জাহিদ হাছান রিয়াদ : বর্তমানে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম যেমন মানুষের জন্য কল্যাণকর হয়ে আর্বিভাব হয়েছে তেমনি এর বদৌলতে সমাজে অসামাজিক কার্যকলাপের দ্বারও উন্মোচিত হয়েছে। তেমনই বহুল আলোচিত একটা ঘটনা যা কিনা সামাজিক মাধ্যমের সম্পর্ক থেকে যৌন সহিংসতার অভিযোগে তোলপাড় হয়েছে দেশে।
টিকটক ব্যক্তিত্বের বিরুদ্ধে ধর্ষণের অভিযোগে নারী ও শিশু নির্যাতন দমন আইনের ৯(১) ধারায় অভিযুক্ত করে ঢাকা সেনানিবাস থানায় চার্জশিট দেওয়া হয়েছে। ভিকটিম জানান, অভিযুক্ত আসামী তাকে বিয়ের প্রতিশ্রুতি দিয়ে তার বাড়িতে থাকতে শুরু করে। জানুয়ারি ২০২২ থেকে তার ফ্ল্যাটে অবস্থান করে, এমনকি তার পরিবারও সেখানে আসে। কিন্তু বিয়ের কথা এড়িয়ে গিয়ে মার্চে জোরপূর্বক ধর্ষণের অভিযোগ ওঠে। এই মামলায় উন্মোচিত হয়েছে লিভ টুগেদার (কোহ্যাবিটেশন) এর ঝুঁকি, বাংলাদেশে অবাধ সম্পর্কের অন্ধকার দিক।
যদিও লিভ টুগেদার সরাসরি অবৈধ নয়, আইনের ফাঁকই শিকার করছে নারীদের। পেনাল কোডের দন্ডবিধির ৪৯৩ ধারায় আইনগত বিবাহ বন্ধন না করে, বিবাহ হয়েছে বলে প্রতারণা করে সহবাস করার শাস্তি সর্বোচ্চ ১০ বছরের বিধান রাখা হয়েছে। কিন্তু অবৈধ লিভ টুগেদারের বৈধতা বা নিরাপত্তা এতোদ্বয় সম্পর্কে কিছু উল্লেখ করা হয়নি।
নারী ও শিশু নির্যাতন দমন আইনে ধর্ষণের সর্বোচ্চ শাস্তি যাবজ্জীবন কারাদণ্ড উপযুক্ত প্রমাণ সাপেক্ষে। কিন্তু “বিয়ের প্রতিশ্রুতি দিয়ে ধর্ষণ” এর ক্ষেত্রে প্রমাণের বোঝা ভুক্তভোগীর উপরই। আইনবিদদের মতে, “লিভ টুগেদারের ঘটনায় ধর্ষণের প্রমাণ জটিল। সম্পর্ক ‘সামাজিকভাবে গ্রহণযোগ্য’ মনে হলে অভিযোগ নস্যাৎ করা হয়।” অপরাধীরা আইনের এই দুর্বলতা কাজে লাগায়। জাতীয় আইডি বা পাসপোর্ট রেখে “বিশ্বাস” অর্জন, তারপর শারীরিক নির্যাতন এই প্যাটার্ন উদ্বেগজনক।
বাংলাদেশের রক্ষণশীল সমাজে অবিবাহিতদের একসঙ্গে থাকাকে “অনৈতিক” মনে করা হয়। ফলে লিভ টুগেদারের সম্পর্ক গোপনীয়তার শিকার হয়, যা নারীদের ঝুঁকিতে ফেলে। পুরুষ সঙ্গী প্রায়ই মানসিক-শারীরিক নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠা করে। সম্পর্ক “সম্মতিমূলক” দেখালে ধর্ষণের অভিযোগ প্রমাণ কঠিন। পুলিশ-আদালত অভিযোগকে “ব্যক্তিগত সমস্যা” বলে উড়িয়ে দেয়। ঘটনার ভিকটিমের ক্ষেত্রেও অভিযুক্ত আসামীর পরিবারের ফ্ল্যাটে আসা, তার জিনিসপত্র রাখাকে “বিশ্বাসযোগ্যতা” বলে দেখা হয়েছে। কিন্তু আদালতে এর প্রাসঙ্গিকতা কী?
আইনগত সমাধান হিসেবে বর্তমানে বিবাহের প্রলোভনে ধর্ষণের শাস্তি ৭ বছর সাজা রেখে আইন পাশ করা হয়েছে। কিন্তু লিভ টুগেদারের বিষয়টি আইনের চোখে বৈধই থেকে যায়, এবং আমাদের সমাজের উদ্বেগ আসে না যতক্ষণ পর্যন্ত না কোন লোমহর্ষক ঘটনার পূনরাবৃত্তি হয়। অন্যদিকে লিভ টুগেদার ধর্মীয় ও সামাজিক দৃষ্টিকোণ থেকে অবৈধ হলেও এই অপরাধের মাধ্যমে ধর্ষণের ঘটনার পথ কিন্তু বন্ধ হয়নি।
এই লিভ টুগেদারের ভয়াবহতা ও দূরদর্শী ক্ষতিকর দিক মাথায় রেখে সৌদি আরব, পাকিস্তান, আফগানিস্তান, ইরান, কুয়েত, মালদ্বীপ, মরক্কো, ওমান, মৌরিতানিয়া, সংযুক্ত আরব আমিরাত,সুদান, ইয়েমেন ইত্যাদি মুসলিম প্রধান দেশে লিভ টুগেদার নিষিদ্ধ ঘোষণা করা হয়েছে।
লিভ টুগেদার থেকে বিবাহের প্রলোভন দেখিয়ে ও বিবাহিত বোঝানো হয়ে প্রতারণা মূলক ধর্ষণের দ্বার উন্মোচিত হচ্ছে, যার সুস্পষ্ট প্রমাণ মেলে টিকটকার ব্যক্তিত্বের ধর্ষণ ঘটনা থেকে। সুতরাং, এই অপরাধের পথকে অসুগম করতে লিভ টুগেদারের ক্ষেত্রে জবাবদিহিতা বাড়াতে হবে, বাধ্যতামূলক রেজিস্ট্রেশন চালু করা যেতে পারে।
ধর্ষণ সংক্রান্ত আইনে “সম্মতি” এর সংজ্ঞা পরিষ্কার করা, বিয়ের প্রলোভনে ধর্ষণ এর প্রতিকার আইনের পাশাপাশি লিভ টুগেদার প্রতিরোধে আইন প্রণয়ন করতে হবে। সামাজিক পদক্ষেপ হিসেবে অবিবাহিতদের লিভ টুগেদারকে অপরাধ করে নারীর সুরক্ষা নিশ্চিত করতে সচেতনতা বাড়ানো, ভুক্তভোগীদের প্রতি কলঙ্কমুক্ত পরিবেশ তৈরি করতে হবে।
টিকটকার ব্যক্তিত্বের দ্বারা প্রতারণা মূলক ধর্ষণ ঘটনা কোনো বিচ্ছিন্ন ঘটনা নয়। লিভ টুগেদারের অন্ধকার দিক মোকাবিলায় আইন ও সমাজকে একসঙ্গে কাজ করতে হবে। অন্যান্য দেশের মতো লিভ টুগেদারের ভয়াবহা উপলব্ধি করে, লিভ টুগেদার আইন প্রণয়নের মাধ্যমে নিষিদ্ধ করতে হবে।
এছাড়াও এর অপব্যবহার রোধে দরকার কঠোর তদারকি, ভুক্তভোগীবান্ধব বিচারব্যবস্থা এবং নারীর নিরাপত্তা নিশ্চিত করা প্রয়োজন। টিকটাকর ব্যক্তির বিরুদ্ধে ভিকটিমের লড়াই শুধু একটি মামলার গল্প নয় এটি সমাজের প্রতিটি নারীর অধিকারের প্রশ্ন।
লেখক : শিক্ষার্থী, আইন বিভাগ, ফেনী ইউনিভার্সিটি।