ধ'র্ষ'ণ মামলার বিচার ৩০ দিনের মধ্যে শেষ করা সম্ভব কি না?
মাসুদুর রহমান

বাংলাদেশে অনলাইন বিবাহ ও তালাক নিবন্ধন: একটি যুগান্তকারী পরিবর্তন

মাসুদুর রহমান : বাংলাদেশে প্রযুক্তির অগ্রগতির সাথে সাথে প্রশাসনিক সেবাসমূহকে সহজ ও জনবান্ধব করার লক্ষ্যে সরকার বিভিন্ন পদক্ষেপ গ্রহণ করছে। এরই ধারাবাহিকতায় সম্প্রতি বিবাহ ও তালাক নিবন্ধনের প্রক্রিয়া অনলাইনে নিয়ে আসা হয়েছে, যা দেশের নাগরিকদের জন্য এক নতুন সুযোগের দ্বার উন্মোচন করেছে। নতুন আইনের অধীনে, এখন থেকে মুসলিম বিবাহ ও তালাকের রেজিস্ট্রেশন অনলাইনের মাধ্যমে করা যাবে। কাজী অফিসে না গিয়েও নির্ধারিত ওয়েবসাইটের মাধ্যমে প্রয়োজনীয় তথ্য দিয়ে সহজে নিবন্ধন করা যাবে।

বিবাহ ও তালাক মুসলিম পারিবারিক আইনের গুরুত্বপূর্ণ অংশ। দীর্ঘদিন ধরে বাংলাদেশে বিবাহ ও তালাকের নিবন্ধন প্রক্রিয়া ছিল হাতে লেখা ও কাজী অফিস-নির্ভর। এতে দুর্নীতি, জালিয়াতি, রেকর্ড হারানোর ঘটনা ছিল সাধারণ। তথ্যপ্রযুক্তির প্রসারে সরকার অনলাইন রেজিস্ট্রেশন চালু করেছে, যা এক যুগান্তকারী উদ্যোগ।

নতুন ব্যবস্থাটি বাস্তবায়িত হয়েছে স্থানীয় সরকার বিভাগ, ইসলামিক ফাউন্ডেশন ও তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তি মন্ত্রণালয়ের যৌথ উদ্যোগে। আইনটি মুসলিম বিবাহ ও তালাক রেজিস্ট্রেশন পদ্ধতির আধুনিকীকরণ করে:

• অনলাইন আবেদন: বর-কনে বা তাদের প্রতিনিধি অনলাইনে বিবাহের জন্য আবেদন করতে পারেন।

• ডিজিটাল সনদ প্রদান: সফল রেজিস্ট্রেশনের পর সরকার কর্তৃক ডিজিটাল সনদ সরবরাহ করা হয়।

• তথ্য যাচাই: জাতীয় পরিচয়পত্র (NID) এর মাধ্যমে স্বয়ংক্রিয় যাচাই।

• মোবাইল পেমেন্ট: রেজিস্ট্রেশন ফি বিকাশ, নগদ, রকেট ইত্যাদির মাধ্যমে পরিশোধযোগ্য।

• সেন্ট্রাল ডেটাবেইজ: সকল নিবন্ধন তথ্য একটি নিরাপদ কেন্দ্রীয় সার্ভারে সংরক্ষিত হয়।

এই অনলাইন ব্যবস্থায় ব্যবহৃত হচ্ছে নিরাপদ লগ-ইন, ডিজিটাল সিগনেচার, এনআইডি যাচাই ব্যবস্থা ও সেন্ট্রাল ডেটাবেইজ। এতে তথ্যের গোপনীয়তা ও সুরক্ষা বজায় থাকে এবং ডেটা লস বা ভুলের সম্ভাবনা হ্রাস পায়।

এই ব্যবস্থার সুবিধাসমূহ

  • বাল্যবিবাহ ও বহুবিবাহ রোধ

স্বয়ংক্রিয় বয়স যাচাই এবং পূর্ববর্তী বিবাহের তথ্য ডাটাবেসে সংরক্ষণের মাধ্যমে বাল্যবিবাহ ও একাধিক বিয়ের ঘটনা কমে যাবে। উদাহরণস্বরূপ, বিবাহ নিবন্ধনে জাতীয় পরিচয়পত্র (এনআইডি) বা জন্ম নিবন্ধন সনদ বাধ্যতামূলক করা হয়েছে।

  • নারী অধিকার সুরক্ষা

বৈধ নিবন্ধন নারীদের সম্পত্তির অধিকার, উত্তরাধিকার, এবং আইনি সুরক্ষা নিশ্চিত করছে। তালাক রেজিস্ট্রেশন বাধ্যতামূলক হওয়ায় অনেক নারী যারা আগে তালাকপ্রাপ্ত হলেও তা প্রমাণ করতে পারতেন না, এখন তারা আইনি অধিকার পেতে সক্ষম হবেন।

  • প্রতারণা হ্রাস

ডিজিটাল রেকর্ডের কারণে বিবাহিত ব্যক্তিরা নতুন বিয়ে গোপন করতে পারেন না, যা সামাজিক জটিলতা কমাবে।

  •  সময় ও শ্রমের সাশ্রয়

অনলাইন সেবার ফলে মানুষকে আর কাজী অফিসে বা ইউনিয়ন পরিষদে ঘণ্টার পর ঘণ্টা অপেক্ষা করতে হয় না। ঘরে বসেই এই কাজ সম্পন্ন করা সম্ভব।

  • দুর্নীতির সম্ভাবনা হ্রাস

অনলাইন রেজিস্ট্রেশনে ফি ও তথ্য সবকিছু স্বচ্ছভাবে প্রদর্শিত হয়। ফলে অতিরিক্ত অর্থ আদায়ের সুযোগ কমে যায়।

  • তথ্য সংরক্ষণ ও ভবিষ্যতের রেফারেন্স

অনলাইনে নিবন্ধনের ফলে বিবাহ ও তালাক সংক্রান্ত তথ্যগুলো সহজে সংরক্ষণ ও খুঁজে পাওয়া সম্ভব হয়, যা ভবিষ্যতে আইনি বা প্রশাসনিক প্রয়োজনে সহায়ক হতে পারে।

  • ডিজিটাল বাংলাদেশ বাস্তবায়নে সহায়ক

এই পদক্ষেপ দেশের ডিজিটাল রূপান্তরের পথে এক গুরুত্বপূর্ণ মাইলফলক।

তবে, এই সুবিধার মধ্যেও কিছু গুরুত্বপূর্ণ চ্যালেঞ্জ রয়ে গেছে—যেমন ডিজিটাল সাক্ষরতার অভাব, কাজীদের প্রশিক্ষণের ঘাটতি এবং সাইবার নিরাপত্তা ঝুঁকি। এসব চ্যালেঞ্জ মোকাবেলায় সরকারকে একটি সমন্বিত কর্মপরিকল্পনা প্রণয়ন করতে হবে, যার মধ্যে থাকবে ধারাবাহিক প্রশিক্ষণ, প্রযুক্তিগত সহায়তা, ব্যবহারকারী-বান্ধব মোবাইল অ্যাপ্লিকেশন, এবং জনসচেতনতামূলক কার্যক্রম।

পরিশেষে বলতে পারি যে, বাংলাদেশে অনলাইন বিবাহ ও তালাক নিবন্ধন ব্যবস্থা আইনি সংস্কার, প্রযুক্তির ব্যবহার এবং সামাজিক সুরক্ষার সমন্বয়ে একটি যুগান্তকারী পদক্ষেপ। যদিও প্রযুক্তিগত সীমাবদ্ধতা, ফি বৃদ্ধি এবং সাংস্কৃতিক প্রতিবন্ধকতা চ্যালেঞ্জ হিসেবে রয়ে গেছে। এই উদ্যোগ নারী অধিকার সুরক্ষা ও প্রশাসনিক স্বচ্ছতায় গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখতে পারে। ভবিষ্যতে এই ব্যবস্থার পরিসর আরও বিস্তৃত হলে এবং সকল ধর্মীয় ও সামাজিক গোষ্ঠী এতে অন্তর্ভুক্ত হলে বাংলাদেশে পারিবারিক আইনের প্রয়োগ আরও কার্যকর, গ্রহণযোগ্য ও মানবিক হয়ে উঠবে—এমনটিই প্রত্যাশা।

লেখক : আইনজীবী , বাংলাদেশ সুপ্রিম কোর্ট । E-mail : masud.law22@gmail.com