ইমরান হোসেন ইমন: শরীয়তপুর আইনজীবী সমিতি যে আদালতে পেশকার-পিওনদের ঘুষের পরিমাণ অফিসিয়ালি নির্ধারণ করে দিয়েছে ব্যাপারটাকে নিয়ে হাসাহাসি না করে এর গুরুত্ব অনুধাবন করা উচিত।
এই রেজুলেশনে লেনদেনটি উকিল আর কর্মচারীর মধ্যে হলেও আদালত মূলত চারটি স্টেকহোল্ডার নিয়ে গঠিত। বিচারক, আইনজীবী, কর্মচারী ও বিচারপ্রার্থী, সবগুলো সমান গুরত্বপূর্ণ৷ এর মধ্যে বিচারপ্রার্থী জনগণ সমস্ত টাকার উৎস, যা ক্ষেত্র বিশেষে অন্য সব স্টেকহোল্ডার ভোগ করে৷
আইনজীবীরা দুর্নীতি করে না, আসলে প্রয়োজন পড়ে না। উনি হাজার টাকা নিলে সেটাও ফি, লাখ টাকা নিলেও। এটার কোন নিয়মনীতি নাই যে কোন মামলার কোন পর্যায়ে একজন উকিল সর্বোচ্চ কত টাকা ফি নিতে পারবে।
সুতরাং পুরোটাই হালাল পারিশ্রমিক। তবে উকিল সাহেবরা ঘুষ দেন। দিতে হয়। শুধু শরীয়তপুর না, সারা বাংলাদেশে একই চিত্র। আর এই ঘুষের পুরোটাই আসে বিচারপ্রার্থীর পকেট থেকে।
এই যে উকিলরা ঘুষ দেন, কাকে দেন? কোর্টের কর্মচারীকেই তো? কিন্তু প্রশ্ন হচ্ছে কেন দেন? কি এমন দুর্যোগ নেমে আসে যে কোর্টে ইট-বালিকেও ঘুষ দিতে হয়। কেন উকিলরা এর প্রতিবাদ না করে উল্টো প্রাতিষ্ঠানিক রুপ দিচ্ছেন? কেন জেলা জজ কোন ব্যবস্থা নিচ্ছেন না? এর কারণ আছে, আর কারণগুলো সবার জানা উচিত।
আরও পড়ুন : শরীয়তপুর বারের অবৈধ রেজুলেশন: আইনি বিশ্লেষণ ও প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা
প্রথমত, বিচারবিভাগের বাজেট। আপনারা কি জানেন বিচারবিভাগ রাষ্টের তিনটা অঙ্গের একটা হওয়া সত্ত্বেও বাজেট পাচ্ছে বিটিভির চেয়ে কম। এই যে প্রতিদিন শুনেন অমুক ২ হাজার কোটি পাচার করেছে, তমুক ৩ হাজার কোটি পাচার করেছে, বিচারবিভাগের বাজেট এর চেয়েও কম। নুন আনতে পান্তা ফুরাচ্ছে মত। সরকার বিচার বিভাগকে অঙ্গ তো দূরের কথা গুরত্বপূর্ণ কোন প্রতিষ্টান মনে করে কিনা সন্দেহ আছে।
বাজেট ঘাটতির ফলে একটি কোর্ট চালাতে গেলে যে বাজেট দরকার তা পাওয়া যায় না। এক একটা জেলায় ৩০/৩৫টা কোর্ট থাকলেও বাজেট পান শুধু একজন জেলা জজ স্যার। ঐ অল্প বাজেটে খোদ ফেরেশতারাও সবগুলো কোর্টের চাহিদা পূরণ করতে পারবে না। সুতরাং এই ঘাটতি পূরণ হয় আপনাদের দেওয়া ঘুষের টাকা থেকে।
দ্বিতীয়ত, মরার উপর খাড়ার ঘা হয়ে আছে উপরে স্টাফ সংকট, যে কোর্টে ১১ জন স্টাফ থাকার কথা সেখানে ৫ জন, যেখানে ৯ জন থাকার কথা সেখানে ৪ জন স্টাফ আছে, যা দিয়ে কয়েক হাজার মামলার একটা কোর্ট চালানো সম্ভব না৷ এই কোর্ট চালু রাখতে বাধ্য হয়ে উমেদার রাখা হয় যাদেরকে দৈনিক ভিত্তিতে অন্য স্টাফরা পে করে। কোত্থেকে করে? নিজের বেতন থেকে তো না। ঐ যে আপনার ঘুষ তাদের বেতন।
আরও পড়ুন : আদালতে ঘুষ গ্রহণ প্রাতিষ্ঠানিক রূপ পেল!
তবে ব্যাপারটা এইরকম না যে, শুধু ঘাটতি পূরণ করার জন্য ঘুষ নেওয়া হয়, ঘাটতি ২০ টাকা হলে ঘুষ নেওয়া হয় ২০০ টাকা। কারণ ঐ ২০ টাকা ঘাটতি পূরণ করতে গিয়ে কর্মচারীদের মরাল স্ট্যান্ডটা ভেঙ্গে গেসে৷ এখন কোনভাবেই আর তাদের চাহিদা পূরণ করা সম্ভব না। আর ঐ ২০ টাকা ঘাটতি যেহেতু বিচারক মহোদয় নিজের পকেট থেকে পূরণ করতে পারবে না, তাই এই ঘুষ দুর্নীতি বন্ধে কার্যকর ভূমিকাও রাখা যাচ্ছেনা। আর কোন আদালতের বিচারক যদি ঘুষ নেন সেটা আর আদালত থাকে না।
বিচার বিভাগে চাকরির ছোট অভিজ্ঞতায় দেখেছি শতকরা ৯৫ জন বিচারক আর্থিকভাবে সৎ হওয়া সত্ত্বেও আদালতের দুর্নীতি বন্ধ করতে পারেন না। তবে খুব ছোট কিছু পদক্ষেপে এর সমাধান আছে-
১. বিচারবিভাগের বাজেট বাড়াতে হবে। ৮ লক্ষ কোটি টাকা জাতীয় বাজেটের অন্তত ২ পার্সেন্ট বিচার বিভাগকে দেওয়া হোক। আচ্ছা ২ পার্সেন্ট বাদ দেন, ১% দিলেও হবে।
২. পর্যাপ্ত স্টাফ নিয়োগ দিতে হবে। অবশ্যই যোগ্যতার ভিত্তিতে। কেউ ঘুষ দিয়ে চাকরি নিলে তাকে ঘুষ খাওয়া থেকে বিরত রাখা যাবেনা।
৩. প্রতিটা আদালতকে পৃথক বাজেট বরাদ্দ দেওয়া হোক৷ এটাই হবে সবচেয়ে বড় পরিবর্তন। দুর্নীতি ৫০% কমে আসবে।
৪. বেতন কাঠামো পরিবর্তন ও নতুন পে স্কেল ঘোষণা করতে হবে। একটা জেলা শহরে ১৫ হাজার টাকা বেতনে একজন কর্মচারীর পরিবার নিয়ে সার্ভাইভ করা সম্ভব না। তাদের সৎভাবে সম্মানজনক জীবিকা নিশ্চিত করতে হবে।
৫. বিজ্ঞ বিচারকের সদিচ্ছা ও উকিলদের সহোযোগিতা বাড়াতে হবে। তাদেরও অনৈতিক চাহিদা পূরণের ইচ্ছা বাদ দিয়ে দুর্নীতির বিরুদ্ধে কঠোরভাবে দাড়াতে হবে।
বি: দ্র: দুর্নীতির শীর্ষ তিনটি খাত হলো পাসপোর্ট, বিআরটিএ ও আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী। এছাড়াও ভূমি অফিস, সাবরেজিস্ট্রার অফিসসহ সবগুলোতে নজর দিতে হবে।
লেখক : সহকারী জজ, সিলেট।