আডভোকেট শাহানূর ইসলাম সৈকত: দেশে ধর্ষণের ঘটনা আশঙ্কাজনকভাবে বেড়ে যাওয়ার প্রেক্ষিতে সরকার ধর্ষণ মামলায় জামিনের সুযোগ পুরোপুরি বন্ধের সিদ্ধান্ত নিয়েছে। আইন উপদেষ্টা ড. আসিফ নজরুল জানিয়েছেন, ধর্ষণের মামলা হলে আসামিকে কোনো অবস্থাতেই জামিন দেওয়া যাবে না এবং ৯০ দিনের মধ্যে বিচার শেষ করতেই হবে। পাশাপাশি, ১৫ দিনের মধ্যে তদন্ত প্রতিবেদন দাখিলের বাধ্যবাধকতা থাকবে। এটি নিঃসন্দেহে একটি সাহসী সিদ্ধান্ত, তবে এর বাস্তবায়ন নিয়ে কিছু মৌলিক প্রশ্ন থেকেই যায়।
কঠোর আইনের প্রয়োজনীয়তা
ধর্ষণ একটি গুরুতর অপরাধ, এবং বিচারহীনতা এর বিস্তারকে উৎসাহিত করে। অপরাধীরা যদি জানে যে তারা সহজেই আইনের ফাঁক গলে বেরিয়ে আসতে পারবে, তবে অপরাধপ্রবণতা বাড়বে। সুতরাং, ধর্ষণের মতো অপরাধের ক্ষেত্রে কঠোরতা প্রয়োজন। জামিনের সুযোগ না থাকলে অপরাধীরা ভয় পাবে, এবং ন্যায়বিচারের পথ সুগম হবে।
মিথ্যা মামলার আশঙ্কা ও মৌলিক অধিকারের প্রশ্ন
তবে, এই সিদ্ধান্তের ফলে কোনো নিরপরাধ ব্যক্তি যদি মিথ্যা মামলার শিকার হন, তার কী হবে? আমাদের বিচারব্যবস্থায় মিথ্যা মামলা নতুন কোনো বিষয় নয়। ব্যক্তিগত শত্রুতা, প্রতিশোধ বা রাজনৈতিক উদ্দেশ্যপ্রণোদিতভাবে অনেক সময় নিরপরাধ ব্যক্তিদের বিরুদ্ধে ধর্ষণের অভিযোগ আনা হতে পারে। জামিনের সুযোগ না থাকলে, একজন নিরপরাধ মানুষও দীর্ঘদিন ধরে কারাগারে আটকে থাকতে পারেন, যা তার মৌলিক অধিকার লঙ্ঘনের শামিল। ফলে, বিচার ব্যবস্থার ভারসাম্য রক্ষায় সতর্কতা প্রয়োজন।
বিচারব্যবস্থার বাস্তবতা ও কাঠামোগত দুর্বলতা
সরকার ধর্ষণের বিচার দ্রুত নিষ্পত্তির জন্য ১৫ দিনের মধ্যে তদন্ত প্রতিবেদন দাখিলের বাধ্যবাধকতা করেছে, যা ইতিবাচক। কিন্তু বাস্তবতা হলো, দেশের তদন্ত সংস্থাগুলোর সক্ষমতা ও দক্ষতা নিয়ে প্রশ্ন রয়েছে। অধিকাংশ ক্ষেত্রে তদন্ত বিলম্বিত হয়, সাক্ষ্য-প্রমাণ সংগ্রহে গাফিলতি থাকে, এবং অপরাধীদের সাথে রাজনৈতিক বা প্রশাসনিক যোগসাজশের কারণে সঠিক প্রতিবেদন পাওয়া যায় না।
এ ছাড়া, দেশে ধর্ষণ মামলার সংখ্যা দিন দিন বাড়ছে, কিন্তু সেই তুলনায় ট্রাইব্যুনালের সংখ্যা অত্যন্ত কম। বর্তমানে যে অল্পসংখ্যক নারী ও শিশু নির্যাতন দমন ট্রাইব্যুনাল রয়েছে, সেগুলোর উপর প্রচণ্ড মামলা চাপ রয়েছে। ফলে ৯০ দিনের মধ্যে বিচার নিষ্পত্তি অলীক স্বপ্নই থেকে যাবে, যদি না পর্যাপ্ত ট্রাইব্যুনাল স্থাপন করা হয় এবং বিচারক নিয়োগ করা হয়।
মানবাধিকার ও ন্যায়বিচারের প্রশ্ন
আইন উপদেষ্টা বলেছেন, উপযুক্ত ক্ষেত্রে শুধুমাত্র মেডিকেল সার্টিফিকেটের ভিত্তিতেই মামলা চলতে পারবে। এটি কিছু ক্ষেত্রে উপকারী হতে পারে, তবে শুধুমাত্র মেডিকেল সার্টিফিকেট কি যথেষ্ট? ধর্ষণের শিকার ব্যক্তি যদি মানসিকভাবে আঘাতপ্রাপ্ত হয়ে দীর্ঘদিন পর মামলা করেন, তখন কী হবে? অপরাধী যদি আইনের ফাঁকফোকর খুঁজে পার পেয়ে যায়, তাহলে ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠিত হবে কি?
সরকার ধর্ষণ প্রতিরোধ ও বিচারকে অগ্রাধিকার দিচ্ছে, যা অবশ্যই ইতিবাচক। তবে, মানবাধিকার এবং আন্তর্জাতিক মানদণ্ড বজায় রেখে আইন সংশোধন করা প্রয়োজন। কঠোর শাস্তির পাশাপাশি, নিরপরাধ মানুষ যাতে হয়রানির শিকার না হন, সে বিষয়েও সমান গুরুত্ব দিতে হবে। জামিন পুরোপুরি বন্ধ না করে, কঠোর শর্তযুক্ত জামিনের ব্যবস্থা রাখা যেতে পারে। পাশাপাশি, তদন্ত সংস্থা ও বিচারকদের জবাবদিহিতার আওতায় আনতে হবে, যাতে কোনো গাফিলতি বা অন্যায় না হয়।
আইন কঠোর হওয়া দরকার, তবে তা যেন ন্যায়বিচারের পথ রুদ্ধ না করে। পর্যাপ্ত ট্রাইব্যুনাল এবং দক্ষ বিচারক ছাড়া দ্রুত বিচার সম্ভব নয়। পাশাপাশি, ১৫ দিনের মধ্যে তদন্ত প্রতিবেদন দাখিলের বাধ্যবাধকতা কার্যকর করতে হলে তদন্ত কর্মকর্তাদের প্রশিক্ষণ ও নজরদারি বাড়াতে হবে। বিচার ব্যবস্থার দক্ষতা, স্বচ্ছতা ও দ্রুততার ওপরই নির্ভর করবে এই আইনের সফলতা। অন্যথায়, এই পরিবর্তন বিচার ব্যবস্থায় নতুন সংকট তৈরি করতে পারে।
লেখক: মানবাধিকার আইনজীবী ও প্রতিষ্ঠাতা সভাপতি, জাস্টিসমেকার্স বাংলাদেশ ইন ফ্রান্স (জেএমবিএফ), ইমেইল: shahanur.islam@jmbf.org