বাংলাদেশের কুমিল্লায় ছয়জন অভিজ্ঞ ও সম্মানিত আইনজীবীকে আটক এবং জনসম্মুখে লাঞ্ছনার ঘটনায় ফ্রান্সভিত্তিক মানবাধিকার সংগঠন JusticeMakers Bangladesh in France (JMBF) গভীর উদ্বেগ প্রকাশ করছে এবং এই ঘটনার তীব্র নিন্দা জানাচ্ছে। সংগঠনটি মনে করে, এই মামলাটি রাজনৈতিক উদ্দেশ্যপ্রণোদিত এবং কাল্পনিক ভিত্তিতে দায়ের করা হয়েছে, যার সূত্রপাত হয়েছে ২০২৪ সালের আগস্ট মাসের বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনকে কেন্দ্র করে।
সোমবার (২১ এপ্রিল) কুমিল্লার জ্যেষ্ঠ জেলা ও দায়রা জজ মো. মাহবুবুর রহমান ছয়জন জ্যেষ্ঠ আইনজীবীকে বিচারিক হেফাজতে পাঠানোর নির্দেশ দেন।
আটক হওয়া ব্যক্তিরা হলেন: অ্যাডভোকেট মোস্তাফিজুর রহমান লিটন, অ্যাডভোকেট জাহাঙ্গীর আলম ভূঁঞা, অ্যাডভোকেট জাকির হোসেন ও অ্যাডভোকেট সাইফুল ইসলাম। তারা সবাই কুমিল্লা আইনজীবী সমিতির সাবেক সভাপতি, সাধারণ সম্পাদক ও অন্যান্য নেতৃত্বের দায়িত্ব পালন করেছেন এবং বহুদিন ধরে ন্যায়বিচার ও মানবাধিকারের পক্ষে কাজ করে আসছেন।
JMBF মনে করে, এই মামলা একটি উদ্দেশ্যপ্রণোদিত ষড়যন্ত্রের অংশ, যেখানে অভিযোগকারী ছাত্রনেতা ঘটনার ছয় মাস পর মামলা দায়ের করেন। অভিযোগের পেছনে নেই কোনও স্বচ্ছতা বা গ্রহণযোগ্য প্রমাণ। সবচেয়ে উদ্বেগজনক বিষয় হলো, আদালত প্রাঙ্গণে এই আইনজীবীদের যখন কারাগারে পাঠানো হচ্ছিল, তখন রাজনৈতিকভাবে প্রভাবিত একটি দল তাদের উপর ডিম নিক্ষেপ করে, যার একটি সরাসরি অ্যাডভোকেট মোস্তাফিজুর রহমান লিটনের গায়ে লাগে। এই অপমানজনক ঘটনাটি আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীর উপস্থিতিতে ঘটলেও কোনো নিরাপত্তা প্রদান করা হয়নি।
এই ঘটনার মাধ্যমে বাংলাদেশের সংবিধানের বেশ কয়েকটি মৌলিক ধারা স্পষ্টভাবে লঙ্ঘিত হয়েছে, যেমন—ধারা ২৭ (আইনের দৃষ্টিতে সকলের সমতা), ধারা ৩৩ (যথেচ্ছ গ্রেপ্তার ও আটক থেকে সুরক্ষা), এবং ধারা ৪০ (আইনসম্মত পেশা চর্চার স্বাধীনতা)। সংবিধানের এই মৌলিক অধিকারগুলো অমোচনীয় এবং যেকোনো সরকার বা প্রশাসনের জন্য তা রক্ষা করা বাধ্যতামূলক।
আরও পড়ুন : কুমিল্লায় চার আইনজীবী কারাগারে, দুইজনের বিরুদ্ধে পরোয়ানা
বাংলাদেশ আন্তর্জাতিক অঙ্গনেও এসব অধিকার রক্ষায় বাধ্য, কারণ দেশটি আন্তর্জাতিক নাগরিক ও রাজনৈতিক অধিকার সংক্রান্ত চুক্তি (ICCPR) এবং সর্বজনীন মানবাধিকার ঘোষণা (UDHR)-এর সদস্য। ICCPR-এর ১৪ নম্বর ধারা অনুযায়ী, বিচারাধীন ব্যক্তিকে নিরপেক্ষ আদালতে অপরাধ প্রমাণ না হওয়া পর্যন্ত নির্দোষ হিসেবে বিবেচনা করতে হবে। ৯ নম্বর ধারা অনুযায়ী, যেকোনো ধরনের ইচ্ছামতো গ্রেপ্তার বা আটক নিষিদ্ধ।
JMBF গভীরভাবে উদ্বিগ্ন যে, এই ঘটনা জাতিসংঘের আইনজীবীদের ভূমিকা সংক্রান্ত মৌলিক নীতিমালার (UN Basic Principles on the Role of Lawyers) পরিপন্থী, যেখানে বলা হয়েছে আইনজীবীদের পেশাগত কাজকর্মে বাধা, হুমকি বা হয়রানি করা যাবে না।
ফরাসি মানবাধিকার কর্মী ও JMBF-এর প্রধান উপদেষ্টা রবার্ট সাইমন বলেন,
“অন্তর্বর্তী প্রশাসন অধ্যাপক মুহাম্মদ ইউনূসের অধীনে যেভাবে বিচারব্যবস্থা এবং আইনশৃঙ্খলা বাহিনীকে ব্যবহার করা হচ্ছে, তা বাংলাদেশে গণতান্ত্রিক রূপান্তরের পথে গুরুতর সংকেত দেয়।”
JMBF-এর প্রতিষ্ঠাতা ও সভাপতি, মানবাধিকার আইনজীবী অ্যাডভোকেট শাহানুর ইসলাম বলেন,
“একটি মামলায় কুমিল্লা বারের ৩২ জন আইনজীবীকে আসামি করা এবং ১৫০-২০০ জনকে অজ্ঞাত আসামি দেখানো একটি পরিকল্পিত পদ্ধতিগত দমন-পীড়নের প্রমাণ। এটি শুধুমাত্র ব্যক্তিগত আক্রমণ নয়, বরং পুরো বিচার বিভাগের স্বাধীনতার ওপর আঘাত।”
JMBF-এর দাবি
-
ছয়জন আইনজীবীর অবিলম্বে ও নিঃশর্ত মুক্তি প্রদান
-
মিথ্যা মামলার প্রত্যাহার
-
মামলার প্রেক্ষাপট, পুলিশের ভূমিকা ও নিরাপত্তা ব্যর্থতা নিয়ে স্বাধীন ও নিরপেক্ষ তদন্ত
-
সরকারের পক্ষ থেকে সংবিধান ও আন্তর্জাতিক মানবাধিকার আইনে দেওয়া প্রতিশ্রুতি পুনঃনিশ্চিত করা
আন্তর্জাতিক আহ্বান
JMBF জাতিসংঘ, আন্তর্জাতিক আইনজীবী সংগঠনসমূহ, ইউরোপীয় ইউনিয়ন এবং বিশ্বের সব গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রের প্রতি আহ্বান জানায়, তারা যেন এই মানবাধিকার লঙ্ঘনের বিষয়টি গুরুত্বের সঙ্গে কূটনৈতিক ও মানবাধিকার চ্যানেলের মাধ্যমে উত্থাপন করে এবং অন্তর্বর্তী প্রশাসনকে এর জন্য জবাবদিহির আওতায় আনে।
একটি জাতির নৈতিকতা বিচার হয় সে কিভাবে দুর্বলদের রক্ষা করে, ক্ষমতাবানদের নয়। বাংলাদেশ তার আইনজীবীদের কণ্ঠ রোধ করতে পারে না—কারণ, ন্যায়বিচারহীন রাষ্ট্রে শান্তি ও গণতন্ত্র টিকে থাকতে পারে না।
JusticeMakers Bangladesh in France (JMBF) পরিস্থিতি নিবিড়ভাবে পর্যবেক্ষণ করছে এবং এই ন্যায়ের লড়াইয়ে ক্ষতিগ্রস্তদের পাশে দৃঢ়ভাবে দাঁড়িয়ে রয়েছে।