সভ্যতার মুখোশ খুলে দিয়েছে গাজা
আলমগীর মুহাম্মদ ফারুকী

সভ্যতার মুখোশ খুলে দিয়েছে গাজা

আলমগীর মুহাম্মদ ফারুকী : আইনের ছাত্র হিসেবে মানবাধিকার আইন, আন্তর্জাতিক আইন ও আন্তর্জাতিক মানবিক আইন যতটুকু পেরেছি, শেখার চেষ্টা করেছি। ভাবতাম, সভ্যতা বহু দূর এগিয়েছে। মনে হতো, আজকের পৃথিবী ন্যায়ের, সংবেদনশীলতার—একজন বিশ্বনাগরিক হিসেবে নিজেকে পরিচয় দিতে গর্ব হতো। কিন্তু আজ, কয়েকদিন ধরে ঘুম আসে না। এক ধরণের গভীর ঘৃণা জন্ম নিচ্ছে নিজের প্রতি, সভ্যতার প্রতি।

সোশ্যাল মিডিয়ায় প্রবেশ করতে ভয় লাগে। ঢুকলেও অনেক স্ট্যাটাস এড়িয়ে যাই। চোখে পড়লেই দ্রুত স্ক্রল করে ফেলি। যেন কিছু না দেখি, যেন কিছু না ভাবি। এক অদৃশ্য হাহাকারে ভার হয়ে আছে বুক—মানুষ হিসেবে যেন আমি এক মহা অক্ষম প্রাণী। ভিডিওতে দেখি, বোমার আঘাতে দালান উড়ে যাচ্ছে, আর তার সঙ্গে ছিন্নভিন্ন হয়ে যাচ্ছে মানবদেহ—পাখির পালকের মতো ছড়িয়ে পড়ছে। জানি না, সভ্যতার ইতিহাসে এমন নৃশংসতা আগে কেউ দেখেছে কিনা। শিশুর শরীর টুকরো হয়ে যাচ্ছে, সারি সারি লাশ। আমি সেখানে বারবার নিজের সন্তানের মুখ খুঁজে পাই। আমার মতো আরো কত মানুষ হয়তো এমন করেই কাটাচ্ছে দিন।
হ্যাঁ, আমি গাজার কথা বলছি—আমার প্রিয় ফিলিস্তিনের কথা বলছি।
শৈশব থেকে আজ অবধি, এই জনপদের মানুষের সাহসিকতা আমার হৃদয়ে আলোড়ন তুলেছে। ট্যাংকের সামনে পাথর হাতে দাঁড়িয়ে থাকা, স্বাধীনতার স্বপ্নে বিভোর এক অদম্য জাতি। দাদা থেকে নাতি, পুর্বপুরুষ থেকে উত্তরপুরুষ—সবাই এক পথের পথিক। সবচেয়ে বড় ত্যাগটা যেন এসেছে শিশুদের কাছ থেকে, যাঁরা পৃথিবীর সৌন্দর্য উপভোগ করার আগেই দেশপ্রেমের কঠিন পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হয়েছে। হয়তো এই কারণেই গাজা হয়ে উঠেছে পৃথিবীর সবচেয়ে বড় কবরস্থান।
জেনোসাইড স্টাডিজের বিশেষজ্ঞ গ্রেগরি স্ট্যানটনের গণহত্যার দশটি ধাপের কয়েকটি গাজায় একেবারে প্রাসঙ্গিক—
১. শ্রেণীবিভাগ: ‘তারা’ এবং ‘আমরা’—এই বিভাজন দিয়ে শুরু। ফিলিস্তিনিরা ‘তারা’, বাকি দুনিয়া ‘আমরা’।
২. অমানবিকীকরণ: মুসলমান বা ফিলিস্তিনি—তাদের ‘মানুষ’ বলার আগে একবার ভাবা হয়। একে একে ছুড়ে দেওয়া হয় অদ্ভুত সব অপবাদ।
৩. প্রস্তুতি: জাতিগতভাবে নির্মূলের আগে তাদের গাদাগাদি করে রাখা হয়, চিহ্নিত করা হয়।
৪. নির্মূল: হত্যা, গণহত্যা, নির্বিচার ধ্বংস। কারণ হত্যাকারীরা ভাবে, এরা মানুষ নয়।
৫. অস্বীকার: সবশেষে আসে সত্যকে অস্বীকারের ধাপ। গাজা এখন এই চূড়ান্ত প্রেক্ষাপটে দাঁড়িয়ে।
এক সময় ভাবতাম, হত্যাকারী ইসরায়েলী ক্ষমতাসীনদের মানবিকতা কতটুকু কার্যকর। যখন ফিলিস্তিন জনগোষ্ঠীকে ডি-হিউম্যান বা সাব হিউম্যান বিবেচনায় কুকুর, বিড়ালের সমকক্ষ ধরা হয় এবং ইসরায়েলী একটা শ্রেনী বা গোষ্ঠী এটাই ভাবতে থাকে, মেনে নেয় তখন এই গনহত্যায় তাদের কষ্ট হয়না। ইসরাইলী হানাদারগুলো হয়তো এই আদর্শেই বড় হচ্ছে…এই নৈতিকতা বিবর্জিত ও অমানবিক পশু শ্রেণীর মানুষগুলো ইসরায়েলকেই একসময় গলাধঃকরণ করবে- ইতিহাস এটাই বলে।
আর আমরা? ভোগবিলাসে মত্ত মুসলিম শাসকগোষ্ঠীকে বারবার গ্লোরিফাই করি, শুভকামনা জানাই। অথচ তারা নিজ দেশের মানুষেরই অধিকার কেড়ে নিচ্ছে প্রতিদিন। বাকস্বাধীনতা, গণতন্ত্র—সব তছনছ। এমন লেজুড়বৃত্তিক ও সুবিধাবাদী নেতৃত্বের কাছে আমরা কী আশা করবো? এরদোয়ান, সিসি, সালমান—সবাই আসলে একই মুদ্রার এপিঠ-ওপিঠ।
একটি জাতিকে ‘আত্মত্যাগী’ বলতে কতটা ত্যাগের প্রমাণ লাগবে, তা আমি জানি না। কেবল কল্পনা করুন—এক সকালে ঘুম থেকে উঠে দেখলেন, আপনার পরিবারের কেউ আর জীবিত নেই। কেউ নেই, যাকে জড়িয়ে ধরবেন, যার মুখ দেখে শান্তি পাবেন। এমন নিদারুণ বাস্তবতা আছে, যেখানে নিষ্পাপ শিশু চিরতরে হারিয়েছে তাঁদের বাবা-মাকে, আর এই পৃথিবীতে তাঁদের জন্য আর কেউ রইল না। একটা জনপদের মানুষের জীবন- মৃত্যু এখন নির্ভর করছে এক দখলদার শক্তির ইচ্ছা, করুণা আর খেয়ালের উপর। এ কেমন সভ্যতা—যা চোখের সামনে ঘটে চলা নৃশংসতা দেখেও নিশ্চুপ থাকে? এটা সভ্যতার মুখে এক নির্মম উপহাস ছাড়া আর কিছুই নয়। আর আমরা এখনো প্যালেস্টাইনি জনগণ, হামাস কিংবা তাঁদের সহায়তাকারীদের দোষ খুঁজে ফিরি।
হামাসের ইসমাইল হানিয়া পরিবারের দশজনসহ শহীদ হলেন, ইয়াহিয়া সিনওয়ার নিজের জীবন উৎসর্গ করলেন নেতৃত্বের দায়বদ্ধতায়। হিজবুল্লাহ প্রধান হাসান নাসরুল্লাহ শহীদের মিছিলে নাম লেখালেন, ইরানের প্রেসিডেন্ট রাইসি কথা রেখেছেন রক্ত দিয়ে। প্যালেস্টাইনি জাতি মাত্র গত কয়েক দিনে পাঁচ হাজার নয়, পঞ্চাশ হাজারের বেশি প্রাণ দিয়েছে কেবল স্বাধীনতা ও অধিকার ফিরে পাওয়ার আশায়। তবু কি তাঁদের সততা ও সংকল্পের আরও প্রমাণ দরকার আমাদের কাছে? তাঁদের আত্মত্যাগের বিশুদ্ধতা তাঁদেরকে আমাদের যাবতীয় হিসাব-নিকাশ ও ভুল-ত্রুটির ঊর্ধ্বে তুলে এনেছে। হয়তো এ কারণেই কয়েক মাস আগে ফিলিস্তিনি খতীব মাহমুদ আল-হাসা’নাত ইতিহাসের সবচেয়ে সংক্ষিপ্ত জুমআর খুতবায় বলেছিলেন—
যদি ৩০ হাজার শহীদ, ৭০ হাজার আহত, আর ২০ লক্ষ গৃহহীন ফিলিস্তিনি মুসলিম তোমাদের জাগাতে না পারে, তবে আমি কীভাবে বিশ্বাস করবো যে আমার কয়েকটি বাক্য তোমাদের বিবেক জাগাবে? খুতবা শেষ। কাতার সোজা করুন। সারিতে দাঁড়ান।
বলেই তিনি নামাজ শুরু করেন। তাঁর প্রতিটি শব্দ ছিল অনড় প্রতিজ্ঞার মতো—একটি নিঃশব্দ আর্তনাদ, যা আকাশ কাঁপায়।
তারপরও আশার আলো নিভে যায়নি। গণহত্যার বিরুদ্ধে ইসরায়েলের ভেতর থেকেও অনেক সাহসী মানুষ প্রতিবাদ করছেন। বিশ্বের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে অনেক দেশ, বহু জাতি এই নির্যাতনের বিরুদ্ধে কণ্ঠ তুলছে। রাষ্ট্রপ্রধান, নেতা, মানবাধিকারকর্মী, ডাক্তার, নার্স, সাংবাদিক—অনেকে জীবনের ঝুঁকি নিয়েও মানবতার পক্ষে দাঁড়িয়ে আছেন। রেডক্রসসহ বহু আন্তর্জাতিক সংস্থা চেষ্টা করে যাচ্ছে কিছু করার, কিছু বাঁচিয়ে রাখার। আমরা জানি না—এই গণহত্যা কবে শেষ হবে। তবুও আমরা আশার বুক বাঁধি। কারণ ফিলিস্তিনের জাতীয় কবি মাহমুদ দারবিশ এক অমর কবিতায় আমাদের এই অসীম অপেক্ষার ব্যথা এমনই করে উচ্চারণ করেছিলেন—
সে বলল, কবে আমাদের দেখা হবে?
বললাম, যেদিন যুদ্ধ শেষ হবে।
সে বলল, কবে যুদ্ধ শেষ হবে?
বললাম, যেদিন আমাদের দেখা হবে।
তবে গাজা কি হেরে যাবে? ইসরায়েল কি পুরো প্যালেস্টাইন দখলে নেবে? ইতিহাস বলে, না। আমাদের সুন্দরবন বারবার প্রাকৃতিক দুর্যোগে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েও প্রকৃতির শক্তিতেই আবার ঘুরে দাঁড়িয়েছিল। তেমনি গাজাও দাঁড়াবে। কেউ না কেউ সালাউদ্দিন আইয়ুবী হয়ে আসবে। মহান সৃষ্টিকর্তার রহমত, করুণা এই মাটি আবার গ্রহণ করবে। কারণ, এই জাতির রক্তে, জিনে, নিউরনে মিশে আছে স্বাধীনতার সংকেত। তারা মরে, কিন্তু দাগ রেখে যায়। তাদের মৃত্যু অন্যকে পথ দেখায়।
প্রথম বিশ্বযুদ্ধের সময়, ইহুদি বিজ্ঞানী ড. হেইস বাইজম্যানের আবিষ্কারে খুশি হয়ে ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রী জানতে চেয়েছিলেন, তিনি কী পুরস্কার চান? বাইজম্যান বলেছিলেন—অর্থ নয়, আমার জাতির জন্য একটুকরো ভূমি, আর সেটি হোক ফিলিস্তিন। এরপর থেকেই শুরু হয় সেই কালো অধ্যায়। ব্রিটিশরা মানসিকভাবে প্রস্তুত হতে থাকে। ফিলিস্তিন দখলের পরিকল্পনায় যুক্ত হয় ইহুদি বলয়। ১৯৪৮ সালের ১২ মে রাত ১২টা এক মিনিটে ঘোষণা করা হয় ইসরায়েল রাষ্ট্রের। দশ মিনিটের মধ্যে যুক্তরাষ্ট্র স্বীকৃতি দেয়, এরপর সোভিয়েত ইউনিয়ন, তারপর ব্রিটেন। এভাবেই এক জাতির স্বপ্নভঙ্গের, এক ভূখণ্ডের লুণ্ঠনের সূচনা ঘটে।
ইহুদিরা নিজেরাই একসময় ছিল নির্যাতিত। কিন্তু তারা ভুলে গেছে সেই ইতিহাস। আজ তারাই নির্যাতক। আর ফিলিস্তিন? তাঁরা হারিয়েছে ভূমি, স্বাধীনতা, জীবন। অনেক বছর আগে আমার এক কাশ্মীরি বন্ধু ওবায়েদ বলেছিল—“আমরা ক্লান্ত। অনেক আত্মত্যাগ করেছি, এখন শুধু বাঁচতে চাই।” কিন্তু ফিলিস্তিনিরা ক্লান্ত নয়। তাঁরা আজও প্রতিরোধ করছে। শতাব্দী ধরে, প্রজন্ম ধরে। বিশ্ব বিবেক তাঁদের পাশে থাকুক বা না থাকুক, তাঁরা লড়বে।
প্যালেস্টাইনের জাতিসত্তা হারাবে না। তাঁদের মননে বিপ্লব, রক্তে স্বাধীনতা। ইসরায়েলের অস্ত্র, বুলেট—তাঁদের দমাতে পারবে না। কারণ তাঁরা ইতিহাস রচনার জাতি।
জয় হোক গাজার, জয় হোক মানবতার। অবসান হোক দখলদারিত্বের…..

লেখক : আলমগীর মুহাম্মদ ফারুকী, অতিরিক্ত জেলা ও দায়রা জজ, ব্রাক্ষণবাড়িয়া।