রাজধানীর উত্তরা পশ্চিম থানায় দায়ের করা আবদুল জব্বার হত্যাচেষ্টা মামলায় গ্রেপ্তার আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালের (আইসিটি) সাবেক প্রসিকিউটর তুরিন আফরোজকে চার দিন রিমান্ডে নিয়ে জিজ্ঞাসাবাদ করার অনুমতি দিয়েছেন আদালত।
পুলিশের আবেদনের পরিপ্রেক্ষিতে ঢাকার চিফ মেট্রোপলিটন ম্যাজিস্ট্রেট আদালত আজ মঙ্গলবার (৮ এপ্রিল) এ আদেশ দেন।
আদালত-সংশ্লিষ্ট সূত্রগুলো বলছে, আবদুল জব্বার হত্যাচেষ্টা মামলায় তুরিন আফরোজকে সাত দিন রিমান্ডে নিয়ে জিজ্ঞাসাবাদ করার আবেদন করে পুলিশ। রাষ্ট্রপক্ষ থেকে বলা হয়, বৈষম্যবিরোধী ছাত্র-জনতার আন্দোলন চলাকালে আবদুল জব্বার গুলিবিদ্ধ হন।
অন্যদিকে আসামিপক্ষ থেকে তুরিন আফরোজকে রিমান্ডে নেওয়ার আবেদন নাকচ করে তাঁর জামিনের আবেদন করা হয়। এদিন আদালতে এ মামলার রিমান্ড শুনানিতে আদালতের অনুমতি নিয়ে নিজের অবস্থান তুলে ধরেন তুরিন।
যুদ্ধাপরাধের বিচারে ২০১০ সালে গঠিত আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালেয় প্রসিকিউটর ছিলেন আইনজীবী তুহিন আফরোজ। জামায়াতে ইসলামীর আমির গোলাম আযমের মামলাসহ গুরুত্বপূর্ণ বেশ কয়েকটি মামলা পরিচালনায় তিনি ভূমিকা রাখেন।
জাতীয় নিরাপত্তা গোয়েন্দা সংস্থা (এনএসআই) ও পাসপোর্ট অধিদপ্তরের সাবেক মহাপরিচালক (ডিজি) মুহাম্মদ ওয়াহিদুল হকের বিরুদ্ধে একাত্তরের যুদ্ধাপরাধ মামলা চলার মধ্যে তার সঙ্গে গোপন বৈঠকের ঘটনায় ২০১৯ সালের ১১ নভেম্বর ট্রাইব্যুনালের প্রসিকিউটর পদ থেকে তুরিনকে অপসারণ করে তখনকার আওয়ামী লীগ সরকার।
২০১৮ সালের সংসদ নির্বাচনে প্রতিদ্বন্দ্বিতার জন্য আওয়ামী লীগের মনোনয়ন চেয়েছিলেন তুরিন। গতবছর অগাস্টে অভ্যুত্থানে সরকার পতনের পর আওয়ামী লীগ ঘনিষ্ঠ অনেকের মত তার বিরুদ্ধেও কয়েকটি মামলা হয়।
এর মধ্যে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের সময় আব্দুল জব্বার নামের এক শিক্ষার্থীকে ‘হত্যাচেষ্টার’ মামলায় সোমবার রাতে উত্তরার বাসা থেকে তুরিন আফরোজকে গ্রেপ্তার করে পুলিশ। মঙ্গলবার তাকে আদালতে হাজির করে দশ দিনের রিমান্ডের আবেদন করেন উত্তরা পশ্চিম থানার এসআই সুমন মিয়া।
আরও পড়ুন : হত্যাচেষ্টা মামলায় গ্রেফতার ব্যারিস্টার তুরিন আফরোজ
রাষ্ট্রপক্ষে ঢাকা মহানগরের পাবলিক প্রসিকিউটর ওমর ফারুক ফারুকী রিমান্ডের পক্ষে শুনানি করেন।
তিনি বলেন, “তুরিন আফরোজ আলোচিত, বিতর্কিত মানুষ। ফ্যাসিস্ট হাসিনার শাসনামলে হাসিনার পক্ষে মিডিয়াতে তুমুল বক্তব্য দিতেন। হাসিনাকে সমর্থন করে বিরোধীদের আন্দোলন সংগ্রামের বিরুদ্ধে বক্তব্য দিতেন। ফ্যাসিজম রক্ষার জন্য বক্তব্য রাখতে সহযোগিতা করতেন।
“তার এধরনের বক্তব্য রাখার এবং সহযোগিতার দুটি উদ্দেশ্য ছিল। এক হল হাসিনার আনুকূল্য লাভ করে বড় পদ পাওয়া। আরেকটি হল পৈত্রিক সম্পত্তি থেকে মা, ভাইকে বঞ্চিত করে দখলে রাখা।”
রাষ্ট্রপক্ষের এ আইনজীবী বলেন, “প্রথমটা অর্জন করেছিলেন। ন্যক্কারজনক আদালত আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল তৈরি করা হয়েছিল। পুরস্কারস্বরূপ প্রসিকিউটর হিসেবে নিয়োগ পান। নিয়োগ হওয়ার পর আসামিদের বিরুদ্ধে বক্তব্য ও তাদের নিয়ে কটূক্তি করেন। পরে আবার আসামিদের পক্ষে গিয়ে বড় ধরনের আর্থিক লেনদেনের অভিযোগ রয়েছে। ন্যক্কারজনক ঘটনা ঘটিয়ে প্রসিকিউটর পদ থেকে অব্যাহতি পান।”
তিনি বলেন, ছাত্র-জনতার আন্দোলনের সময় ‘বিতর্কিত ভূমিকা পালন করায়’ নীলফামারীর জলঢাকায়ও তুরিনের বিরুদ্ধে হত্যাচেষ্টা মামলা হয়েছে।
“মামলা হলেই কিন্তু সব আসামিকে ধরা হচ্ছে না। যাদের বিরুদ্ধে অভিযোগ, তাদেরই গ্রেপ্তার করা হচ্ছে। ৫ অগাস্টের পর বিভিন্ন জায়গায় মিছিল, মিটিং হয়েছে। হাসিনা তাদের ফেলে রেখে পালিয়ে গেছে। তারা জয় বাংলা ব্রিগেড তৈরি করে দেশকে অস্থিতিশীল, সরকারকে উৎখাতের চেষ্টা করছেন।
“হাসিনাকে ফিরিয়ে আনার প্রচেষ্টা তারা চালিয়ে যাচ্ছেন। তুরিন আফরোজ এর সাথে সম্পৃক্ত। তাকে অবজারভেশনে রাখা হয়। বিভিন্ন সরকারবিরোধী কর্মকাণ্ডে জড়িত থাকায় গ্রেপ্তার করা হয়েছে। হত্যাচেষ্টা মামলার সাথেও সম্পৃক্ত। তার ১০ দিনের রিমান্ড মঞ্জুরের প্রার্থনা করছি।”
তুরিন আফরোজের পক্ষে শুনানি করতে কয়েকজন আইনজীবী আদালতে উপস্থিত হন। তবে তুরিন আফরোজ আদালতকে জানান, তার আইনজীবী আছে। তখন বিচারক জানতে চান, কে তার আইনজীবী। তুরিন আফরোজ বলেন, “সাইফুল করিম।”
তবে তাকে খুঁজে না পেয়ে তুরিন আফরোজ বলেন, “মাননীয় আদালত, আমি আপনার অনুমতি নিয়ে কথা বলতে চাই।”
আদালত অনুমতি দিলে তুরিন আবারও বিচারককে বলেন, “আমি দুই, তিন, পাঁচ মিনিট–কতটুকু সময়ে শেষ করব বললে ভালো হয়।”
বিচারক তখন তাকে বলেন, “বলেন আপনি।”
আরও পড়ুন : যৌতুকের মিথ্যা মামলায় সাজা পেলেন অভিযোগকারী নারী, খালাস ৬৭ বছরের বৃদ্ধ আসামি
তখন তুরিন আফরোজ বলেন, “৪ তারিখে আমার বিরুদ্ধে নীলফামারীতে মামলা। পরদিন ৫ অগাস্ট ঢাকায় মামলা…।”
বিচারক তখন তাকে থামিয়ে দিয়ে বলেন, “ঢাকায় মামলা হয়েছে ২৭ মার্চ। ঘটনা ৫ অগাস্টের। নীলফামারীর তথ্য এখানে নেই।”
তুরিন তখন বলেন, “আচ্ছা, যাই হোক।”
তিনি বলেন, “আমার লার্নেড ফ্রেন্ড (রাষ্ট্রপক্ষের আইনজীবী) সাংঘর্ষিক কথা বলেছেন। নীলফামারীতে ৪ অগাস্ট এবং ঢাকায় ৫ অগাস্টের ঘটনায় মামলা। মামলাগুলো ফেব্রিকেটেড। ৫ অগাস্টের আগে পুরো সময় কোথায় ছিলাম সব ডকুমেন্ট দিতে পারব। সে সময় আমার টিউমারের অপারেশন হয়।”
তুরিন আফরোজ বলেন, “আমি আইনের প্রতি আস্থাশীল। কেউ আইনের ঊর্ধ্বে না। তদন্ত কর্মকর্তা ১০ দিনের রিমান্ড চেয়েছে। আপনি ২০ দিন দিলেও দিয়ে দেন। কারণ আমি জানি, আমি কোনো অন্যায় করিনি। আমি ন্যায়বিচার পাব।’
ব্যারিস্টার তুরিন রিমান্ড শুনানিতে বলেন, “গত চার বছর আমি মিডিয়াতে কিছু বলিনি, কিছু লিখিনি। বলা হচ্ছে, ফ্যাসিস্ট হাসিনাকে সাপোর্ট করেছি। ফ্যাসিস্ট হাসিনাকে সাপোর্ট করলাম। আবার তার আমলেই চাকরি থেকে বঞ্চিত হয়েছি। ৬ বছর ধরে চাকরি থেকে বঞ্চিত। বুঝলাম না আমি কোন পক্ষের লোক!”
শুনানি শেষে আদালত তুরনিকে চার দিনের রিমান্ডে পাঠানোর আদেশ দেন।
এ মামলার বিবরণে বলা হয়, আন্দোলনে সরকার পতনের দিন ৫ অগাস্ট দুপুর ১২টার দিকে আব্দুল জব্বার উত্তরা পশ্চিম থানাধীন ঢাকা-ময়মনসিংহ মহাসড়কের ওপর বিএনএস সেন্টারের সামনে গুলিবিদ্ধ হন। পরে ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে চিকিৎসা নেন তিনি।
গত ২৭ মার্চ উত্তরা পশ্চিম থানায় সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাসহ ৫০ জনের নাম উল্লেখ করে এবং ১০০/১৫০ জনকে অজ্ঞাতনামা আসামি করে এ মামলা দায়ের করেন তিনি। মামলার আসামির তালিকায় ৩০ নম্বরে রয়েছে তুরিন আফরোজের নাম।