কতিপয় ক্লার্ক নামধারী আইন অঙ্গণের দালাল
আবদুল্লাহ আল আশিক

কতিপয় ক্লার্ক নামধারী আইন অঙ্গনের দালাল

আবদুল্লাহ আল আশিক: ক্লার্ক/মুহুরি হচ্ছে একজন আইনজীবীর সহযোগী বা পিওন। একজন আইনজীবী ক্লার্ক হিসেবে এক বা একাধিক ব্যক্তিতে নিয়োগ দিতে পারেন। যাদের কাজ হচ্ছে একজন বিজ্ঞ আইনজীবীর নির্দেশনা পালন করা এবং মামলা সংক্রান্ত সমস্ত বিষয় সম্পর্কে আইনজীবীকে সহযোগিতা করা।

অথচ ইদানীং দেখা যাচ্ছে আইনজীবীদের একাংশ যেনো ক্লার্কদের সহযোগী হিসেবে কাজ করতে হুমড়ি খেয়ে পড়ছেন। আইনজীবী ও ক্লার্কদের মধ্যকার যে মোটা দাগটি এতদিন বিরাজমান ছিলো সেটি ক্রমশ হালকা হয়ে উঠছে। ক্লার্ক প্রফেশনে যারা নিয়োজিত আছেন তারা আর আইনজীবীদের স্যার সম্বোধন করতে চান না।

এখন তারা আইনজীবীদের ভাই, মামা অথবা নাম ধরেই ডাকতে স্বাচ্ছন্দ্য বোধ করেন। এটি বর্তমান সময়ে আইন জগতে ডি ফ্যাক্টো (de facto) বিষয় হয়ে দাঁড়িয়েছে। বিষয়টি এমন, অবৈধকেই বৈধ হিসেবে স্বীকৃতি দিতে চাচ্ছে। যেটি অদূর ভবিষ্যতে আইন অঙ্গণ তথাপি আইনজীবীদের জন্য হতাশাজনক একটি বিষয়।

ক্লার্কদের দৌরাত্ম্যে আইনজীবীরা প্রায় দিশেহারা। যে ব্যক্তি একজন আইনজীবীর কাছ থেকে পারমিশন নিয়ে কয়েকটি ধাপ অতিক্রম করে ক্লার্ক হিসেবে আত্মপ্রকাশ করলেন, তিনিই আবার সুকৌশলে সেই আইনজীবীর প্রফেশনাল দায়বদ্ধতা নষ্ট করে দিলেন। বিষয়টি ঠিক এইরকম, কোকিল কাকের বাসায় ডিম পাড়লো, বাচ্চা ফোটালো এবং শেষমেশ কোকিলের বাচ্চা কাকের বাচ্চাটিকে লাথি মেরে বাসা থেকে ফেলো দিলো।

অবশ্যই ক্লার্ক/মুহুরি একটি প্রফেশন। এই প্রফেশনের উপর ভর করে ক্লার্ক এসোসিয়েশন গড়ে উঠেছে। প্রতি বছর নির্বাচনের মাধ্যমে তাদের প্রতিনিধি নির্বাচিত হয়। বাংলাদেশে এখনো এমন অসংখ্য মুহুরি বা ক্লার্ক জীবিত আছেন যারা এই প্রফেশনটি অত্যন্ত সম্মানের সঙ্গে পালন করে যাচ্ছেন। যিনি একজন আইনজীবীর দিকনির্দেশনা মতে কাজ করে থাকেন। যার জন্য তিনি পারিশ্রমিক পান।

কিন্তু শুভঙ্করের ফাঁকি তখনই উঁকি দেয় যখন একজন ব্যক্তি ক্লার্ক হিসেবে কাজ করার অনুমতি নেয়ার পর ধীরে ধীরে টাউট হিসেবে নিজেকে আত্মপ্রকাশ করেন। অর্থাৎ কোনো আইনজীবীর অধীনস্থ না থেকে মামলা/মোকদ্দমা গ্রহণ করে নিরীহ ক্লাইন্টদের কাছ থেকে মোটা অংকের টাকা হাতিয়ে নেন। পরবর্তীতে দেখা যায়, নিরীহ মক্কেল একজন টাউট বা ভুল ব্যক্তির ভুল পরামর্শের কারণে অনাকাঙ্ক্ষিত ঘটনার সম্মুখীন হন। আইনের ভাষায় যা Legal Malpractice হিসেবে পরিচিত।

বাংলাদেশ সুপ্রীম কোর্ট সহ বিভিন্ন জেলা আইনজীবী সমিতিতে এইরকম নজীর প্রতিনিয়ত ঘটছে। যদি সুপ্রীম কোর্টের কথা বলি, দেখা যাবে এমন অনেক ক্লার্ক আছেন যারা গাড়ি নিয়ে কোর্ট প্রাঙ্গণে প্রবেশ করছেন। ঢাকা সহ বিভিন্ন জায়গায় যাদের বাড়ি আছে। ঐসকল ক্লার্কবৃন্দ ক্লার্ক হিসেবে মুখোশ পরে থাকেন কিন্তু তারা প্রকৃত পক্ষে একজন টাউট।

ওরা বিভিন্ন ভাবে মামলা সংগ্রহ করে মোটা অংকের টাকা নিরীহ মক্কেলদের কাছ থেকে হাতিয়ে নিচ্ছে। তারা আইনজীবী ও মক্কেলদের মাঝে সর্বদা একজন মিডেলম্যান বা দালাল হিসেবে কাজ করে আইন অঙ্গণের পবিত্রতা, সম্মান ও গৌরব নষ্ট করে দিচ্ছে। গুটিকয়েক আইনজীবী সাময়িক সুবিধা লাভের আশায় ওইসব ক্লার্ক নামধারী দালালদের প্রতিনিয়ত শেল্টার দিয়ে যাচ্ছেন।

বাংলাদেশ সুপ্রীম কোর্ট আইনজীবী সমিতি এই বিষয়ে এখনই সজাগ না হলে অদূর ভবিষ্যতে হয়তো সুপ্রীম কোর্টের আইন পেশা মারাত্মক হুমকির মুখোমুখি হবে। তাছাড়া দেশের বিভিন্ন জেলা বার আইনজীবী সমিতি প্রতিনিয়ত মুহুরি নির্ভর হয়ে পড়ছে। যেখানে একজন বিচার প্রার্থী ব্যক্তি সর্বপ্রথম একজন আইনজীবীর দারস্থ হবেন তা না হয়ে তিনি একজন মুহুরির কাছে ছুটছেন।

এই সুযোগে আইনজীবীদের বিরুদ্ধে নানান রকম প্রপাগাণ্ডা ছড়িয়ে দিচ্ছে তারা। এই ষড়যন্ত্র সুনিপুণ ভাবেই করে চলছে কতিপয় ক্লার্ক নামধারী কিছু দালাল শ্রেণীর ব্যক্তি। এইভাবে চলতে থাকলে ভবিষ্যতে আইনজীবীদের আইন অঙ্গণে টিকে থাকতে হলে, ‘ক্লার্ক ডে, বেস্ট ক্লার্ক এওয়ার্ড, মুহুরিদের খানাপিনা অথবা দালাল সংঘ’ ইত্যাদি কথিত নানান প্রথা চালু করা ছাড়া গতি থাকবে না।

ইদানীং আরেকটি বিষয় লক্ষনীয়। কিছু সংখ্যক ক্লার্ক বিভিন্ন জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ে দুই বছরের এলএলবি পাস কোর্সে ভর্তি হয়ে কালো কোর্ট পরে নিজেকে আইনজীবী হিসেবে পরিচয় দিচ্ছেন। কোর্ট প্রাঙ্গণে ঘুরে বেড়াচ্ছেন। অনেকেই চেম্বার খুলে বসতে উদ্ভুদ্ধ হচ্ছেন।

ক্লার্ক/মুহুরিদের সুনির্দিষ্ট আচারণ বিধি না থাকায় এবং ক্লার্ক হিসেবে নিয়োগের পর তাদের প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা না থাকায় প্রতিনিয়ত ঘটছে এইরকম অনাকাঙ্ক্ষিত ঘটনা। আমি মনে করি ক্লার্ক নিয়োগ ও ক্লার্ক পরিচালনার ক্ষেত্রে নিম্নোক্ত নিয়ম গুলো অনতিবিলম্বে প্রয়োগ করে অনেকাংশে আইনের গৌরব ও পবিত্রতা ফিরিয়ে আনা সম্ভবঃ

১. একজন ক্লার্ক/মুহুরি প্রতি বছর তার সম্পত্তির হিসেব বিবরণী লিখিত আকারে তার নিয়োগকারী আইনজীবীকে অবহিত করবেন। পরবর্তী উক্ত আইনজীবী তার স্ব স্ব বারে তা সত্যায়িত সাপেক্ষে প্রেরণ করবেন। প্রতি জেলা বার গুলো নিবন্ধিত ক্লার্কদের একটি হিসেব প্রতি বছর বার কাউন্সিলে প্রদান করবেন।

২. কোনো ব্যক্তি ক্লার্ক হিসেবে একবার নিবন্ধিত হওয়ার পর উক্ত নিবন্ধন বাতিল করতঃ দুই বছর অতিবাহিত না হওয়া পর্যন্ত কোন প্রকার ইনটিমেশন ফরম জমা দিতে পারবে না এবং আইন পড়াকালীন অবস্থায় কোর্ট প্রাঙ্গণে ক্লার্ক হিসেবে কাজ করতে পারবেন না।

৩. কোনো ক্লার্ক ব্যক্তিগত ভাবে কোন মামলা গ্রহণ করলে তাকে প্রথম কারণ দর্শানো নোটিশ এবং পরবর্তীতে একই কাজ পুনরাবৃত্তি হলে নিবন্ধন বাতিল করতঃ টাউট উপাধিতে ভূষিত করতে হবে।

৪. ক্লার্কদের জন্য উপযুক্ত প্রশিক্ষণ ব্যবস্থা চালু করতে হবে। প্রত্যেক ক্লার্ক আইনজীবীদের সঙ্গে প্রফেশনাল ব্যবহার করিতে বাধ্য থাকিবে।

৫. নির্ধারিত ড্রেস, আইডি কার্ড ব্যতীত কোন ক্লার্ক কোর্ট প্রাঙ্গণে ঘোরাঘুরি করিতে পারিবে না।

৬. যদি কোনো ক্লার্ক তার নিয়োগদাতা আইনজীবী ব্যতীত অন্য আইনজীবী দ্বারা মামলা পরিচালনা করেন তাহলে তাকে প্রথমে কারণ দর্শানো নোটিশ এবং পরবর্তীতে যথাযথ ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে।

৭. ক্লার্ক কোনো আইনজীবীর কাছে মামলা নিয়ে আসলে অবশ্যই ঐ বিচার প্রার্থী ব্যক্তিকে আইনজীবীর সামনে উপস্থাপন করতে হবে।

আমাদের মনে রাখতে হবে, আইনজীবী ও মুহুরি দুটোই আইন প্রফেশনের অংশ। এই দুই ব্যক্তির সঙ্গে সম্পর্কটা মামা, খালু বা ভাইয়ের নয়, এই সম্পর্কটা হচ্ছে প্রফেশনাল। এই সম্পর্কটা হচ্ছে, স্যার ও পিওনের। আর পিওন যদি মুনিবকে পরিচালনা করতে শুরু করে আমাদের ধরেই নিতে হবে সেই প্রফেশন অদূর ভবিষ্যতে ধ্বংসের দ্বারপ্রান্তে পৌঁছে যাচ্ছে।

সুতরাং একজন ক্লার্ক তার অবস্থান থেকে যতটুকু সম্মান পাওয়ার যোগ্য তাকে ততটুকু সম্মান দিয়েই আইন পেশা এগিয়ে নিয়ে যেতে হবে। সঠিক পরিকল্পনা ও ব্যবস্থাপনাই পারে আগামীর আইন অঙ্গণকে অশনিসংকেত থেকে রক্ষা করতে।

লেখক : আবদুল্লাহ আল আশিক; অ্যাডভোকেট, বাংলাদেশ সুপ্রীম কোর্ট।