ভূমিকা
দেশের অর্থনীতির চালিকাশক্তির মূল উপাদান যুব সমাজের কর্মচাঞ্চল্যতা। দেশের সার্বিক উন্নয়ন তরান্বিত করে বৈশ্বিক প্রতিযোগিতায় টিকে থাকার অন্যতম হাতিয়ার হিসেবে বিবেচিত হতে পারে স্টার্টআপ ইকোনমি যা এই কর্মচাঞ্চল্যতাকে নতুনরুপে সংজ্ঞায়িত করেছে।
বৈশ্বিক স্টার্টআপ ইকোনমির আকার নির্ধারন করা কষ্টসাধ্য কাজ হলেও ২০২৪ সালে যা ছিলো ৩ ট্রিলিয়ন মার্কিন ডলার। এর মাঝে বাংলাদেশের স্টার্টআপগুলিও ভূমিকা রেখেছে। স্টার্টআপ মূলত একটি ব্যবসায় আইডিয়াকে খুব দ্রুত বড় আকারের ব্যবসায় রুপান্তরের একটি উপায় হিসেবে বিবেচিত হচ্ছে।
স্টার্টআপ আইডিয়াকে কাগজ-কলম থেকে বাস্তবে রুপান্তরের জন্যে কোম্পানি আইন প্র্যাক্টিস করা আইনজীবীদের ভূমিকা অনবদ্য। স্টার্টআপ, ভেনচার ক্যাপিটাল, এঞ্জেল ইনভেস্টমেন্ট প্রতিটির সাথে আইনের রয়েছে ওতপ্রোত সম্পর্ক।
এক্ষেত্রে স্টার্টআপ নিয়ে আইনজীবীদের কাজের যেমন সুযোগ তৈরি হয়েছে তেমনি কেবল স্টার্টআপ আইনজীবী হিসেবেই ক্যারিয়ার গড়ার পথও মশৃন হচ্ছে দিনদিন। আজ আলোচলনা করবো স্টার্টআপ ইকোনমিতে আইন প্র্যাক্টিসের আদ্যোপান্ত নিয়ে।
স্টার্টআপ কি?
সহজভাষায় বললে স্টার্টআপ বলতে বুঝায় নতুন ব্যবসায় উদ্যোগ যা কোনো উদ্ভাবনি পন্য নিয়ে কাজ করে এবং বাজারে এটি চাহিদাসম্পন্ন পন্য হিসেবে গ্রাহকদেরকে নতুন কিছু প্রদান করে থাকে যা চিরাচরিত ব্যবসায় হতে আমরা আশা করিনা। স্টার্টআপের সাথে ঝুঁকির একটি সম্পর্ক রয়েছে। দ্রুত মুনাফা করা যেমন সহজ তেমনি উদ্যাক্তাদের ঝুঁকি মোকাবিলা করে এগিয়ে যেতে হয়।
চলুন উদাহরণ দিয়ে স্টার্টআপকে বোঝার চেস্টা করি। বাংলাদেশি বংশোদ্ভূত মার্কিন নাগরিক ফাহিম সালেহ অ্যাপভিত্তিক রাইডশেয়ারিং স্টার্টআপ শুরু করেন যা মূলত বাইকারদেরকে গ্রাহকদের সাথে যুক্ত করেন এবং গ্রাহকরা খুব সহজেই মোবাইল অ্যাপের মাধ্যমে সেবা গ্রহণ করতে পারেন। বৃহৎ পরিসরে পরিবহন সেবা দিয়ে চলেছে একটি মোবাইল অ্যাপের মাধ্যমে।
ল’ প্র্যাক্টিস
এখন আলোচনা করবো স্টার্টআপ নিয়ে আইনজীবীদের কাজের সুযোগ কেমন হতে পারে। স্টার্টআপকে আমরা যেভাবেই সংজ্ঞায়িত করি না কেনো এটি মূলত একটি ব্যবসায় প্রতিষ্ঠান হিসেবেই কাজ করে থাকে। স্টার্টআপের জীবনকালকে কয়েকটি ধাপে আলাদা করা যায় এবং প্রতিটি ধাপেই রয়েছে বিজ্ঞ আইনজীবীদের কাজের অবারিত সুযোগ।
প্রি- সিড স্টেজ
এই ধাপে নতুন আইডিয়া এবং সম্ভাবনা নিয়ে উদ্যোক্তা হিসেব-নিকেশ করতে থাকেন এবং ফান্ড যোগার করা থেকে শুরু করে কোম্পানি গঠনের যাবতীয় পেপার ওয়ার্ক করেন। এক্ষেত্রে একজন আইনজীবী উদ্যোক্তাকে ফান্ড যোগাড় করা এবং সেই ফান্ড রক্ষনাবেক্ষনে পরামর্শ দিতে পারেন।
তাছাড়া আইনী কাঠামোর মধ্যে থেকে একজন উদ্যোক্তাকে কোন কোন পথে যেয়ে ছোট্ট আইডিয়াকে কোম্পানিতে রুপান্তর করা যায় সেই পরামর্শ প্রদান করতে পারেন।
একক মালিকানা, অংশীদারী অথবা কোম্পানি গঠনের রুপরেখা প্রদান করে একজন আইনজীবী স্টার্টআপ উদ্যোক্তাকে আইনী জটিলতা পাশ কাটিয়ে সিদ্ধান্ত নিতে সহায়তা করতে পারেন।
সিড এন্ড গ্রো স্টেজ
এই ধাপে একটি স্টার্টআপ তার আকৃতি ধারণ করে এবং এগিয়ে যেতে থাকে। এই ধাপে উতরে যেতে প্রয়োজন পর্যাপ্ত ফান্ডিং তথা অর্থের যোগান। একটি স্টার্টআপ বিভিন্নভাবে ফান্ড যোগাড় করতে পারে। ব্যাক্তিগত ফান্ড এখানে মূখ্য নয়।
এঞ্জেল ইনভেস্টমেন্ট সম্পর্কে সঠিক পরামর্শ এবং মালিকানা স্বত্ত্ব বা ইকুইটি শেয়ারের মাধ্যমে ভেঞ্চার ক্যাপিটাল থেকে অর্থ উত্তোলনের সহায়তা করতে পারেন এবং উপযুক্ত দলিল তৈরি করে দিয়ে ব্যবসা পরবর্তী জটিলতা এড়াতে সহায়তা করতে পারেন।
এক্সিট স্টেজ
একজন সফল উদ্যোক্তা সেইফ এক্সিট সম্পর্কে আগেই পরিকল্পনা গ্রহন করে থাকেন। উদ্যোক্তাগন কিভাবে নিজেদেরকে স্টার্টআপ থেকে প্রত্যাহার করতে পারেন এবং কোন প্রক্রিয়া অনুসরনে অর্থ লগ্নীকারী প্রতিষ্ঠানের সাথে মুনাফা বন্টন করবে সে সম্পর্কে সুস্পষ্ট নির্দেশনা প্রদান করে বিজ্ঞ আইনজীবীগন গুরুত্বপূর্ণপূর্ণ ভূমিকা পালন করতে পারেন।
এছাড়াও একটি স্টার্টআপ আরো অনেক পথ খুলে দিচ্ছে যা আইনজীবীদের জন্য সুন্দর সুযোগ হতে পারে –
স্টার্টআপ রিসার্চ
একটি নতুন পন্য বা প্রোডাক্টের আইনগত ভিত্তি এবং ভবিষ্যতে এ নিয়ে কোনো সমস্যার উদ্ভব হলে সে সম্পর্কে তথ্য সংগ্রহ করে লিগাল রিসার্চের ক্ষেত্রে আইনের শিক্ষার্থীদের স্টার্টআপগুলির সাথে কাজ করার সুযোগ তৈরি হয়েছে। বেশকিছু স্টার্টআপ কোম্পানি আইনের শিক্ষার্থীদের ইন্টার্নশিপ করার সুযোগ করে দিয়েছে। বিডিজবসএ চোখ রাখলেই বিভিন্ন ভ্যাকেন্সি চোখে পড়বে।
বিনিয়োগ পরামর্শ
স্টার্টআপে দেশি বিদেশি বিনিয়োগকারীগন বিনিয়োগ করে থাকেন। সেক্ষেত্রে ফরেন কারেন্সি নিয়ে কাজ করার ক্ষেত্রে মানিলন্ডারিং আইনের ব্যত্যয় না ঘটিয়ে বিনিয়োগ পরামর্শ প্রদান করা যেতে পারে।
ইন্টেলেকচুয়াল প্রোপার্টির নিরাপত্তা
ট্রেডমার্ক, পেটেন্ট, কপিরাইট সংক্রান্ত্র মেধাস্বত্ত্ব সংরক্ষণে বিজ্ঞ আইনজীবীদের কাজের সুযোগ রয়েছে।
চুক্তি ড্রাফট করা
স্টার্টআপ পরিচালনায় বিভিন্ন ব্যক্তি এবং প্রতিষ্ঠানের সাথে চুক্তি করার প্রয়োজন হয়। ড্রাফটিং আইনজীবী এবং আইনের শিক্ষার্থীদের নিত্যদিনের কাজ।এতে করে শিক্ষার্থীরাও ড্রাফট করে দিয়ে আয় করে নিতে পারে ছাত্রাবস্থায়।
বিরোধ নিষ্পত্তি
কোর্টের বাইরে বিভিন্ন বিরোধ মিটাতে আইনজীবীর মাধ্যমে মেডিয়েশন গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করতে পারে। বিভিন্ন অর্থলগ্নীকারী ব্যক্তি এবং প্রতিষ্ঠানের সাথে উদ্যোক্তারের বিরোধ মিটিয়ে আইনজীবীদের আয়ের সুযোগ রয়েছে।
স্টার্টআপ অ্যাডভোকেসির জন্যে যেসকল আইনগুলি বিভিন্ন সময়ে প্রয়োগ হতে পারে উল্লেখযোগ্য হলো –
কোম্পানি আইন, ১৯৯৪
আয়কর অধ্যাদেশ, ১৯৮৪
পার্টনারশিপ আইন, ১৯৩২
কপিরাইট আইন, ২০০০
পেটেন্টস ও ডিজাইনস আইন, ১৯১১
ট্রেডমার্কস আইন, ২০০৯
শ্রম আইন, ২০০৬
দেউলিয়া আইন, ১৯৯৭
সাইবার নিরাপত্তা আইন, ২০২৩
বৈদেশিক মুদ্রা নিয়ন্ত্রণ আইন, ১৯৪৭
ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ আইন, ২০০৯
আর্থিক প্রতিষ্ঠান আইন, ১৯৯৩
প্রতিযোগিতা আইন, ২০১২
পরিশেষে, এটি বলার অপেক্ষা রাখেনা যে, দ্রুতবর্ধনশীল এই স্টার্টআপ ইকোনমিতে একজন আইনের ছাত্র স্টার্টআপ অ্যাডভোকেসি করাকে ক্যারিয়ারের অন্যতম লক্ষ হিসেবে গ্রহণ করতেই পারেন। একইসাথে আইনের শিক্ষার্থীদের জন্যে স্টার্টআপ প্রতিষ্ঠান হতে পারে কর্পোরেট প্র্যাক্টিসের প্লে-গ্রাউন্ড।
লেখক : আল-আমিন ফাহিম; শিক্ষার্থী, আইন ও বিচার বিভাগ, জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলাম বিশ্ববিদ্যালয়।