জেলা আইনজীবী সমিতির নির্বাচন

চট্টগ্রাম বার নির্বাচন: মনোনয়ন ফরম সংগ্রহে বাধা, অভিযোগ আওয়ামীপন্থীদের

চট্টগ্রাম আইনজীবী সমিতির নির্বাচনে মনোনয়নপত্র সংগ্রহের নির্ধারিত দিনে বিএনপি-জামায়াত সমর্থিত প্রার্থীরা ছাড়া অন্য কেউ ফরমই তুলতে পারেননি বলে অভিযোগ উঠেছে।

আওয়ামী লীগ ও বাম ধারার আইনজীবীরা বলছেন, কয়েক দফায় মনোনয়নপত্র সংগ্রহ করার চেষ্টা করেও তারা ‘বাধার মুখে’ ফিরে আসতে বাধ্য হয়েছেন।

এমনকি এলডিপি সমর্থিত এবং জননিরাপত্তা ট্রাইব্যুনালের বর্তমান পিপিও সভাপতি পদের প্রার্থী হতে ফরম নিতে গিয়ে বাধার মুখে পড়ার কথা বলেছেন।

গতকাল বৃহস্পতিবার (১০ এপ্রিল) এ ঘটনা ঘটে। এদিন ছিল মনোনয়ন ফরম নেওয়ার শেষ দিন। দিন শেষে চট্টগ্রাম জেলা আইনজীবী সমিতির ২১টি পদে মনোয়ন ফরম বিক্রি হয়েছে ২১টিই। আগামী ১৬ এপ্রিল আইনজীবী সমিতির নির্বাচন অনুষ্ঠিত হওয়ার কথা রয়েছে।

আওয়ামীপন্থী আইনজীবী সভাপতি প্রার্থী আবদুর রশিদ, সাধারণ সম্পাদক প্রার্থী ফখরুদ্দিন চৌধুরীসহ চারজন প্রার্থীর সই করা লিখিত অভিযোগ জমা দেন বৃহস্পতিবার জেলা আইনজীবী সমিতির অ্যাডহক কমিটির আহ্বায়ক মকবুল কাদের চৌধুরীর কাছে।

এতে বলা হয়, দুপুরে সমিতির পাঠাগার থেকে মনোনয়ন ফরম কেনার জন্য যান তাঁরা। ওই সময় তাঁদের বাধা দেওয়া হয়। সেখানে আইনজীবীর পাশাপাশি কিছু বহিরাগতও ছিলেন। পরে নির্বাচন পরিচালনা কমিটির কয়েকজন সদস্যকে বলা হলেও তারা কেউ মনোনয়ন ফরম কিনতে যাওয়া আইনজীবীদের সঙ্গে যাননি।

জানতে চাইলে জেলা আইনজীবী সমিতির অ্যাডহক কমিটির আহ্বায়ক মকবুল কাদের চৌধুরী বলেন, ‘সাত থেকে আটটি অভিযোগ পেয়েছি। সব নির্বাচন কমিশনকে দিয়ে দিয়েছি।’

তবে মুখ্য নির্বাচনী কর্মকর্তা তারিক আহমেদ বলেন, ‘বিকেল চারটার পর অ্যাডহক কমিটির আহ্বায়ক থেকে অভিযোগগুলো পেয়েছি। ওই সময়ের পর কী করার আছে।’

আরও পড়ুন : চট্টগ্রাম বারের ৮৬৭ আইনজীবীর সদস্যপদ বাতিল

আওয়ামী লীগ সমর্থিত আইনজীবীরা বলছেন, গত ১৬ বছরে চট্টগ্রাম জেলা আইনজীবী সমিতির নির্বাচনে সকল মত ও পথের আইনজীবীরা অংশগ্রহণ করেছে। তখন ভোটে অংশ নিতে কাউকে বাধা দেওয়া হয়নি।

মঙ্গলবার ঘোষিত তফসিল অনুসারে বৃহস্পতিবার বেলা ২টা থেকে ৪টা পর্যন্ত সমিতির কার্যালয়ের লাইব্রেরি থেকে ফরম বিতরণের কথা ছিল।

সে অনুসারে বিএনপি-জামায়াত সমর্থিত প্যানেল আইনজীবী ঐক্য পরিষদের প্রার্থীরা একে একে ফরম সংগ্রহ করেন।

আগে আওয়ামী লীগ সমর্থিত আইনজীবীরা চট্টগ্রাম বারে আইনজীবী সমন্বয় পরিষদের ব্যনারে নির্বাচনে অংশ নিতেন। এবার শুরু থেকেই আওয়ামী ও সমমনারা স্বতন্ত্র প্রার্থী হিসেবে নির্বাচনে অংশগ্রহণের কথা জানায়।

আগের তফসিলেও তারা স্বতন্ত্র হিসেবে ফরম নিয়েছিলেন। এবারও প্রার্থী হতে বৃহস্পতিবার বেলা আড়াইটার দিকে তারা একযোগে মনোনয়ন ফরম সংগ্রহ করতে যান।

সভাপতি পদে প্রার্থী হতে ইচ্ছুক আবদুর রশিদ বলেন, “আমরা স্বতন্ত্র প্রার্থী হিসেবে ফরম নিতে গিয়েছিলাম। ১০ ফেব্রুয়ারি যে নির্বাচন হওয়ার কথা ছিল তাতেও আমি সভাপতি প্রার্থী ছিলাম। আজ ফরম নিতে গিয়ে দেখি বিএনপি-জামায়াতের আইনজীবীরা লাইব্রেরিতে নির্বাচন কমিশনের কার্যালয় দখল করে রেখেছে।”

“তারা আমাদের ফরম সংগ্রহ করতে বাধা দেয়। আমরা কোনো ঝামেলায় যাইনি। ফিরে এসে অ্যাডহক কমিটিকে সব জানাই। অ্যাডহক কমিটির পরামর্শে আবারও ফরম নিতে যাই। তখনও আমাদের বাধা দেওয়া হয়। কিন্তু আমরা কোনো ঝামেলায় যাইনি।”

আওয়ামী সমর্থিত আইনজীবীদের নেতা ও সমিতির সাবেক সাধারণ সম্পাদক এ এইচ এম জিয়া উদ্দিনের নেতৃত্বে তারা অ্যাডহক কমিটিকে বিষয়টি জানান। অ্যাডহক কমিটি আবারও ফরম নিতে চেষ্টা করতে বলে তাদের আশ্বস্ত করেন।

দ্বিতীয় দফায় যখন আওয়ামী ও সমমনারা ফরম নিতে যান, সেসময় লাইব্রেরির বাইরে অবস্থান নেওয়া আইনজীবীদের একটি পক্ষ ‘ফ্যাসিস্ট’ ও ‘ফ্যাসিস্টের দোসর’ বলে স্লোগান দিতে থাকেন। নির্বাচন কমিশনাররা যে কক্ষে ছিলেন, তার সামনে তারা অবস্থান নিয়ে ছিলেন।

সাবেক পিপি আবদুর রশিদ বলেন, “শুধু আমাদের নয়, একজন এলডিপি করা আইনজীবীকেও তারা ফরম নিতে দেয়নি। তারা খালি পোস্টে গোল দিতে চায়।”

তিনি বলেন, “পুরো বিষয়টি জানিয়ে আমরা অ্যাডহক কমিটিকে লিখিত অভিযোগ করেছি। দেখি তারা কী ব্যবস্থা নেয়।”

আরও পড়ুন : চট্টগ্রাম জেলা আইনজীবী সমিতির নির্বাচন ১৬ এপ্রিল

সভাপতি প্রার্থী হতে ইচ্ছুক জননিরাপত্তা ট্রাইব্যুনালের বর্তমান পিপি ও এলডিপি নেতা শাহাদাত হোসেন ফরম নিতে যান বেলা আড়াইটায়।

ঘটনার বর্ণণা দিয়ে শাহাদাত হোসেন বলেন, “আমি ফরম নিতে প্রয়োজনীয় টাকা ও কাগজপত্র নিয়ে নির্বাচন কমিশনের সামনে হাজির হই। কিন্তু তারা আমাকে ফরম নিতে দেবে না। এসময় আমাকে ধাক্কা দিয়ে তারা বের করে দেয়।”

“অথচ ২১টি পদে নির্বাচন কমিশন ২১টি ফরম বিক্রি করেছে। বাধাদানকারীরা বলছে, ফ্যাসিবাদের দোসরদের নির্বাচনে অংশ নিতে দেবে না। আমি তো ফ্যাসিবাদের দোসর না। আমি একজন পিপি হয়ে ফরম নিতে পারিনি। কোথায় গণতন্ত্র, কোথায় মানবাধিকার? সমিতির ইতিহাসে এরকম কোনো নজির নেই।”

শাহাদাত হোসেন যখন মনোনয়ন ফরম তুলতে যান, সেসময়ের একটি ভিডিও সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ছড়িয়ে পড়েছে।

তাতে দেখা যায়, শাহাদাত হোসেন নির্বাচন কমিশনের মুখ্য নির্বাচন কর্মকর্তা অ্যাডভোকেট তারিক আহমদকে বলছেন, তিনি সভাপতি পদে একটি ফরম নিতে আগ্রহী।

এসময় তারিক আহমদ তাকে বসতে বলেন এবং তার সাথে কথা বলার আগ্রহ প্রকাশ করেন। তখনই কয়েকজন আইনজীবী মুখ্য নির্বাচন কর্মকর্তা তারিক আহমদকে ইতিপূর্বে ফরম নেওয়া প্রার্থীদের সাথে ছবি তুলতে জোর করতে থাকেন।

তারিক আহমদ নিজের চেয়ারে বসে তাদের দিকে অবাক দৃষ্টিতে তাকিয়ে ছিলেন। এক পর্যায়ে বাধাদানকারীরা শাহাদাত হোসেনকে বলেন, এখনো সময় আছে আপনি পরে ফরম তুলেন। পরে কয়েকজন এসে তাকে বাইরে নিয়ে যায়।

শাহাদাত হোসেন বলেন, “ফরম নিতে না পেরে আমি অ্যাডহক কমিটির কাছে গিয়েছিলাম। অ্যাডহক কমিটির আহ্বায়ক ফোন করলে মুখ্য নির্বাচন কর্মকর্তা প্রথমবার কল রিসিভ করেন। পরে তিনি আর ফোন ধরেননি।”

বাধা দেওয়ার অভিযোগ নিয়ে প্রশ্ন করলে বিএনপি-জামায়াত সমর্থিত আইনজীবী ঐক্য পরিষদের সভাপতি প্রার্থী অ্যাডভোকেট আবদুস সাত্তার বলেন, “আমরা ২১ জন ফরম নিয়েছি। অন্যরা ফরম নিতে না এসেই কুৎসা রটনা করছে। তাদের সৎ সাহস নেই। ফ্যাসিবাদবিরোধী আন্দোলনের সময় যারা ছাত্র-জনতার উপর লাঠি নিয়ে হামলা করেছিল, তারাই এসব প্রচার করছে।”

“জুলাই আন্দোলনের সময় কারা ছাত্রদের ওপর এখানে হামলা করেছিল তার ভিডিও ফুটেজ আছে। সাধারণ আইনজীবীরা তাদের বিপক্ষে। ফ্যাসিস্ট ছাড়া নির্বাচন করবেন বলে দাবি করেছেন সাধারণ আইনজীবীরা।”

আরও পড়ুন : রোববার পার্বত্য তিন জেলায় বন্ধ থাকবে আদালত

বিনা প্রতিদ্বন্দ্বীতায় নির্বাচিত হতে যাচ্ছেন কিনা–এমন প্রশ্নের জবাবে আবদুস সাত্তার বলেন, “মাত্র ফরম তোলা হয়েছে। কাল বাছাই হবে। শনিবার চূড়ান্ত প্রার্থী তালিকা প্রকাশ করা হবে। তারপর প্রতিদ্বন্দ্বী না থাকলে হয়ত রোববার আমাদের বিজয়ী ঘোষণা করা হবে। সেটা নির্বাচন কমিশন ভালো বলতে পারবে।”

গত ১০ ফেব্রুয়ারি চট্টগ্রাম জেলা আইনজীবী সমিতির নির্বাচন অনুষ্ঠিত হওয়ার কথা ছিল। এর আগে ৪ ফেব্রুয়ারি নির্বাচন পরিচালনায় গঠন করা কমিটির মুখ্য নির্বাচনী কর্মকর্তা মোহাম্মদ সোলায়মানসহ পাঁচ কর্মকর্তা একযোগে পদত্যাগ করেন।

নির্বাচনে অংশ নেওয়া বিএনপি ও জামায়াত-সমর্থিত আইনজীবী ঐক্য পরিষদ এবং আওয়ামী লীগ-সমর্থিত আইনজীবী সমন্বয় পরিষদের উত্তেজনাকর পরিস্থিতিকে কেন্দ্র করেই পদত্যাগের সিদ্ধান্ত নিয়েছেন বলে জানিয়েছেন নির্বাচনী কর্মকর্তারা।

পদত্যাগ করার কারণ হিসেবে চিঠিতে বলা হয়েছে, আওয়ামী লীগ-সমর্থিত সম্মিলিত আইনজীবী সমন্বয় পরিষদ নির্বাচনে সেনাবাহিনী ও বিজিবি মোতায়েনের জন্য নির্বাচন কমিশন ও জেলা আইনজীবী সমিতিতে আবেদন করে।

অন্যদিকে বিএনপি ও জামায়াত জোট-সমর্থিত আইনজীবী ঐক্য পরিষদ নির্বাচন কমিশন বরাবর আরেকটি আবেদন করে সমন্বয় পরিষদের প্রার্থীদের মনোনয়ন বাতিলের দাবি জানায়।

এরপর ১৬ ফেব্রুয়ারি চট্টগ্রাম জেলা আইনজীবী সমিতিতে পাঁচ সদস্যের অ্যাডহক কমিটি গঠিত হয়। দুই মাসের মধ্যে তারা নির্বাচনের প্রস্তুতি নেয়। গত মঙ্গলবার জেলা আইনজীবী সমিতির তফসিল ঘোষণা করা হয়। – সব তথ্য ও লেখা হুবহু রেখে লেখাটি এসইও ফ্রেন্ডলি করে লিখে দাও