মাসুদুর রহমান: ভারতীয় নতুন ওয়াকফ (সংশোধনী) আইন, ২০২৫ নিয়ে মুসলিম সম্প্রদায়ের মধ্যে গভীর উদ্বেগ ও ক্ষোভ সৃষ্টি হয়েছে। অনেক বিশেষজ্ঞ ও ধর্মীয় নেতা এই আইনের সমালোচনা করে বলছেন, এটি মুসলিমদের ধর্মীয় অধিকার ও প্রতিষ্ঠানগুলোর উপর রাষ্ট্রের দখলদারির একটি কৌশল। এই আইনকে মুসলিম নিপীড়নের ধারাবাহিকতা ও ইসলামি ধর্মীয় প্রতিষ্ঠানকে দুর্বল করার চেষ্টা হিসেবে দেখা হচ্ছে।
ওয়াকফ কী?
ওয়াকফ হলো ইসলামী আইন অনুযায়ী কোন ব্যক্তি তার সম্পত্তি ধর্মীয় বা জনকল্যাণমূলক কাজে স্থায়ীভাবে দান করলে সেটিকে ওয়াকফ বলা হয়। ভারতে মুসলিম সমাজের বহু মসজিদ, মাদ্রাসা, কবরস্থান এবং জনকল্যাণমূলক প্রতিষ্ঠান এই ওয়াকফ সম্পত্তির উপর নির্ভরশীল।
আইনের মূল সমস্যা ও সমালোচনা
১. অ-মুসলিমদের ওয়াকফ বোর্ডে অন্তর্ভুক্তি
ওয়াকফ সম্পত্তি মূলত মুসলিমদের ধর্মীয় ও জনকল্যাণমূলক কাজে ব্যবহৃত হয়। নতুন আইন অনুযায়ী, কেন্দ্রীয় ও রাজ্য ওয়াকফ বোর্ডে অ-মুসলিমদের সদস্য হিসেবে নিয়োগ দেওয়ার সুযোগ রাখা হয়েছে।
- এই প্রস্তাব মুসলিম সম্প্রদায়ের মধ্যে ভয় তৈরি করেছে যে, অ-মুসলিম প্রশাসকরা মুসলিম ধর্মীয় স্থাপনার কার্যক্রমে হস্তক্ষেপ করতে পারেন।
- এটা মুসলিম ধর্মীয় প্রতিষ্ঠানগুলোর আত্মনিয়ন্ত্রণের পরিপন্থী।
২. জেলা প্রশাসকের হাতে সম্পত্তি সংক্রান্ত ক্ষমতা
আগে ওয়াকফ সংক্রান্ত বিরোধ নিষ্পত্তির জন্য ট্রাইব্যুনাল ছিল, কিন্তু নতুন আইনে জেলা প্রশাসককে সেই ক্ষমতা দেওয়া হয়েছে।
- এতে নিরপেক্ষতা ও বিচারপ্রক্রিয়ার উপর প্রশ্ন উঠেছে।
- মুসলিমরা মনে করছেন, প্রশাসন সরকারের রাজনৈতিক ইচ্ছার সঙ্গে চলে, যা ওয়াকফ সম্পত্তি দখলের রাস্তা তৈরি করতে পারে।
৩. সরকারি জমি ওয়াকফ স্বীকৃতি পাবে না
নতুন আইন অনুসারে, কোনো সরকারি সম্পত্তিকে আর ওয়াকফ হিসেবে স্বীকৃতি দেওয়া হবে না—even যদি ঐতিহাসিকভাবে সেখানে মসজিদ, মাদ্রাসা বা কবরস্থান থেকে থাকে।
• এর ফলে বহু পুরনো মুসলিম ধর্মীয় স্থাপনা তাদের বৈধতা হারাবে এবং ধ্বংসের ঝুঁকিতে পড়বে।
৪. ওয়াকফ ঘোষণার কঠোর শর্ত
একজন ব্যক্তি শুধুমাত্র তখনই ওয়াকফ ঘোষণা করতে পারবেন, যদি তিনি কমপক্ষে ৫ বছর যাবত মুসলিম হয়ে থাকেন এবং সম্পত্তির বৈধ মালিক হন।
- এটি ঐতিহ্যবাহী “user-based waqf” ব্যবস্থার পরিপন্থী, যেখানে কোনো ব্যক্তি নিজে ব্যবহার না করেও ধর্মীয় উদ্দেশ্যে জমি দান করতে পারতেন।
ওয়াকফ সম্পত্তি অধিগ্রহণের পথ সুগম
অল ইন্ডিয়া মুসলিম পার্সোনাল ল’ বোর্ড (AIMPLB) অভিযোগ করেছে যে, এই বিলের মাধ্যমে ওয়াকফ সম্পত্তি সরকার সহজেই দখল করতে পারবে।
- বোর্ডের মতে, বহু বিতর্কিত ও প্রভাবশালী সম্পত্তি সরকারী প্রকল্পের নামে দখলের ঝুঁকিতে পড়বে।
উদাহরণ: উত্তরপ্রদেশে ২০২০ সালে ৩০০টি ওয়াকফ সম্পত্তি “সড়ক নির্মাণ” এর নামে অধিগ্রহণ করা হয়, যা পরে বেসরকারি হোটেল নির্মাণে ব্যবহৃত হয়।
মুসলিম নিপীড়নের ধারাবাহিক হাতিয়ার?
এই আইনকে শুধু প্রশাসনিক বা আইনি পরিবর্তন হিসেবে দেখা হচ্ছে না; বরং এটি মুসলিম নিপীড়নের ধারাবাহিক নীতির অংশ বলেই মনে করছেন অনেকেই। উদাহরণ হিসেবে:
- বাবরি মসজিদ ধ্বংস: মুসলিমদের ধর্মীয় স্মৃতি ও স্থাপনার উপর আঘাত।
- CAA এবং NRC: মুসলিমদের নাগরিকত্ব ও আইনি অবস্থান নিয়ে সংশয় তৈরি করেছে।
- গরু রক্ষার নামে মুসলিম নিপীড়ন ও লিঞ্চিং: ধর্মীয় পরিচয়ের ভিত্তিতে সহিংসতা বেড়েছে।
- মসজিদের উপর হামলা ও নামাজে বাধা: ধর্মীয় স্বাধীনতা হরণ।
এই প্রেক্ষাপটে ওয়াকফ আইন সংশোধন মুসলিম সমাজের ধর্মীয় ও সাংস্কৃতিক প্রতিষ্ঠানকে দুর্বল করে রাষ্ট্রের নিয়ন্ত্রণে নেওয়ার একটি কৌশল বলে আশঙ্কা করা হচ্ছে।
আশার দিক হচ্ছে ভারতের সুপ্রিম কোর্ট যদিও এখনো সম্পূর্ণভাবে ওয়াকফ (সংশোধনী) আইন, ২০২৫-এর কার্যকারিতা স্থগিত করেনি। তবে, আদালত কিছু বিতর্কিত ধারার উপর আংশিক স্থগিতাদেশ জারি করেছে এবং পরবর্তী শুনানি পর্যন্ত কয়েকটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ে নিষেধাজ্ঞা দিয়েছে।
সুপ্রিম কোর্টের আংশিক স্থগিতাদেশের মূল বিষয়সমূহ
- অ-মুসলিমদের ওয়াকফ বোর্ডে নিয়োগ স্থগিত আদালত নির্দেশ দিয়েছে যে, পরবর্তী শুনানি পর্যন্ত কেন্দ্রীয় ও রাজ্য ওয়াকফ বোর্ডে অ-মুসলিমদের কোনো নিয়োগ করা যাবে না। যদি কোনো রাজ্য এই নিয়োগ করে, তবে তা বাতিল বলে গণ্য হবে।
- ওয়াকফ সম্পত্তির চরিত্র পরিবর্তনে নিষেধাজ্ঞা
“ওয়াকফ বাই ইউজার” সহ কোনো ওয়াকফ সম্পত্তি, যা ইতিমধ্যে নোটিফাইড বা রেজিস্টার্ড, তা ডিনোটিফাই করা যাবে না বা তাদের চরিত্র পরিবর্তন করা যাবে না ।
পরিশেষে বলতে পারি যে, ওয়াকফ (সংশোধনী) আইন ২০২৪ কোনো নিরপেক্ষ প্রশাসনিক উদ্যোগ নয়, বরং এটি মুসলিম সম্প্রদায়ের ধর্মীয় প্রতিষ্ঠান ও সম্পত্তির উপর নিয়ন্ত্রণ আরোপের একটি পদক্ষেপ। এই আইনের মাধ্যমে মুসলিমদের ওপর নিপীড়ন ও বঞ্চনার ধারাবাহিকতা আরও গভীর ও কাঠামোগত হয়ে উঠছে। গত এক দশকে মুসলিম বিরোধী সহিংসতা, NRC-CAA বিতর্ক, এবং ধর্মীয় পোলারাইজেশনের প্রেক্ষাপটে এই বিলকে “সংখ্যালঘুদের উপর রাষ্ট্রীয় আক্রমণ” হিসেবেই দেখা হচ্ছে। দ্রুত এই আইন বাতিল করতে হবে।
লেখক : আইনজীবী, বাংলাদেশ সুপ্রিম কোর্ট। E-Mail : masud.law22@gmail.com