আইনঙ্গনের 'সফল গোলাপ চাষী' মাহমুদুল ইসলাম
আবদুল্লাহ আল আশিক

আইনঙ্গনের ‘সফল গোলাপ চাষী’ মাহমুদুল ইসলাম

আবদুল্লাহ আল আশিক : একজন দক্ষ, বুদ্ধিমান ও চৌকস আইনজীবী হওয়ার অন্যতম শর্ত হচ্ছে আইন অঙ্গণের প্রকৃত নক্ষত্রদের চেনা ও তাঁদের অনুসরণ করা। যুগ যুগ ধরে পৃথিবীতে আইন প্রসিদ্ধ লাভ করেছে অসংখ্য বিজ্ঞ আইন দার্শনিকদের হাত ধরে।

যারা আইনকে পেশা হিসেবে গ্রহণ করেছেন, ব্যবসা হিসেবে নয়। বাংলাদেশের আইন অঙ্গণের তেমনি একজন উজ্জ্বল নক্ষত্র হচ্ছেন সকলের শ্রদ্ধেয় মাহমুদুল ইসলাম। তাঁকে আইন বিশেষজ্ঞগণ বিভিন্ন সময় বিভিন্ন জনের সাথে তুলনা করেছেন।

কেউ বলেছেন, মাহমুদুল ইসলাম হচ্ছেন ইন্ডিয়ার দূর্গাদাস বসু কিংবা সিরভাই, কেউ কেউ বলেছেন তিনি হচ্ছেন স্যার উইলিয়াম ব্ল্যাকস্টোন, আবার কেউ বলেছেন মাহমুদুল ইসলাম হচ্ছেন আমাদের জোসেফ স্টোরি অথবা এ ভি ডাইসি। যে যেভাবে পেরেছেন তাঁর সম্মানার্থে তাঁকে সংজ্ঞায়িত করেছেন।

তবে মাহমুদুল ইসলাম নিজে বলেছেন, আমি আইনের মিস্ত্রি আর সৈয়দ ইশতিয়াক আহমেদ হচ্ছেন আইনের শিল্পী। কিন্তু ব্যারিস্টার রফিক-উল-হক মাহমুদুল ইসলামকে অন্যভাবে উপলব্ধি করেছেন। তিনি বলেছেন, মাহমুদুল ইসলাম হচ্ছেন একজন সফল গোলাপ চাষী।

সত্যিই তাই, মাহমুদুল ইসলাম বাংলাদেশের আইন অঙ্গণে প্রতিনিয়ত গোলাপ চাষ করে গিয়েছেন। যার সুবাসে আজ আইন অঙ্গণ উদ্ভাসিত। যার চাষকৃত গোলাপ এর সুবাস আজ প্রতিটি আইন পিপাসুদের অন্যতম অস্ত্র।

মাহমুদুল ইসলাম জন্মগ্রহণ করেছিলেন রংপুরে। পরবর্তীতে তিনি তাঁর শিক্ষাজীবন শেষ করে রংপুর বারে প্র‍্যাকটিস শুরু করেছিলেন। তাঁর বাবাও ছিলেন একজন আইনজীবী। মাহমুদুল ইসলাম হাইকোর্টে প্র‍্যাকটিস শুরু করেন ১৯৬৭ সালের দিকে। এরপর তিনি ধীরে ধীরে নিজেকে তৈরি করেছেন। বাংলাদেশের সর্বোচ্চ আইন কর্মকর্তা এটর্নি জেনারেল হিসেবে দায়িত্ব পালন করেছেন।

তাঁর প্র‍্যাকটিস জীবনে তিনি অসংখ্য প্রসিদ্ধ আইনজীবীর সান্নিধ্যে এসেছেন, তাঁদের মধ্যে উল্লেখযোগ্য সৈয়দ ইশতিয়াক আহমেদ। যিনি বাংলাদেশের বর্তমান মাননীয় প্রধান বিচারপতি সৈয়দ রেফাত আহমেদ সাহেবের বাবা। তবে তাঁর স্বতন্ত্র পরিচয় তিনিও সাবেক এটর্নি জেনারেল ও সুপ্রীম কোর্ট বারের নির্বাচিত প্রতিনিধি। যাঁকে মাহমুদুল ইসলাম সম্মোধন করতেন আইনের শিল্পী হিসেবে।

মাহমুদুল ইসলাম ও সৈয়দ ইশতিয়াক আহমেদ যৌথ পারফর্মেন্স দেখিয়েছেন বাংলাদেশের বিভিন্ন ঐতিহাসিক মামলায়। তার মধ্যে অনন্য মামলাটি হচ্ছে, সংবিধানের অষ্টম সংশোধনী বাতিল। যেটি স্বৈরাচার জেনারেল হুসেইন মুহাম্মদ এরশাদ সরকারের গদি নড়বড়ে করে দিয়েছে।

এছাড়াও, ড. নুরুল ইসলাম বনাম বাংলাদেশ ৩৩ ডিএলআর (এডি) ১৯৮১ ২০১ মামলাটিতে সরকারের অবৈধ অবাধ ক্ষমতা প্রয়োগ চ্যালেঞ্জ করেন। যেখানে নুরুল ইসলাম জয়লাভ করেন এবং সংবিধানের ২৭ অনুচ্ছেদ ব্যাপক ভাবে ব্যাখ্যা করা হয়।

শাপিং মৎসজীবী সমবায় সমিতি বনাম বাংলাদেশ ৩৯ ডিএলআর ১৯৮৭ (এডি) ৮৭ মামলায় সরকার স্বৈরতান্ত্রিক ভাবে ইজারা বাতিল করে এবং হাইকোর্ট ইজারাটি চুক্তিবদ্ধ বিধায় সংক্ষুব্ধ পক্ষের রিট বাতিল করে দেয়।

কিন্তু আপীল বিভাগ ফাইনাল হেয়ারিং শেষে এধরণের চুক্তির ক্ষেত্রে জুডিশিয়াল রিভিউ করার দ্বার উম্মুক্ত করে। পরবর্তীতে যেটি পাবলিক ইন্টারেস্ট লিটিগেশন মামলা সংক্রান্ত নীতিমালা প্রণয়নের ক্ষেত্রে ব্যাপক ভূমিকা রাখে।

অষ্টম সংশোধনী খ্যাত আনোয়ার হোসেন চৌধুরী বনাম বাংলাদেশ ১৯৮৯ বিএলডি (স্পেশাল) ১ মামলাটিতে সংবিধানের অনুচ্ছেদ ৭, ৮ ও ১৪২ বিস্তার আলোচনার জন্ম দেয়।

তাছাড়া মিনিস্ট্রি অব ফিন্যান্স বনাম মাসদার হোসেন ৫৭ ডিএলআর ১৯৯৯ (এডি) ৮২, আব্দুল মান্নান খান বনাম বাংলাদেশ ৬৪ ডিএলআর ২০১২ (এডি) ১৬৯, বাংলাদেশ জাতীয় মহিলা আইনজীবী সমিতি বনাম হোম মিনিস্ট্রি ৬১ ডিএলআর (এইচসিডি) ৩৭১, বঙ্গবন্ধু হত্যা মামলা সহ অসংখ্য মামলায় তাঁর উপস্থিতি ছিলো অনুকরণীয়।

মাহমুদুল ইসলাম, যিনি আইনের একজন সাধক ও পথিকৃৎ। যিনি নীরবে গোলাপ চাষের মতো চাষ করে গেছেন আইনের সৌন্দর্য। যিনি ছিলেন আইনের জীবন্ত কিংবদন্তি। যাঁর লেখা বই Constitutional Law of Bangladesh তাঁর জীবনদ্দশাতেই ক্ল্যাসিক গ্রন্থ হিসেবে মর্যাদা লাভ করেছিলো।

Constitutional Law of Bangladesh মূলত একটি কমেন্টারি গ্রন্থ। যেটি বাংলাদেশে অদ্যাবধি সংবিধানের উপর সর্বপ্রথম ও সর্বশেষ কমেন্টারি গ্রন্থ। কোন বিষয়ে নিখাদ জ্ঞান ও পাণ্ডিত্য না থাকলে এমন বিশ্লেষনধর্মী গ্রন্থ লেখা প্রায় অসম্ভব। মূলত আইনের ব্যাখ্যা-বিশ্লেষণ প্রদান করে লিখিত বিস্তারিত পান্ডুলিপিকে ইংরেজিতে ট্রিটিজ বা কমেন্টারি বলে অভিহিত করা হয়।

অদ্যাবধি বাংলাদেশের সংবিধান নিয়ে কোনো প্রশ্ন উঠলে, কোনো প্রকার বিশ্লেষণের প্রয়োজন হলে সিংহভাগ বিচারক মাহমুদুল ইসলাম’র Constitutional Law of Bangladesh এর উপর নির্ভর করেন।

তাই বরাবরই মাহমুদুল ইসলামকে তুলনা করা হয় ব্ল্যাকস্টোন, সিরভাই, দূর্গাদাস, স্টোরি বা ডাইসির সাথে। মাহমুদুল ইসলাম তাঁর জীবনদশায় চারটি বই লিখেছেন, তার মধ্যে Constitutional Law of Bangladesh, The Law of Civil Procedure, Interpretation of Statues and Documents প্রকাশিত হয়েছে। এস্টোপেল এর উপর লিখিত বইটি সদ্য প্রকাশিত হয়েছে Law of Estoppel নামে।

মাহমুদুল ইসলাম, যাঁকে বলা হতো, ‘Mobile encyclopedia’। যাঁর কাছে কোন আইনজীবী কোন বিষয়ে পরামর্শের জন্য গেলে নিরাশ হননি। যিনি সর্বদা চেষ্টা করেছেন বাংলাদেশের আইন অঙ্গণে গোলাপের বীজ বপন করতে।

যিনি শিখিয়েছেন Doctrines of legitimate expectation, proportionality, public trust। যিনি শিখিয়েছেন, আইন ব্যবসা নয়, পেশা। তাঁকে না জানলে, তাঁকে নিয়ে চর্চা না করলে আইনজীবী হিসেবে নিজেকে উপস্থাপন করা শক্ত হয়ে উঠবে।

বাংলাদেশের আইন অঙ্গণের পথিকৃৎ মাহমুদুল ইসলাম এর প্রতি রইলো বিনম্র শ্রদ্ধা। তাঁকে অনুকরণ বা অনুসরণ করেই তৈরি হোক আগামীর বিজ্ঞ আইনজীবী।

লেখক : অ্যাডভোকেট, বাংলাদেশ সুপ্রীম কোর্ট।