রবিউল আলম : কুষ্টিয়ার ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়ে (ইবি) শেখ পরিবারের নাম থাকা চার আবাসিক হল ও এক স্থাপনার নাম পরিবর্তন করেছে বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন। গত বুধবার (৫ মার্চ) দুপুরে বিশ্ববিদ্যালয়ের ভারপ্রাপ্ত রেজিস্ট্রার স্বাক্ষরিত এক প্রজ্ঞাপনে এই তথ্য নিশ্চিত করা হয়। তবে “জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান” হলের নাম পরিবর্তন করে “শাহ আজিজুর রহমান” হলের নামকরণের সিদ্ধান্তে সমালোচনার ঝড় তুলেছেন শিক্ষার্থীরা।
শিক্ষার্থীদের ভাষ্য, শাহ আজিজুর রহমান ছিলেন একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধের বিরোধী। যুদ্ধের সময় তিনি তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানের আবদুল মোতালেব মালিকের নেতৃত্বাধীন মন্ত্রিসভার সদস্য হন এবং রাজস্বমন্ত্রী হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন। এছাড়াও তিনি পাকিস্তান কর্তৃক জাতিসংঘে প্রেরিত প্রতিনিধিদলের অন্যতম সদস্য ছিলেন। তিনি জাতিসংঘে পাকিস্তান সেনাবাহিনী অপারেশন সার্চলাইটের মাধ্যমে বাংলাদেশে যে গণহত্যা চালিয়েছে তা অস্বীকার করেন।
বিশ্ববিদ্যালয় সূত্রে জানা যায়, ২০০০ সালে ৩ কোটি ৯৪ লাখ টাকা ব্যয়ে ইসলামী উন্নয়ন ব্যাংকের অর্থায়নে ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয় ‘শিক্ষক-শিক্ষার্থী সাংস্কৃতিক কেন্দ্র’ (টিএসসিসি) নামে একটি অডিটোরিয়াম নির্মাণ করা হয়। পরে ২০০১ সালের নির্বাচনে বিএনপি সরকার ক্ষমতায় এসে ‘শাহ আজিজুর রহমান মিলনায়তন’ নামকরণ করেন।
এরপর ২০০৯ সালে আওয়ামী লীগ সরকার ক্ষামতায় আসার পর ২০১২ সালের দিকে স্বাধীনতাবিরোধীদের নামে স্থাপনার নামকরণ প্রত্যাহারের নির্দেশনা চেয়ে হাইকোর্টে একটি রিট করেন ইতিহাসবিদ অধ্যাপক মুনতাসীর মামুন ও শাহরিয়ার কবির। ওই রিটের পরিপ্রেক্ষিতে একই ২০১৩ সালের ১৪ মে ওই স্থাপনা থেকে নাম প্রত্যাহারের আদেশ দেন হাইকোর্ট।
এরপর থেকে ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়ের মিলনায়তনের নাম ‘শাহ আজিজুর রহমান মিলনায়তন’ মুছে ফেলা হয়। তৎকালীন উপাচার্য অধ্যাপক ড. রশিদ আসকারীর সভাপতিত্বে বিশ্ববিদ্যালয়ের ২৩২তম সিন্ডিকেটে কেন্দ্রীয় মিলনায়তনের নাম দেওয়া হয় ‘বীরশ্রেষ্ঠ হামিদুর রহমান মিলনায়তন’।
সেই শাহ আজিজুর রহমানের নামে গত ২৮ ফেব্রুয়ারি (২০২৫) বিশ্ববিদ্যালয়ের বর্তমান উপাচার্য অধ্যাপক ড. নকীব মোহাম্মদ নসরুল্লাহ’র নেতৃত্বে অনুষ্ঠিত ২৬৭ তম সিন্ডিকেট সভায় হলের নামকরণের সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়।
আরও পড়ুন: সব স্থাপনা থেকে স্বাধীনতাবিরোধীদের নাম মুছে ফেলার নির্দেশ
এরপর থেকে সমালোচনার জন্ম নেয় ক্যাম্পাসজুড়ে। ছড়িয়ে পড়ে জাতীয় পর্যায়ে। পূর্বের হাইকোর্ট কর্তৃক অপসারিত ব্যক্তির নামে আবাসিক হলের নামকরণ নতুন করে হাইকোর্ট ও সিন্ডিকেট সভাকে প্রশ্নবিদ্ধ করে কি-না প্রশ্ন সচেতন মহলের।
এদিকে গত বুধবার (৫ মার্চ) বাংলাদেশ ছাত্র ইউনিয়ন, ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয় সংসদ স্বাধীনতা বিরোধীর নামে হলের নামকরণ করায় তীব্র নিন্দা জানিয়েছে। অতিদ্রুত সিদ্ধান্ত পরিবর্তনেরও আহ্বান জানান সংগঠনটি।
পাশাপাশি ক্যাম্পাসের জুলাই বিপ্লব ধারণ করা সংগঠন জাস্টিস ফর জুলাই নামক সংগঠনও নিন্দা ও প্রতিবাদ জানিয়েছেন।
এক যৌথ সংবাদ বিবৃতিতে ইবি ছাত্র ইউনিয়নের সভাপতি মাহমুদুল হাসান ও সাধারণ সম্পাদক নূর আলম বলেন, “শাহ আজিজুর রহমানের মতো একজন্য চিহ্নিত যুদ্ধাপরাধীর নামে আবাসিক হলের নামকরণ জাতির জন্য এক কলঙ্কজন সিদ্ধান্ত। একই সাথে জুলাই গণঅভ্যুত্থানের চেতনা পরিপন্থীও। আওয়ামী ফ্যাসিবাদের হাতে লুট হয়ে যাওয়া মুক্তিযুদ্ধের সাম্য, মানবিক মর্যাদা ও সামাজিক ন্যায় বিচারের বৈষম্যহীন দেশ গড়ার শপথই ছিল জুলাই অভ্যুত্থানের স্পিরিট। সেখানে মুক্তিযুদ্ধের বিরোধিতাকারী শাহ আজিজুর রহমানের নামে আবাসিক হলের নামকরণের মধ্য দিয়ে ইবি প্রশাসন মুক্তিযুদ্ধ ও জুলাই গণ-অভ্যুত্থানের বিরুদ্ধে তাদের অবস্থান স্পষ্ট করেছে বলে আমরা মনে করি।”
ইবি প্রশাসনের কাছে রাজাকারের নাম পরিবর্তন ও মাওলানা ভাসানীর নামে আবাসিক হলের নামকরণের আহ্বান জানান ছাত্র সংগঠনটি।
বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের ইবি শাখা সমন্বয়ক এস এম সুইট বলেন, “শেখ পরিবারের নামে থাকা হল ও স্থাপনা গুলোর নাম পরিবর্তনে আমরা সোচ্চার ছিলাম। ২৩ প্রস্তাবনা জানিয়ে আসছিলাম। তবে শাহ আজিজুর রহমানের নাম আমাদের প্রস্তাবনায় ছিল না। হলের নাম যে এই নামে নামকরণ করা হচ্ছে সে বিষয়ে আমরা বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন অবগতও ছিলাম না। একাত্তরের চেতনাকে কেউ বিক্রি করে খাবে সেটা নতুন বাংলাদেশে চাই না।”