বিচারকদের জামিন দেওয়ার এখতিয়ার নিয়ে অ্যাটর্নি জেনারেলের দেওয়া বক্তব্যকে বিচার বিভাগের ওপর হস্তক্ষেপ উল্লেখে গঠনমূলক সমালোচনা করতে গিয়ে অন্যায্য বদলীর আদেশের শিকার হলেন মোঃ আবু সাঈদ নামে একজন বিচারক।
গত শনিবার যশোরে এক কর্মশালায় অ্যাটর্নি জেনারেল মোঃ আসাদুজ্জামান এর বক্তব্যের সূত্র ধরে “বিচারকদের জামিন দেওয়ার একচ্ছত্র অধিকার নেই” শিরোনামে দেশের বিভিন্ন প্রিন্ট ও ইলেক্ট্রনিক মিডিয়ায় সংবাদ প্রকাশিত হয়।
সিনিয়র সহকারী জজ পদমর্যাদার একজন বিচারক যিনি সহকারী রেজিস্ট্রার হিসেবে হাইকোর্ট বিভাগে প্রেষণে কর্মরত থাকা অবস্থায় বিচারকদের প্রাইভেট ফেসবুক গ্রুপে অ্যাটর্নি জেনারেলের বক্তব্যের সমালোচনা করে একটি পোস্ট দেন।
সেই পোস্ট স্ক্রিনশট আকারে পৌঁছে দেয়া হয় অ্যাটর্নি জেনারেলের নিকট। এরপরই গত বুধবার এই বিচারককে সিনিয়র সহকারী জজ পদমর্যাদায় চাপাইনবাবগঞ্জ জেলা লিগ্যাল এইড অফিসার হিসেবে বদলীর আদেশ আইন মন্ত্রণালয়ের ওয়েবসাইটে প্রকাশ করা হয়।
উল্লেখ্য, পঞ্চগড় জেলা লিগ্যাল এইড অফিসে কর্মরত থাকাকালে সরেজমিনে গ্রামেগঞ্জে গিয়ে বিচার-মীমাংসা করায় ব্যাপক প্রশংসিত হওয়া বিচারক মোঃ আবু সাঈদকে জুলাই-আগস্ট পরবর্তী সময়ে প্রধান বিচারপতির বিশেষ অভিপ্রায়ে সুপ্রীমকোর্ট রেজিস্ট্রিতে বদলী করে আনা হয়। এই বদলীর ফলে সে সময়ে প্রধান বিচারপতির প্রশংসা করেন বিচারকগণ ও বিচার বিভাগ সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিবর্গ।
জুডিসিয়াল সার্ভিস এসোসিয়েশন সূত্রে জানা যায়, বিচারকদের নিজস্ব প্রাইভেট গ্রুপে দেওয়া তার পোস্টে উল্লেখ করেন,
বিজ্ঞ অ্যাটর্নি জেনারেল মহোদয়ের এই বক্তব্য বেআইনী ও অসাংবিধানিক। এ ধরণের বক্তব্য স্বাধীন বিচার বিভাগের ওপর হস্তক্ষেপের সামিল। ফৌজদারি কার্যবিধির ৪৯৬, ৪৯৭, ৪৯৮ অনুযায়ী জামিনের স্বেচ্ছাধীন ক্ষমতা বিচারকগণের। হ্যাঁ, একাডেমিক পয়েন্ট থেকে যদি তিনি বলতে চান যে, ফৌজদারি কার্যবিধির ৪৯৭ ধারা অনুযায়ী মৃত্যুদন্ড ও যাবজ্জীবন দন্ডযোগ্য অপরাধে জামিন দেয়ার ক্ষেত্রে বিচারকদের (ম্যাজিস্ট্রেট টু আপিল বিভাগের বিচারপতি) ক্ষমতা এক্সক্লুসিভ নয়; শর্তসাপেক্ষ! কোন কোন শর্ত পূরণ করলে জামিন দিতে পারবেন তাও ৪৯৭ ধারাতেই বলা আছে। কিন্তু উনার আলোচনা ঠিক একাডেমিক পয়েন্ট থেকে মনে হয়নি। এটা এক ধরণের হস্তক্ষেপের মতো মনে হয়েছে। গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশের সংবিধানের অনুচ্ছেদ ৯৪ (৪) অনুযায়ী প্রধান বিচারপতি এবং সুপ্রীম কোর্টের অন্যান্য বিচারক বিচারকার্য পালনের ক্ষেত্রে স্বাধীন থাকিবেন। একইসাথে সংবিধানের ১১৬ক অনুযায়ী, বিচার-কর্মবিভাগে নিযুক্ত ব্যক্তিগণ এবং ম্যাজিস্ট্রেটগণ বিচারকার্য পালনের ক্ষেত্রে স্বাধীন থাকিবেন। সংবিধানের এই শক্তিশালী অনুচ্ছেদ দুটি প্রত্যেক বিচারকের অন্তরে ধারণ করা সমীচীন।
আরও পড়ুন: বিচারকরা জামিনের সর্বময় ক্ষমতার অধিকারী নন: অ্যাটর্নি জেনারেল
বিচার বিভাগ সংশ্লিষ্টরা বলছেন, সাক্ষ্য আইন, ১৮৭২ এর অধীনে প্রিভিলেজড কমিউনিকেশন (গোপনীয় যোগাযোগ) এর আওতায় বিচারকদের প্রাইভেট গ্রুপে অ্যাটর্নি জেনারেলের বক্তব্য নিয়ে প্রাসঙ্গিকভাবে সংবিধান ও আইনের একাডেমিক আলোচনার একটি পোস্ট দেওয়ার কারণে অন্যায্য বদলীর আদেশ হওয়ায় সারাদেশের বিচারকদের মধ্যে ব্যাপক প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি করেছে।
বদলীর আদেশ প্রচারিত হওয়ার পর থেকেই উক্ত বিচারকের পোস্টের বক্তব্যের সাথে সহমত প্রকাশ করে কয়েকশো বিচারক পুনরায় তা পোস্ট করতে থাকেন। অন্যান্য বিচারকগণ তাদের পোস্টে বিচারক মোঃ আবু সাঈদ এর বদলীর আদেশকে বিচার বিভাগের জন্য অশনি সংকেত মনে করছেন। প্রধান বিচারপতি যেখানে বিচার বিভাগের পরিপূর্ণ স্বাধীনতার জন্য কাজ করে যাচ্ছেন সেখানে এই ধরণের বদলীর আদেশ বিচারকদের ক্ষুব্ধ করেছে মর্মে তারা মনে করছেন।
খোঁজ নিয়ে জানা যায়, আসামিদের ক্ষেত্রে দলমত নির্বিশেষে আইনের যথাযথ প্রয়োগের মাধ্যমে ন্যায়বিচার করতে গিয়ে বিচারক মোঃ আবু সাঈদকে ফ্যাসিস্ট আওয়ামী সরকারের সময় ২০২৩ সালের ডিসেম্বর মাসে নাটোরের সিনিয়র জুডিসিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট পদ থেকে একইভাবে পঞ্চগড়ের লিগ্যাল এইড অফিসার হিসেবে বদলী করা হয়েছিলো।
বদলীর কারণ হিসেবে ২০২৩ সালের ২৮ অক্টোবরের পরে বিএনপি-জামায়াতের নেতাকর্মীদের নামে দেওয়া গায়েবী মামলায় আসামিদের জামিন দেওয়াসহ অজ্ঞাত আসামীদের ঢালাওভাবে গ্রেপ্তার করায় তার আমলী আদালতের এখতিয়ারাধীন দুই থানার ওসিকে তলব করলে এই বিচারককে হয়রানিমূলক বদলী করা হয়। সে সময়ও এই ঘটনায় বিচার বিভাগে তোলপাড় হয়েছিলো। নাটোরের আইনজীবী ও সাধারণ মানুষের মধ্যে ব্যাপক প্রতিক্রিয়া তৈরী হয়েছিলো।
এছাড়াও আওয়ামী ফ্যাসিস্ট আমলে ২০১৮ সালে বাংলাদেশ জুডিসিয়াল সার্ভিস পরীক্ষায় চূড়ান্তভাবে নিয়োগে সুপারিশপ্রাপ্ত হওয়া স্বত্ত্বেও উক্ত বিচারকের জন্মস্থান বগুড়াতে হওয়ায় তাকে বিএনপি-জামায়াত তকমা দিয়ে পুলিশ ভেরিফিকেশনের নামে নিয়োগ দীর্ঘদিন আটকে রাখা হয়।