পরিবেশ সংরক্ষণে বিচার বিভাগ অগ্রণী ভূমিকা পালন করছে: প্রধান বিচারপতি
প্রধান বিচারপতি ড. সৈয়দ রেফাত আহমেদ

পরিবেশ সংরক্ষণে বিচার বিভাগ অগ্রণী ভূমিকা পালন করছে: প্রধান বিচারপতি

প্রধান বিচারপতি ড. সৈয়দ রেফাত আহমেদ বলেছেন, বাংলাদেশের বিচার ব্যবস্থা পরিবেশ সংরক্ষণে দীর্ঘদিন ধরে অগ্রণী ভূমিকা পালন করে আসছে। জনস্বার্থমূলক মামলাগুলো, সংবিধানের বিভিন্ন বিধান, এবং আইনি কাঠামোর কার্যকর প্রয়োগের মাধ্যমে আমরা নদী রক্ষা, বায়ু দূষণ নিয়ন্ত্রণ, এবং পরিবেশ সংরক্ষণ আইন কার্যকর করার ক্ষেত্রে উল্লেখযোগ্য অগ্রগতি অর্জন করেছি।

আজ সোমবার (৩ মার্চ) বিকেলে হোটেল ইন্টারকন্টিনেন্টালের রুপসী বাংলা বলরুমে বাংলাদেশ সুপ্রীম কোর্ট আয়োজিত “পরিবেশগত ন্যায়বিচার সংরক্ষণ: টেকসই ভবিষ্যতের জন্য বিচারকদের ভূমিকা” শীর্ষক সেমিনারে তিনি এ কথা বলেন।

সেমিনারে প্রধান অতিথি হিসেবে উপস্থিত ছিলেন বাংলাদেশের প্রধান বিচারপতি ড. সৈয়দ রেফাত আহমেদ।

বিশেষ অতিথি হিসেবে উপস্থিত ছিলেন ব্রাজিলের ন্যাশনাল হাই কোর্টের (Superior Tribunal de Justicia) প্রধান বিচারপতি আন্তোনিও হারমান বেঞ্জামিন। এছাড়া বাংলাদেশ সুপ্রীম কোর্টের আপীল বিভাগ ও হাইকোর্ট বিভাগের বিচারপতিবৃন্দ, অ্যাটর্নি জেনারেল, সুপ্রীম কোর্ট বারের সভাপতি, ব্রাজিলের রাষ্ট্রদূত এবং সুপ্রীম কোর্ট রেজিস্ট্রির কর্মকর্তাবৃন্দ উপস্থিত ছিলেন।

অনুষ্ঠানে প্রধান বিচারপতি সৈয়দ রেফাত আহমেদের সম্পূর্ণ বক্তব্য নিম্নরূপ –

শুভ অপরাহ্ন – বোয়া তার্দে!

আমার বক্তব্য শুরুর আগে, আমি আমার সম্মানিত বন্ধু এবং খ্যাতনামা বিচারক, ব্রাজিলের প্রধান বিচারপতি আন্তোনিও হারমান বেঞ্জামিনকে আন্তরিক শুভেচ্ছা ও উষ্ণ স্বাগত জানাই। ঢাকা শহরে আপনার উপস্থিতি আমাদের জন্য এক বিরল সম্মান এবং এটি আমাদের পারস্পরিক অঙ্গীকারের প্রতিফলন যে, আমরা পরিবেশগত ন্যায়বিচারের জন্য একত্রে কাজ করে যাচ্ছি। বিশ্বজুড়ে পরিবেশগত আইন ও বিচারব্যবস্থার বিকাশে আপনার অবিরাম প্রচেষ্টা এবং মূল্যবান অবদান আমাদের সকলের জন্য অনুপ্রেরণা। আপনাকে বাংলাদেশে স্বাগত জানানো আমাদের জন্য অত্যন্ত গর্বের বিষয়, এবং এই সেমিনারে আপনার সৌজন্যমূলক উপস্থিতির জন্য আমি বাংলাদেশের বিচার বিভাগের পক্ষ থেকে গভীর কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করছি।

আজকের এই গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ে কথা বলার সুযোগ পেয়ে আমি গর্বিত ও দায়বদ্ধ বোধ করছি। এটি শুধুমাত্র একটি আলোচনার বিষয় নয়, বরং এটি আমাদের, আইনের অভিভাবকদের, এক বিরাট দায়িত্বের স্মারক। আমরা এখানে শুধুমাত্র পরিবেশগত বিপর্যয়ের দর্শক হিসেবে একত্রিত হইনি; বরং আমরা বিচারক হিসেবে ন্যায়বিচারের পাহারাদার, যারা ন্যায়বিচারের মাধ্যমে প্রকৃতি রক্ষার দায়িত্ব বহন করি।

আমার সম্মানিত বন্ধু, বিচারপতি আন্তোনিও হারমান বেঞ্জামিন বহু বছর ধরে বৈশ্বিক পরিবেশগত ন্যায়বিচারের একজন প্রধান কণ্ঠস্বর। আমাদের বন্ধুত্ব প্রথম গড়ে ওঠে ব্রাজিলের পউসাদা সাও বেন্টোতে, যেখানে ১.৮ বিলিয়ন বছরের পুরনো ভূখণ্ডের কেন্দ্রে তিন দিনব্যাপী গভীর আলোচনা শেষে গ্লোবাল জুডিশিয়াল ইনস্টিটিউট ফর দ্য এনভায়রনমেন্ট-এর সংবিধান রচিত হয়। সেই বন্ধন আরও দৃঢ় হয় মিয়ানমারের নেপিদোতে এশিয়া-প্যাসিফিক জুডিশিয়াল কনফারেন্স অন ক্লাইমেট চেঞ্জ অ্যাডজুডিকেশন-এর সময়। আমাদের এই সম্পর্ক প্রমাণ করে যে, আমাদের লক্ষ্য কেবল একটি দেশ বা অঞ্চলভিত্তিক নয়, বরং এটি একটি বৈশ্বিক দায়িত্ব, যা আমাদের একসাথে সামনের দিকে এগিয়ে যেতে অনুপ্রাণিত করে।

বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে পরিবেশগত ন্যায়বিচার

বাংলাদেশ, যা প্রকৃতির অপরিসীম সৌন্দর্যে সমৃদ্ধ, বর্তমানে পরিবেশগত দুর্বলতার এক সন্ধিক্ষণে দাঁড়িয়ে আছে। জলবায়ু পরিবর্তন, বন উজাড়, শিল্প দূষণ এবং অনিয়ন্ত্রিত নগরায়নের ফলে আমরা এক গুরুতর সংকটের সম্মুখীন। বাংলাদেশের বিচার ব্যবস্থা পরিবেশ সংরক্ষণে দীর্ঘদিন ধরে অগ্রণী ভূমিকা পালন করে আসছে। জনস্বার্থমূলক মামলাগুলো, সংবিধানের বিভিন্ন বিধান, এবং আইনি কাঠামোর কার্যকর প্রয়োগের মাধ্যমে আমরা নদী রক্ষা, বায়ু দূষণ নিয়ন্ত্রণ, এবং পরিবেশ সংরক্ষণ আইন কার্যকর করার ক্ষেত্রে উল্লেখযোগ্য অগ্রগতি অর্জন করেছি।

আমাদের এই সেমিনারে বিচারপতি আন্তোনিও হারমান বেঞ্জামিন মডেল ফরেস্ট অ্যাক্ট ইনিশিয়েটিভ (MoFAI) নিয়ে আলোচনা করতে এসেছেন, যা একটি সুসংগঠিত ও অগ্রগামী আইনি কাঠামো তৈরির উদ্যোগ। এই প্রকল্পটি বন সংরক্ষণ, পুনরুদ্ধার এবং টেকসই ব্যবস্থাপনার জন্য আধুনিক আইনগত কাঠামো তৈরি করতে চায়।

সুন্দরবন সংরক্ষণের গুরুত্ব

বাংলাদেশের প্রাকৃতিক বিস্ময়গুলোর মধ্যে সুন্দরবন এক অমূল্য সম্পদ। এটি বিশ্বের বৃহত্তম ম্যানগ্রোভ বন, যেখানে রয়েল বেঙ্গল টাইগার, বিরল ইরাবতী ডলফিন, এবং অসংখ্য পাখি, সরীসৃপ ও সামুদ্রিক প্রাণীর বসবাস। সুন্দরবন আমাদের উপকূলীয় জনগোষ্ঠীকে ঘূর্ণিঝড় ও জলোচ্ছ্বাস থেকে রক্ষা করে, পাশাপাশি কার্বন সংরক্ষণ এবং জলবায়ু নিয়ন্ত্রণে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে।

কিন্তু জলবায়ু পরিবর্তনের ফলে সমুদ্রপৃষ্ঠের উচ্চতা বৃদ্ধি, লবণাক্ততা বৃদ্ধি, শিল্পায়নের বিস্তার ও বন উজাড়ের কারণে সুন্দরবন আজ বিপন্ন। এটি সংরক্ষণ করা শুধু পরিবেশগত দায়বদ্ধতা নয়, বরং এটি আমাদের ভবিষ্যৎ নিরাপত্তার প্রশ্ন। তাই আমাদের কঠোর আইনি কাঠামো, টেকসই নীতি এবং দৃঢ় বিচারিক নজরদারির মাধ্যমে সুন্দরবন রক্ষায় অবিচল থাকতে হবে।

বিচারিক সংস্কার ও ন্যায়বিচারের ভবিষ্যৎ

আমি যখন ২০২৪ সালের ১১ই আগস্ট প্রধান বিচারপতি হিসেবে দায়িত্ব গ্রহণ করি, তখন বাংলাদেশের জনগণের প্রত্যাশা ছিল একটি স্বাধীন, কার্যকর ও স্বচ্ছ বিচারব্যবস্থা। তাদের সেই প্রত্যাশাকে সম্মান জানিয়ে, আমি ২১ সেপ্টেম্বর ২০২৪-এ একটি রোডম্যাপ ঘোষণা করি, যেখানে বিচার বিভাগের স্বাধীনতা পুনঃপ্রতিষ্ঠা, বিচারকদের জন্য আর্থিক ও শারীরিক নিরাপত্তা নিশ্চিতকরণ, এবং বিচারিক জবাবদিহিতা সংক্রান্ত সংস্কার অন্তর্ভুক্ত ছিল।

বাংলাদেশের সংবিধানের ১১৬ অনুচ্ছেদ বিচার বিভাগের স্বাধীনতার একটি মূল ভিত্তি ছিল। কিন্তু সংবিধানের চতুর্থ সংশোধনীতে এটি পরিবর্তিত হয়ে নির্বাহী বিভাগের নিয়ন্ত্রণে চলে যায়, যা বিচার বিভাগের স্বাধীনতা হ্রাস করে। আমি এই অনুচ্ছেদের পূর্বাবস্থায় পুনঃপ্রতিষ্ঠার মাধ্যমে বিচার বিভাগের নিরপেক্ষতা ও স্বাধীনতা পুনরুদ্ধার করতে চাই।

আমি এখন এই সংস্কার এজেন্ডাকে সরাসরি জেলা আদালত পর্যন্ত নিয়ে যাচ্ছি, যাতে দেশের প্রতিটি স্তরের বিচারক ও আইনজীবীদের সাথে মতবিনিময় করে বাস্তবসম্মত সমাধান খুঁজে বের করা যায়।

উপসংহার

বিচার বিভাগের সংস্কার এবং পরিবেশগত ন্যায়বিচার—এই উভয় ক্ষেত্রেই আমাদের প্রতিশ্রুতি শুধু আমাদের নিজস্ব বিচারব্যবস্থার মধ্যে সীমাবদ্ধ নয়, এটি একটি বৈশ্বিক দায়িত্ব। বিচার বিভাগকে ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠার পাশাপাশি পরিবেশ সংরক্ষণের ক্ষেত্রেও সাহসী ভূমিকা রাখতে হবে।

আমার বন্ধু বিচারপতি আন্তোনিও হারমান বেঞ্জামিন এবং উপস্থিত সকল সম্মানিত অতিথিদের প্রতি আমার আহ্বান—আমরা যেন এমন এক বিচারব্যবস্থা গড়ে তুলি, যেখানে আইনের হাত কেবল শাস্তি প্রদানের জন্য নয়, বরং প্রকৃতি পুনরুদ্ধারের জন্যও ব্যবহৃত হয়।

ধন্যবাদ।