থানা হাজতে রাখা হয়। তাকে কোনো নির্যাতন করা হয়নি।আফরোজা বেগম সকালে অসুস্থ হয়ে পড়লে তাকে অভয়নগর উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে নেওয়া হয়। অবস্থার অবনতি হলে যশোর জেনারেল হাসপাতালে নেওয়ার পর তার মৃত্যু হয়।

তবে হেফাজতে মৃত্যুর ঘটনায় কর্তৃপক্ষের দায় অস্বীকার করার যে প্রথা ছিলো তা এবার পরিবর্তনের মুখ দেখছে, ৩০ ডিসেম্বর, ২০২৪ বৃহস্পতিবার দিবাগত রাত তিনটার দিকে কুমিল্লার আদর্শ সদর উপজেলা থেকে যৌথ বাহিনী যুবদল নেতা তৌহিদুল ইসলামকে আটক করে।

আন্তঃবাহিনী জনসংযোগ পরিদপ্তর- আইএসপিআর বলেছে, শুক্রবার (৩১ জানুয়ারি) দুপুর সাড়ে ১২টার দিকে তৌহিদুল কুমিল্লা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে মারা যান।

আইএসপিআরও এই ইস্যুতে এক বিবৃতি দিয়েছে। তাদের বিবৃতিতে বলা হয়েছে, এই ঘটনাটি অনাকাঙ্খিত ও দুঃখজনক। ওই সেনাক্যাম্পের ক্যাম্প কমান্ডারকে তাৎক্ষণিকভাবে প্রত্যাহার করা হয়েছে। মৃত্যুর সঠিক কারণ উদঘাটনের জন্য উচ্চপদস্থ তদন্ত কমিটি গঠন করা হয়েছে। তদন্তে দোষী সাব্যস্ত ব্যক্তিদের বিরুদ্ধে সেনা আইন অনুযায়ী যথাযথ আইনানুগ ব্যবস্থা নেয়া হবে।

আমাদের দেশে হেফাজতে হত্যার ঘটনার মতো অপরাধের জন্য পূর্বে তেমন নির্দিষ্ট কোনো আইন ছিলো না। তবে ২০১৩ সালে এই অপরাধকে আমলে এনে সরকার একটি আইন তৈরি করেছে। জাতিসংঘের নির্যাতন বিরোধী সনদে স্বাক্ষরকারী দেশ হিসেবে বাংলাদেশ এই আইনটি প্রণয়ন করে। এটি “নির্যাতন ও হেফাজতে মৃত্যু (নিবারণ) আইন ২০১৩” নামে পরিচিত।

নির্যাতন ও হেফাজতে মৃত্যু (নিবারণ) আইন ২০১৩ অনুযায়ী কেউ নির্যাতনের শিকার হলে আদালতে অভিযোগ করতে পারেন। শারীরিক এবং মানসিক নির্যাতন প্রমাণিত হলে শাস্তি হিসেবে ন্যূনতম ৫ বছরের কারাদণ্ড অথবা ৫০ হাজার টাকা জরিমানার বিধান রয়েছে। এছাড়া নির্যাতনের ফলে মৃত্যু হলে যাবজ্জীবন কারাদণ্ড অথবা অর্থদণ্ড হতে পারে।

বিগত বছরগুলোতে এ ধরনের নির্যাতনের ঘটনার তথ্য পাওয়া গেছে, তথ্যগুলো যতটা না অবাক করে তার চেয়ে বেশি অবাকর বিষয় হচ্ছে মামলা না হওয়া। পুলিশের নির্যাতনের বিরুদ্ধে তেমন একটা মামলা দেখা যায় না। অল্প সংখ্যক যা মামলা আছে এই মামলার মধ্য থেকে বিচার কার্যক্রমেও আছে ধীর গতি, ২০২২ সালের তথ্য মতে ৯ বছরে বিচার হয়েছে মাত্র একটি মামলার।

২০২০ সালে প্রথমবারের মতো এই আইনের মামলায় রায় ঘোষণা করে বাংলাদেশের নিম্ন আদালত। ২০১৪ সালে পুলিশের হেফাজতে জনি নামে এক ব্যক্তির মৃত্যুর ঘটনায় দায়ের করা মামলায় ৫ জন আসামীর মধ্যে তিন জনের যাবজ্জীবন কারাদণ্ড দেয় আদালত। অপর দু্ই জনকে সাত বছরের কারাদণ্ড দেয়া হয়।

যাবজ্জীবন কারাদণ্ড প্রাপ্তদের মধ্যে রয়েছেন পল্লবী থানার তৎকালীন উপ-পরিদর্শক জাহিদুর রহমান জাহিদ, এসআই রশিদুল ইসলাম এবং এএসআই কামরুজ্জামান মিন্টু। যাবজ্জীবন ছাড়াও এক লাখ টাকা করে জরিমানা এবং দুই লাখ টাকা করে ক্ষতিপূরণ দেয়ার আদেশ দেয়া হয়েছে। জরিমানা ও ক্ষতিপূরণের অর্থ দিতে ব্যর্থ হলে আরো ৬ মাস করে কারাদণ্ড ভোগ করতে হবে।

এই মামলায় আইনে সর্বোচ্চ শাস্তি যাবজ্জীবন কারাদন্ড প্রয়োগ করা হয়েছে। এ ধরনের বিচার কার্যক্রম অব্যাহত থাকলে এই অপরাধের সংখ্যা কমে যাবে বলে ধারণা করেন বিশিষ্টজনরা।

লেখক: এসোসিয়েট, ওয়াইপিএফ ল’, রাইটস এন্ড জাস্টিস টিম।