মোশাররফ হোসাইন : খতিয়ান দিয়ে মালিকানাস্বত্ব সৃষ্টি করতে পারে কিনা সেই আলোচনায় যাওয়ার আগে খতিয়ান কি তা আমাদের জানতে হবে। খতিয়ান শব্দের অর্থ হিসাব, ইংরেজিতে যাকে বলা হয় Record of Rights. স্বত্ব সংরক্ষণের উদ্দেশ্য দখল সংরক্ষণ ও সরকারের রাজস্ব আদায়ের উদ্দেশ্য জরিপ বিভাগ কর্তৃক প্রত্যেক মৌজার জমির মালিক, মালিকের ঠিকানা, হিস্যা (অংশ) জমির দাগ নম্বর, জমির পরিমাণ,জমির শ্রেণী, খাজনা ইত্যাদি বিবরণ সম্বলিত যে দখল স্বত্বের রেকর্ড প্রস্তুত করা হয় তাকে খতিয়ান বলে। স্বাক্ষ্য আইনের ৭৪ ধারা মোতাবেক, খতিয়ান একটি পাবলিক ডকুমেন্টস।
এখন মূল আলোচনায় যাওয়ার আগে একটা উদাহরণ দিলে আলোচনা বুঝতে সুবিধা হবে। “ক” একটি রেজিষ্ট্রেশন দলিল মূলে এক খন্ড জমি ক্রয় করেন এবং বিগত আর এস খতিয়ানে তার নাম রেকর্ড হয়। “ক” মৃত্যুর সময় ওয়ারিশ হিসেবে রেখে যান তার পুত্র “খ” কে কিন্তু সর্বশেষ খতিয়ানে “খ” এর পরিবর্তে “গ” এর নামে রেকর্ড হয়। “গ” কি উক্ত সর্বশেষ রেকর্ড অনুযায়ী জমির মালিকানা দাবি করতে পারবে? “খ” কি প্রতিকার পেতে পারে?
সহজ উত্তর হলো এখানে “গ” উক্ত জমির মালিকানা দাবি করিতে পারে না কারন “গ” এর নামে সর্বশেষ খতিয়ান লিপিবদ্ধ হইলেও তিনি প্রকৃতপক্ষে জমির মালিক না। “খ” ওয়ারিশ সূত্রে উক্ত জমির মালিক। যেহেতু খতিয়ান কারো অনুকূলে মালিকানাস্বত্ব সৃষ্টি করেনা সেহেতু “গ” সর্বশেষ খতিয়ান মূলে জমির মালিকানা দাবি করতে পারে না।
এখন আসি মূল আলোচনায় খতিয়ান কি মালিকানাস্বত্ব সৃষ্টি করতে পারে? খতিয়ান কখনো মালিকানাস্বত্ব সৃষ্টি করতে পারে না। কারো নাম খতিয়ানে লিপিবদ্ধ দ্বারা যেমন কারো স্বত্ব সৃষ্টি হয় না তেমনি কারো নাম খতিয়ানে লিপিবদ্ধ না হলেও তার মালিকানাস্বত্ব বিলুপ্তি হয় না। তবে খতিয়ান শুধুমাত্র দখল প্রমাণের উত্তম সাক্ষ্য এবং মালিকানা প্রামণে সহায়ক সাক্ষ্য হিসেবে ব্যবহৃত হতে পারে।
আরও পড়ুন : ভূমি সেবায় ভোগান্তি কমাতে ‘ল্যান্ড সার্ভিস গেইটওয়ে’ চালুর উদ্যোগ
সুতরাং খতিয়ান কারো অনুকূল মালিকানাস্বত্ব সৃষ্টি করে না। স্বত্বহীন ব্যক্তির নাম খতিয়ানে লিপিবদ্ধ দ্বারা তার স্বত্ব সৃষ্টি হয় না, পাশাপাশি কারো নাম খতিয়ানে লিপিবদ্ধ না করার কারনে তার স্বত্ব নষ্ট হয় না। (59 D.L.R 60 D.LR 207) চান মাহমুদ বনাম হোসাইন আলী (৩ বিএলসি ৩৬৪) মামলায় উচ্চ আদালত বলেন সি.এস খতিয়ান জমির দখল ও মালিকানা সম্পর্কে অনুমান সৃষ্টি করতে পারে।
এই মামলা থেকে বুঝা যায় মালিকানা অনুমান করা আর মালিকানাস্বত্ব সৃষ্টি করা এক বিষয় না। এছাড়া সাধারণ বীমা কর্পোরেশন বনাম সিলেট পৌরসভা (72 D.L.R 2020 HCD 181) মামলায় উচ্চ আদালত বলেন কোন ব্যাক্তি যদি অন্য কোন ভাবে মালিকানাস্বত্ব না থাকে তাহলে শুধুমাত্র খতিয়ানে নাম লিপিবদ্ধ দ্বারা কেউ মালিকানাস্বত্ব দাবি করতে পারে না। তবে খতিয়ান শুধু বর্তমান দখল প্রমাণের সাক্ষ্য হিসেবে ব্যবহৃত হতে পারে।
সুতরাং খতিয়ান, খাজনা রশিদ, নামজারি খতিয়ান দখল প্রমাণের সাক্ষ্য হিসেবে ব্যবহৃত হয় কিন্তু সম্পত্তিতে মালিকানাস্বত্ব সৃষ্টি করতে পারে না।
খতিয়ানে ভুল নাম লিপিবদ্ধ হলে করণীয়
জরিপ কাজ করতে গিয়ে অনেক সময় জরিপ কর্মকর্তারা ভূমির প্রকৃত মালিকের তথ্য উদঘাটন করতে পারে না।জরিপ চলমান থাকা অবস্থায় অনেকে অন্য জায়গায় অবস্থান করায়, মেয়েরা বিবাহের পরে শ্বশুর বাড়িতে বসবাস করায় প্রকৃত মালিকের নাম খতিয়ানে লিপিবদ্ধ করা যায় না।আবার অনেক সময় ভাইয়েরা বোনদের কে বঞ্চিত করার জন্য ইচ্ছাকৃত ভাবে তাদের কোন বোন নাই মর্মে জরিপ কর্মকর্তাদের বলে তাই স্বাভাবিক ভাবে ভাইদের নাম খতিয়ানে লিপিবদ্ধ হইলেও বোনদের নাম খতিয়ানে লিপিবদ্ধ হয় না।
খতিয়ানে ভুল থাকলে সংশোধনের জন্য আদালতে মামলা দায়ের করতে হবে। সাধারণত দুইভাগে মামলা দায়ের করা যায়।
১. সুনির্দিষ্ট প্রতিকার আইনের ৪২ ধারা মোতাবেক ঘোষণামূলক মামলা দায়ের করা যায়।
২. রাষ্ট্রীয় অধিগ্রহণ ও প্রজাস্বত্ব আইন (S.A.T. Act) এর ১৫৪ (ক) ধারায় গঠিত ল্যান্ড সার্ভে ট্রাইবুন্যালে খতিয়ান সংশোধনের মামলা করা যায়।
লেখক : আইনজীবী, জজ কোর্ট, ঢাকা