জমি, জজ আর জট- বিচার ব্যবস্থায় নীরব দুর্যোগ!
আবদুল কাদের

জমি, জজ আর জট- বিচার ব্যবস্থায় নীরব দুর্যোগ!

আবদুল কাদের : অনেক দেওয়ানি মামলার রায় লিখতে গিয়ে দেখলাম- দিস্তা দিস্তা কাগজে বছরের পর বছর ধরে অস্পষ্ট হাতে লেখা সাক্ষীদের জবানবন্দি ও জেরা মামলার সিদ্ধান্ত গ্রহণে কোন কাজেই আসছে না, যথাযথ ও সঠিক রায় প্রদানের জন্য দলিল ও রেকর্ডপত্রই যথেষ্ট। চট্টগ্রামের ৩য় যুগ্ম জেলা জজ আদালতে যোগদান করে আমি অবাক! প্রায় দশ হাজার মামলা সে আদালতে। প্রতিদিন তিনশটা করে তারিখ দিলে মাসে ৩০০×২০= ৬০০০; দশ হাজারের তারিখ ফেলতে দেড় মাসের বেশি সময় লাগে; অর্থাৎ প্রতিদিন তিনশটি করে মামলা শুনানির জন্য তারিখ দিলে দেড় মাস পর পর আর প্রতিদিন ৩০টি করে রাখলে দেড় বছর পর পর এক একটি মামলার তারিখ দিতে হয়, কি ভয়ংকর কথা!
আরও দেখলাম, প্রতিদিন বিশটার বেশি মামলা কজলিস্টে সাক্ষ্য গ্রহণের জন্য ধার্য করা আছে, তার উপর ফৌজদারী মামলা আছে আরও বেশি সংখ্যক। এত্তগুলা মামলায় সাক্ষ্য নিতে কত ঘন্টা লাগবে! আরও আছে বিচিত্র রকমের লক্ষ কোটি পিটিশন। মাশাল্লাহ, চট্টগ্রামে কিছু উকিল সাহেব আছেন যারা খুব ক্রিয়েটিভ ও উদ্ভূত রকমের পিটিশন দিতে ওস্তাদ, যেগুলো বিচারককে খুবই চিন্তায় ফেলে দিতে পারে; তার এক একটা নিষ্পত্তি করতেই আইন, কানুন, ঘটনা ও যুক্তির মহাসমুদ্র পাড়ি দিতে হয়; ব্যাপারটা সময় সাপেক্ষ হলেও enjoyable & Intellectually pursuing.
খোঁজ নিয়ে জানলাম- এখানে নাকি দুপুরের দিকে বলে দেয়া হয়, “এই এই কয়েকটি মামলায় সাক্ষী হবে, বাকিরা চলে যান, তারিখ হবে”। সকাল থেকে সাক্ষী দাতা মক্কেলরা হাজির হয়ে বসে আছেন, উকিল সাহেবকে সাক্ষী নেয়ার জন্য ফিস দিয়েছেন, মোহরারকে খরচ দিয়েছেন; আরও কত কি তদ্বির, ঘুষ, ঘাস!! তবুও আজ নাকি সাক্ষী নেয়া হবে না— এই অবস্থায় তাদের হতাশা আর অভিশাপ এর মাত্রা কোন পর্যায়ে গিয়ে ঠেকে ! কি করা যায়! বলা শুরু করলাম, “সাক্ষীর জন্য ধার্য সব মামলায়ই সাক্ষ্য গ্রহণ করা হবে, সবাই থাকেন।” এখন কেমনে সম্ভব! কত ঘন্টা সাক্ষ্য লিখব, কত ঘন্টা আর্গুমেন্ট আর কত ঘন্টা বিচিত্র সেই অতি ক্রিয়েটিভ পিটিশন! রায়! রায় কখন কেমনে লিখব !
উপস্থিত সব সাক্ষীর সাক্ষ্য গ্রহণ শুরু করলাম। কৌশল- আংশিক, যে পাতায় লেখা শুরু করি সেই পাতা লেখা হলেই বন্ধ, লুজ সিট নেয়ার নিয়ম বাতিল। তেমন ভাল কিছু করতে পারিনি, মন্দের ভাল, একদম খালি হাতে বিদায় দেয়ার চেয়ে ভাল। আইন আছে একশটির বেশি মামলা শুনানিতে থাকবে না, যে আদালতে দশ হাজার মামলা, সেখানে এই নিয়ম হাস্যকর। বাকিগুলোর কি হবে!!
নতুন নিয়মে জবানবন্দি গ্রহণ থেকে রক্ষা করা গেলে কিছুটা উন্নতি হবে, শুনানি আরও দ্রুত শেষ হবে। সমন জারিতে মিশাইল নিয়োগ করলেও কোন লাভ নাই, কারণ দ্রুত সমন জারি করে কি করবেন? এত মামলার সাক্ষ্য গ্রহণ ও রায় লিখবে কে?? একজন জজ কতটি রায় লিখতে পারেন !
দ্রুত মামলা নিষ্পত্ত না হওয়ার অন্তত এক হাজারটি কারণ আছে, জ্ঞানী লোকেরা গবেষণা করে কারণ গুলো বের করেছেন, সমাধানও তারা বাতলাচ্ছেন। বাহ বাহ! সাধু সাধু! সাবাস!
প্রায় দেড় যুগ এই লাইনে জান বাজি রেখে কাজ করে অধমের বিশ্বাস: দ্রুত মামলা নিষ্পত্তির পথে একটাই বাধা, তা হল- জনসংখ্যা, মামলার সংখ্যা, বিরাজমান আইনের শাসনের চরম অভাব ইত্যাদির তুলনায় বিচারক সংখ্যা হাস্যকর। এই আসল সমস্যাটা সেসব জ্ঞানী লোকেদের মাথায় মোটেই ঢুকছে না।
একটি আদালতে স্বাভাবিক ও যুক্তিসঙ্গত মামলার সংখ্যা হল- ৩০০টি। আমাকে তিনশ মামলা দিয়ে বসাই দিয়ে দেখেন, দ্রুত ও কাঙ্খিত ন্যায় বিচার কাকে বলে দেখিয়ে দিব ইনশা আল্লাহ, দেখি কে মামলায় বিলম্ব ঘটাতে আসে, কেমনে !!! একটি একটি নথি ধরব, কি সমস্যা? কোন সে দুষ্ট লোক আটকাই রেখেছে! কোন প্রসেস সার্ভার সমন আটকিয়ে রেখেছে, কে সে! কোন উকিল সাহেব অযথা সময় চান, কেন, কি সমস্যা, ওকে কাল আসেন, পরশু আসেন, আসতেই হবে, রক্ষা নাই। প্রতিদিন তিনশটা হলে ! ডাকতে ডাকতেই তো তিনশ মিনিট= ৫ ঘন্টা শেষ। কত ঘন্টায় দিন!!!!!
আজগুবি এক দেশ, আজগুবি কারবার!! ছোট একটি দেশে জনসংখ্যা অতি বেশি, জমি নিয়ে কাড়াকাড়ি, জানের থেকে জমির গুরুত্ব বেশি, জমি নিয়ে ঠেলাঠেলি থাকবেই, ভূমি অফিসে দুর্নীতি চরম, জরিপে-খতিয়ানে অনাচার আর নামজারিতে ভুলভ্রান্তি, অনেক মামলা তো হবেই; আইনের শাসনের চরম অভাব, জনগণের নাগরিক অধিকার ব্যাপক হারে লঙ্ঘনের শিকার, বেশি সমস্যা, বেশি অধিকার লঙ্ঘন, বেশি মামলার কারণ, বেশি মামলা তো হবেই; এমন একটি আঠার কোটি জনগনের দেশে বিচারক আঠার শত, হাস্যকর! চরম হাস্যকর !!! জনগণকে বিচার দেয়ার নামে ঠাট্টা-মশকরা!!!
কেউ কেউ নাকি মনে করেন- মামলা বহু বর্ষজীবী বেগুন গাছ, বহু বছর ধরে মাসে মাসে এতে হাজার টাকার বেগুন ধরে। সেই বহুবর্ষজীবী বেগুন গাছ তো এখন বহু যুগজীবী বট গাছ হয়ে যাচ্ছে, দেশে মোট তেতাল্লিশ লক্ষ মামলা চলছে, সারা দেশের সব নাগরিকের জীবন দিনে দিনে মামলার ছায়ার নিচে পড়ে স্যাঁতস্যাঁতে হয়ে যাচ্ছে!
এই তেতাল্লিশ লক্ষ মামলার নথিতে দেশের ও জনগনের আশা, আকাঙ্খা, ব্যবসা, বাণিজ্য, অর্থনৈতিক কর্মকান্ড, উন্নয়ন, সুখ ও স্বপ্ন আটকে পড়ে আছে। চলমান মামলা নিষ্পত্তি হয়ে গেলে বেগুনের ফলন কমে যাবে- এমন একটি ভুল ধারণা প্রচলিত আছে। ভুল ধারণা- কারণ লক্ষ লক্ষ মামলা যোগ্য ঘটনা ঘটছে যে বিষয়গুলা নিয়ে মামলাই হচ্ছে না; সেই বিচারগুলো সালিশে, থানার গোল চত্বরে, দালালে, ঠগে, বকে খেয়ে নষ্ট করে ফেলছে; ঠকে গিয়েও মানুষ মেনে নিচ্ছে; মামলার ফাঁদে কয়েক যুগের জন্য আটকে পড়তে কেউ ভরসা পাচ্ছে না; একদম মামলা ছাড়া যদি কোন উপায় নাই, তবেই শুধু মামলা হচ্ছে। চলমান মামলা গুলোতে দ্রুত ন্যায় বিচার পেতে দেখলে জনগন আরও কয়েক গুন বেশি মামলা করবে, বেগুনের উৎপাদন মোটেও কমবে না।
আগের দিনে শ্রমিকেরা কোদাল দিয়ে মাটি কাটতো, এখন এস্কেভেটর দিয়ে একজন লোক হাজার জনের মাটি কাটার কাজ করে ফেলতেছে। কিন্তু দুনিয়ার কোন জাতি একজন লোক দিয়ে লক্ষ কোটি লোকের বিচার দ্রুত করে ফেলার কোন মেশিন আজও বানাতে পারে নাই, বরং তারা সুশাসনের মাধ্যমে জনগণের অধিকার লঙ্ঘন কমিয়ে আনার অনেক কার্যকর পথ উদ্ভাবন করেছে, তাদের জনসংখ্যানুপাতে বিচারকের সংখ্যাও অনেক বেশি, আমেরিকায় প্রতি দশ হাজারে একজন, মামলাও অনেক কম, দ্রুত জনগণ ন্যায় বিচার পাচ্ছে। এক দিকে মামলার নথি দিলে আরেক দিক দিয়ে রায় বেরিয়ে আসবে- এমন একটি মেশিন মনে হয় বাংলাদেশেই প্রথম আবিষ্কার হবে, নইলে উপায় কি !!!
লেখক : অতিরিক্ত জেলা জজ, কক্সবাজার।