আওয়ামী লীগ সরকারের সময় ঘুষ, দুর্নীতি ও ক্ষমতার অপব্যবহারে জড়িত বিচারকদের খুঁজতে ৪ সদস্যের কমিটি গঠন করেছে আইন মন্ত্রণালয়। কমিটিতে একজন যুগ্ম সচিবের নেতৃত্বে চার সদস্যের এই কমিটিতে একজন উপসচিব ও দুজন সিনিয়র সহকারী সচিব রয়েছেন বলে জানা গেছে।
বিগত সরকারের আমলে সুবিধাভোগী বিচারককের বিরুদ্ধে ঘুষ-দুর্নীতি ও ক্ষমতার অপব্যবহারের অভিযোগ খতিয়ে দেখছে এই কমিটি। এছাড়া বিচার বিভাগীয় কর্মকর্তাদের সম্পদের হিসাব যাচাই-বাছাইয়েও কাজ করছে কমিটি।
এরই মধ্যে আইন মন্ত্রণালয়ের প্রভাবশালী কর্মকর্তা সাবেক যুগ্ম সচিব (প্রশাসন) বিকাশ কুমার সাহা, ঢাকার সাবেক মুখ্য মহানগর হাকিম (সিএমএম) রেজাউল করিম এবং সাবেক অতিরিক্ত মুখ্য মহানগর হাকিম (এসিএমএম) মোহাম্মদ আসাদুজ্জামান নূরকে শোকজ নোটিশ দেওয়া হয়েছে।
তাদের বিরুদ্ধে ঘুষ-দুর্নীতি ও ক্ষমতার অপব্যবহারের অভিযোগ রয়েছে। গত ২ মার্চ ইস্যু করা এসব নোটিশে তাদের ১৫ দিনের মধ্যে লিখিত ব্যাখ্যা দিতে বলা হয়েছে।
এছাড়া সাবেক ফ্যাসিস্ট সরকারের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার পুত্র সজীব ওয়াজেদ জয় আদালতে সাক্ষ্য দিতে গেলে ঢাকার তৎকালীন সিএমএম রেজাউল করিম এবং তৎকালীন এসিএমএম মোহাম্মদ আসাদুজ্জামান নূর তাকে অভ্যর্থনা জানান। এ অভিযোগের বিষয়েও দুই বিচারকের কাছে ব্যাখ্যা চাওয়া হয়েছে।
‘৪০ লাখ টাকা ঘুষ গ্রহণের অভিযোগ’
গত ২ মার্চ ৪০ লাখ টাকা ঘুষ গ্রহণ ও আত্মসাতের অভিযোগের বিষয়ে ব্যাখ্যা দিতে আইন ও বিচার বিভাগের সাবেক যুগ্ম সচিব বিকাশ কুমার সাহাকে (ওএসডি) নোটিশ দেওয়া হয়েছে।
নোটিশে বলা হয়েছে, আইন ও বিচার বিভাগের ওএসডি কর্মকর্তা সিনিয়র জেলা ও দায়রা জজ বিকাশ কুমার সাহা যুগ্ম সচিব (প্রশাসন-১) হিসেবে কর্মরত থাকাকালে কক্সবাজার জেলা জজ আদালত, চট্টগ্রাম জেলা জজ আদালত ও জাতীয় আইনগত সহায়তা প্রদান সংস্থায় কর্মচারীদের শূন্য পদে অভিযোগকারী মো. জাফর আহমেদসহ উক্ত অভিযোগে বর্ণিত ব্যক্তিদের আত্মীয়স্বজনদের চাকরি প্রদানের আশ্বাস প্রদান করেন।
অভিযোগে উল্লিখিত বিভিন্ন তারিখ ও সময়ে ঘুষ হিসেবে অগ্রিম ৪০ লাখ টাকা গ্রহণ করেন। কিন্তু পরবর্তী সময়ে ওই চাকরিপ্রার্থীদের কোনো চাকরি প্রদান না করে ওই টাকা আত্মসাৎ করেন এবং টাকা প্রদানকারীরা ওই টাকা ফেরত চাইলে তিনি তার পদের ক্ষমতার অপব্যবহার করে মিথ্যা মামলায় গ্রেপ্তার করে রিমান্ডে নেওয়ার ভীতি প্রদর্শন করেন।
নোটিশে বলা হয়েছে, বিকাশ কুমার সাহার উক্তরূপ কার্য অনভিপ্রেত, অনাকাঙ্ক্ষিত, অবিবেচনাপ্রসূত ও অবিচারকসূলভ মনোভাব তথা একজন বিচার বিভাগীয় কর্মকর্তার জন্য অপ্রত্যাশিত ও দুর্নীতিমূলক কাজ হিসেবে গণ্য, যা বাংলাদেশ জুডিশিয়াল সার্ভিস (শৃঙ্খলা) বিধিমালা, ২০১৭-এর বিধি ২(চ) ও ২(ঠ) অনুযায়ী যথাক্রমে অসদাচরণ ও দুর্নীতিমূলক কার্যের পর্যায়ভুক্ত অপরাধ।
সে কারণে ওই বিচার বিভাগীয় কর্মকর্তার উক্ত আচরণ ও দুর্নীতিমূলক কার্যের কারণে তার বিরুদ্ধে বিভাগীয় ব্যবস্থা গ্রহণ করা আবশ্যক। বাংলাদেশ জুডিশিয়াল সার্ভিস (শৃঙ্খলা) বিধিমালা, ২০১৭-এর ৩(২) বিধি অনুযায়ী আইন ও বিচার বিভাগের সিনিয়র জেলা ও দায়রা জজ (বর্তমানে ওএসডি কর্মকর্তা) বিকাশ কুমার সাহার বিরুদ্ধে উত্থাপিত অভিযোগের ফটোকপি প্রেরণ পূর্বক আগামী ১৫ (পনেরো) দিনের মধ্যে বর্ণিত অভিযোগের বিষয়ে তার লিখিত ব্যাখ্যা তলব করা হয়েছে ওই নোটিশে।
‘সজীব ওয়াজেদ জয়কে অভ্যর্থনা’
ঢাকার সাবেক চিফ মেট্রোপলিটন ম্যাজিস্ট্রেট বর্তমানে কুমিল্লার নারী ও শিশু নির্যাতন দমন ট্রাইব্যুনাল নং-২ এর বিচারক (জেলা জজ) রেজাউল করিম চৌধুরী এবং ঢাকার সাবেক অতিরিক্ত চিফ মেট্রোপলিটন ম্যাজিস্ট্রেট বর্তমানে আইন ও বিচার বিভাগে সংযুক্ত কর্মকর্তা (অতিরিক্ত জেলা ও দায়রা জজ) মুহাম্মদ আসাদুজ্জামান নুরের বিরুদ্ধে মামলার সাক্ষীকে গাড়ি থেকে এগিয়ে আনা এবং গাড়িতে উঠিয়ে দেওয়া-সংক্রান্ত অভিযোগ আনা হয়েছে।
এতে বলা হয়েছে, স্বৈরাচারী সরকারের সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার পুত্র সজীব ওয়াজেদ জয়কে কথিত হত্যা প্রচেষ্টায় পল্টন থানায় দায়েরকৃত মামলায় সাক্ষী হিসেবে সজীব ওয়াজেদ জয় সাক্ষ্য দিতে ঢাকার তৎকালীন অতিরিক্ত চিফ মেট্রোপলিটন ম্যাজিস্ট্রেট মুহাম্মদ আসাদুজ্জামান নুরের কোর্টে আসেন।
সাক্ষী সজীব ওয়াজেদ জয় আদালত এলাকায় প্রবেশের সঙ্গে সঙ্গে ঢাকার তৎকালীন চিফ মেট্রোপলিটন ম্যাজিস্ট্রেট রেজাউল করিম চৌধুরী এবং ঢাকার তৎকালীন অতিরিক্ত চিফ মেট্রোপলিটন ম্যাজিস্ট্রেট মুহাম্মদ আসাদুজ্জামান নুর তাকে এগিয়ে আনতে খাসকামরা থেকে বের হয়ে সজীব ওয়াজেদ জয়ের গাড়ির কাছে যান এবং তাকে অভ্যর্থনা জানিয়ে নিয়ে আসেন। সাক্ষ্য প্রদান শেষে যাওয়ার সময়ও তাকে অনুরূপভাবে তারা গাড়িতে উঠিয়ে দিয়ে আসেন।
অফিস সময়ে দাপ্তরিক তথা বিচারিক দায়িত্ব পালনে অবহেলা করে মামলার সাক্ষীর প্রতি উক্ত বিচারকদ্বয়ের এরূপ কাজ অনভিপ্রেত, অনাকাঙ্ক্ষিত, অবিবেচনাপ্রসূত ও অবিচারকসুলভ মনোভাব হিসেবে বিবেচনার যোগ্য, যা বাংলাদেশ জুডিশিয়াল সার্ভিস (শৃঙ্খলা) বিধিমালা, ২০১৭-এর ২(চ) অনুযায়ী অসদাচরণের পর্যায়ভুক্ত অপরাধ। বিজ্ঞ বিচারকদ্বয়ের ওই আচরণের কারণে তাদের বিরুদ্ধে বিভাগীয় ব্যবস্থা গ্রহণ করা আবশ্যক।
নোটিশে তাদেরও ১৫ দিনের মধ্যে এ বিষয়ে ব্যাখ্যা দিতে বলা হয়েছে। এ দুই কর্মকর্তার মধ্যে রেজাউল করিম চৌধুরীর ব্যবহৃত মোবাইল ফোনটি বন্ধ পাওয়া গেছে। অন্য কর্মকর্তা বিদেশে চলে গেছেন বলে একটি সূত্র জানিয়েছে।
‘ঢাকার সাবেক সিএমএম’র বিরুদ্ধে অবৈধ সম্পদ অর্জনের অভিযোগ
ঢাকার সাবেক চিফ মেট্রোপলিটন ম্যাজিস্ট্রেট বর্তমানে কুমিল্লার নারী ও শিশু নির্যাতন দমন ট্রাইব্যুনাল নং-২-এর বিচারক (জেলা জজ) রেজাউল করিম চৌধুরীর বিরুদ্ধে অবৈধ সম্পদ অর্জনের অভিযোগ আনা হয়েছে। এ ক্ষেত্রে একটি বেসরকারি টিভি চ্যানেল ও একটি জাতীয় দৈনিকে তার বিরুদ্ধে প্রকাশিত সংবাদ আমলে নেওয়া হয়েছে।
নোটিশে বলা হয়েছে, অভিযোগে দেখা যায় যে, ঢাকার তৎকালীন চিফ মেট্রোপলিটন ম্যাজিস্ট্রেট রেজাউল করিম চৌধুরী ডিবি হেফাজতে থাকা মামলার জব্দকৃত আলামত একটি ল্যান্ডক্লুজার গাড়িসহ অন্য আরেকটি গাড়ি নিজ হেফাজতে নিয়ে অবৈধভাবে ব্যক্তিগত কাজে ব্যবহার করেন।
তাছাড়া আইন ও বিচার বিভাগকে না জানিয়ে ঢাকার সিএমএম হিসেবে অবৈধ প্রভাব খাটিয়ে গৃহায়ন ও গণপূর্ত মন্ত্রণালয় থেকে পূর্বাচল আবাসিক এলাকায় সাত কাঠার প্লট বরাদ্দ নেন; আশিয়ান গ্রুপের একটি মামলায় বেআইনি প্রভাব খাটিয়ে পাঁচ কাঠার প্লট নেন; অবৈধভাবে উপার্জিত অর্থ দ্বারা চট্টগ্রামের সীতাকুণ্ডে তিনতলা একটি বাড়ি নির্মাণ করেন ও চট্টগ্রামের জাকির হোসেন রোডের ইয়াকুব সেন্টারে একটি ফ্ল্যাট ক্রয় করেন; সিএমএম পদের অবৈধ প্রভাব খাটিয়ে ঢাকার ইউনাইটেড হাসপাতালে প্রয়োজনে-অপ্রয়োজনে একাধিকবার ৫ থেকে ৭ লাখ টাকার স্বাস্থ্য পরীক্ষা করে বিল পরিশোধ করেননি।
নোটিশে বলা হয়েছে, বিচারকের এরূপ কাজ অনভিপ্রেত, অনাকাঙ্ক্ষিত, অবিবেচনাপ্রসূত ও অবিচারকসুলভ মনোভাব হিসেবে বিবেচনার যোগ্য, যা বাংলাদেশ জুডিশিয়াল সার্ভিস (শৃঙ্খলা) বিধিমালা, ২০১৭ এর ২(চ) ও ২ (ঠ) অনুযায়ী অসদাচরণ ও দুর্নীতিমূলক কার্যের পর্যায়ভুক্ত অপরাধ। বিজ্ঞ বিচারকের ওই অসদাচরণ ও দুর্নীতিমূলক কার্যের কারণে তার বিরুদ্ধে বিভাগীয় ব্যবস্থা গ্রহণ করা আবশ্যক। তাকেও ১৫ দিনের মধ্যে এ বিষয়ে ব্যাখ্যা দিতে বলা হয়েছে।
সূত্র: কালবেলা