বাংলাদেশে ছিনতাই: উদ্বেগজনক পরিস্থিতি ও প্রতিরোধমূলক ব্যবস্থা
মো. হায়দার তানভীরুজ্জামান

বাংলাদেশে ছিনতাই: উদ্বেগজনক পরিস্থিতি ও প্রতিরোধমূলক ব্যবস্থা

মো. হায়দার তানভীরুজ্জামান: বর্তমানে বাংলাদেশের বড় শহরগুলোতে বিশেষ করে ঢাকা, চট্টগ্রাম, সিলেট ও খুলনায় ছিনতাইয়ের ঘটনা বাড়ছে, যা সাধারণ মানুষের জন্য একটি বড় উদ্বেগের বিষয় হয়ে দাঁড়িয়েছে। বিভিন্ন কারণে, ছিনতাইকারীরা এখন আরও বেশি সাহসী হয়ে উঠেছে, এবং অপরাধের ধরনও দিন দিন আরও নৃশংস হয়ে উঠছে। বিশেষত জনবহুল এলাকায়, সড়ক বা গণপরিবহন ব্যবস্থায় এসব ঘটনা ঘটছে, যেখানে নিরাপত্তা নিশ্চিত করা বেশ কঠিন হয়ে পড়ে।

ছিনতাইয়ের বৃদ্ধির কারণ

অর্থনৈতিক অস্থিরতা

বাংলাদেশে অর্থনৈতিক পরিস্থিতির অবনতি এবং কর্মসংস্থানের সংকটের কারণে কিছু মানুষের জন্য অপরাধের পথ বেছে নেওয়া সহজ হয়ে উঠছে। অপরাধীরা প্রায়ই প্রয়োজনীয় জিনিসপত্র, যেমন মোবাইল, মানিব্যাগ, ব্যাগ ইত্যাদি ছিনতাই করে তাদের জীবিকা নির্বাহ করতে চায়।

জনসংখ্যার ঘনত্ব

শহরগুলোর মধ্যে জনসংখ্যা বাড়ানোর কারণে সড়ক এবং গণপরিবহনে প্রচণ্ড চাপ তৈরি হয়েছে। এই পরিস্থিতি অপরাধীদের জন্য সুযোগ সৃষ্টি করছে, যেখানে তারা সহজেই লোকজনের অগোচরে তাদের কাজ করতে সক্ষম হয়।

নিরাপত্তা ব্যবস্থার দুর্বলতা

শহরগুলোর অনেক এলাকায় সিসিটিভি ক্যামেরা ও পুলিশি নজরদারি কম। পুলিশি উপস্থিতি ঠিকভাবে না থাকলে, অপরাধীরা সহজেই তাদের কাজ করে চলে যায়।

ছিনতাই থেকে সুরক্ষা নিশ্চিত করার উপায়

জনসচেতনতা বৃদ্ধি

ছিনতাইয়ের হাত থেকে রক্ষা পাওয়ার জন্য প্রথমত, সাধারণ জনগণকে সচেতন করা জরুরি। পকেট থেকে মানিব্যাগ বা মোবাইল বের করার সময় সতর্ক থাকা, নিরাপদ স্থানে এসব জিনিসপত্র রাখা, এবং চলন্ত অবস্থায় ব্যাগ বা পকেট খোলার সময় সাবধানতা অবলম্বন করা উচিত।

গণপরিবহনে নিরাপত্তা ব্যবস্থা বৃদ্ধি

গণপরিবহনগুলিতে সিসিটিভি ক্যামেরা এবং নিরাপত্তা কর্মী নিয়োগ করা হলে ছিনতাইয়ের ঘটনা কম হতে পারে। আরও নিরাপদ পরিবহন ব্যবস্থা তৈরি করলে যাত্রীরা নিশ্চিন্তে চলাচল করতে পারবেন।

পুলিশি তৎপরতা ও ত্বরিত ব্যবস্থা

ছিনতাইয়ের ঘটনার দ্রুত তদন্ত এবং অভিযুক্তদের দ্রুত গ্রেফতার করা অপরাধ প্রতিরোধে সহায়ক হতে পারে। পুলিশের শক্তিশালী অভিযান ও আইনি ব্যবস্থা অপরাধীদের প্রতিহত করতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করতে পারে।

টেকনোলজি এবং ডিজিটাল পেমেন্ট ব্যবস্থার ব্যবহার

ডিজিটাল পেমেন্ট এবং মোবাইল ব্যাংকিং এর ব্যবহার বৃদ্ধি পেলে, নগদ টাকা বা মূল্যবান জিনিসপত্র ছিনতাইয়ের ঝুঁকি কমে আসবে।

নিজেকে ছিনতাইকারীর শিকার হওয়ার ঝুঁকি কমাতে কিছু টিপস-

ছিনতাইয়ের শিকার হওয়ার আশঙ্কা অনেকেরই রয়েছে, তবে কিছু সহজ ও কার্যকরী সতর্কতা অবলম্বন করলে এর ঝুঁকি অনেকটাই কমানো সম্ভব। নিচে কিছু গুরুত্বপূর্ণ টিপস দেওয়া হলো, যা আপনাকে ছিনতাইকারীর শিকার হওয়ার থেকে নিরাপদ রাখতে সহায়ক হতে পারে।

পকেট সাবধানতার প্রতি অতিরিক্ত মনোযোগ না দেওয়া

প্রায়ই “পকেট সাবধান” বা “ব্যাগ সাবধান” ধরনের বাণী শুনলে মানুষ নিজের পকেট বা ব্যাগে হাত দিয়ে নিরাপদে থাকার অনুভূতি পায়। কিন্তু অভিজ্ঞ ছিনতাইকারীরা এই পরিস্থিতিকে তাদের শিকার ঠিক করার একটি সহজ উপায় হিসেবে ব্যবহার করে।

ফুটপাথে চলার সময় সচেতনতা বাড়ান

ফুটপাথ দিয়ে হাটার সময়, যদি সম্ভব হয়, ভবন বা স্থাপনার পাশের দিক পরিহার করে রাস্তার মাঝের দিকে হাটুন। এতে, ভবন বা স্থাপনার পিছনে লুকিয়ে থাকা কেউ আপনার উপর আক্রমণ করতে পারবে না, এবং আক্রান্ত হলে আপনার দৌড় দেওয়া সহজ হবে।

উদ্দেশ্যহীনভাবে চলাফেরা না করা

রাস্তায় চলতে চলতে এমনভাবে চলবেন না যেন দেখায় আপনি উদ্দেশ্যহীনভাবে হাঁটছেন। ছিনতাইকারীরা সাধারণত উদ্দেশ্যহীনভাবে চলাফেরা করা লোককে তাদের টার্গেট হিসেবে বেছে নেয়।

স্থানীয় পোশাক পরুন

কোথাও বেড়াতে গেলে স্থানীয় মানুষের মতো পোশাক পরার চেষ্টা করুন। কারণ, ট্যুরিস্টরা ছিনতাইকারীদের জন্য আকর্ষণীয় লক্ষ্য হয়ে থাকে।

আত্মরক্ষার জন্য ওয়াকিং স্টিক

যদি সম্ভব হয়, হাঁটার সময় একটি ছড়ি (ওয়াকিং স্টিক) সাথে রাখুন, যা আপনার আত্মরক্ষার কাজে আসতে পারে। তবে মনে রাখবেন, আপনার সঙ্গে থাকা কোনো বস্তু সম্পর্কে আপনি নিজে যদি অভিজ্ঞ না হন, তাহলে তা ছিনতাইকারী আপনার বিরুদ্ধেও ব্যবহার করতে পারে।

মার্শাল আর্টের কৌশল শিখুন

আত্মরক্ষার জন্য মার্শাল আর্টের কিছু বেসিক কৌশল শিখে নেওয়া ভাল, যা জরুরি মুহূর্তে কাজে আসতে পারে।

বিপদে পরলে দৌড়ানোই উত্তম

একা থাকলে বিপদে পড়লে মারামারি করার চেয়ে, যদি সম্ভব হয়, দৌড়ানো ভালো। ব্যস্ত এলাকাতে ছিনতাইকারীরা তাদের শিকারকে ধাওয়া করতে চাইবে না, কারণ এতে তাদের পরিচিতি ও জনসাধারণের দৃষ্টি আকর্ষিত হবে।

রাত্রে আলোকিত জায়গা দিয়ে চলাফেরা করুন

রাত্রে হাঁটলে সর্বদা আলোকিত জায়গা দিয়ে চলার চেষ্টা করুন। অন্ধকারে হাঁটার সময় ছিনতাইকারীরা বেশি সক্রিয় থাকে।

নির্জন রাস্তায় সাবধান থাকুন

যদি আপনি কোনো নির্জন রাস্তায় হাঁটছেন এবং কেউ সাহায্য চাইলে, সাবধান থাকুন। এমন ব্যক্তি দুর্ঘটনার কথা বলে আপনাকে ফাঁদে ফেলতে পারে। তাদের জানিয়ে দিন যে আপনি পুলিশকে বিষয়টি অবহিত করেছেন।

টাকা আলাদা আলাদা জায়গায় রাখুন

বেশি টাকা বহন করার সময়, এক জায়গায় সব টাকা না রেখে আলাদা আলাদা কয়েকটি স্থানে রাখুন। যেমন: জুতা, মোজা, প্যান্টের গোপন পকেট বা শার্টের হাতা ভাঁজ করে টাকা রাখা যেতে পারে।

রাত্রে মাস্ক পড়ুন ও সতর্ক থাকুন

রাত্রে যখন বাইরে বের হবেন, মাস্ক পরুন এবং চোখ সর্বদা চারপাশে রাখুন। কারণ, কোনো বাইক দ্রুত ব্রেক করলে আপনি তাড়াতাড়ি দৌড়ানোর সুযোগ পাবেন।

ছিনতাইকারীর শিকার হওয়া থেকে নিরাপদ থাকার জন্য ১০০% কার্যকর কোনো উপায় নেই। তবে, সতর্কতা ও সচেতনতা অবলম্বন করলে এর ঝুঁকি অনেকটাই কমানো সম্ভব। তাই, প্রতিটি পদক্ষেপে সচেতন থাকুন এবং নিজেকে রক্ষা করার জন্য প্রস্তুত থাকুন।

লেখক: আইনজীবী, বাংলাদেশ সুপ্রিম কোর্ট। Email: advocatefindmy@gmail.com