আবদুল্লাহ আল মামুন : “প্রথম আলো”-পত্রিকা পড়তে গিয়ে শাজনীনের সাথে আমার প্রথম পরিচয়। এই মেয়েটি ছিলো আমাদেরই সমবয়সী। শাজনীন হত্যাকাণ্ডের পর প্রতিবছর ঐ পত্রিকার প্রথম কিংবা শেষের পাতায় দেখা যেতো একজন শ্যামলা মুখচ্ছবির মিষ্টি কিশোরী মেয়ের ছবি ছাপা হয়েছে। মেয়েটির চোখে এই আশ্চর্য নীরবতা। আমার কিংবা আমাদের সকলের জীবন এগিয়েছে। কিন্তু,শাজনীন ২৩/০৪/১৯৯৮ খ্রিঃ তারিখে স্থির হয়ে আছে। প্রতি বছর এই তারিখে প্রথম আলো পত্রিকায় তার ছবি ছাপা হয়। এই বছরও শাজনীনের ছবি ছাপা হয়ছে। মেয়েটি এখনো সেই ২৪ বছর আগের মতো একই অন্তর্ভেদী দৃষ্টিতে চেয়ে আছে। নীচে শোকাতুর পরিবারের শ্রদ্ধা, ভালোবাসা মিশ্রিত আহাজারি এবং প্রার্থনা। হয়তো “প্রথম আলো” পত্রিকা যতদিন ছাপা হবে, ততদিন শাজনীন সেই একই ১৫ বছর বয়সে স্থির হয়ে আমাদের দিকে চেয়ে থাকবে। কি নির্মম,আশ্চর্য সৌভাগ্যবতী! কিন্তু,ওর দৃষ্টির পেছনে কি ভয়ানক বিষণ্ণতা!
আমরা বড় হয়ে ওর মামলার গল্প পড়েছি। তার পরিবার রায়ে সন্তুষ্ট হয়েছে কিনা জানা সম্ভব নয়। আমরা তাই আদালতে সাক্ষ্য প্রমাণে উঠে আসা বিচারের আইনী গল্পটা বলছি এবং সেটি অবশ্যই তার এবং তার পরিবারের প্রতি সর্বোচ্চ সম্মান অক্ষুণ্ণ রেখে।এর বাইরেও তার পরিবারে নিশ্চয়ই ভিন্ন গল্প বা বক্তব্য থাকবে। সে গল্প নিঃসন্দেহে একান্তই তার পরিবারের। শাজনীনের মামলাটিতে আইনের অনেকগুলো Principles যেমন উল্লেখ করা হয়েছে, ঠিক তেমনি শাস্তি নির্ধারণ বা প্রদানের ক্ষেত্রেও কিছু Principles তৈরি হয়েছে। আমাদের আলোচনা তাই শুধুই ঘোষিত রায়ের পর্যালোচনা এবং সিদ্ধান্ত সংশ্লিষ্ট ।
শাজনীন হত্যা মামলা-ধর্ষণ এবং নৃশংসভাবে হত্যাকাণ্ড-শরীরে ২৩টি ছুরিকাঘাতের চিহ্ন-অভিযুক্তের দুইটি ১৬৪ ধারার বক্তব্য- Syed Sajjad Mainuddin Hasan vs State,70 DLR (AD)(2018) 70, (Nazmun Ara Sultana J) (বিচারপতি নাজমুন আরা সুলতানা অধঃস্তন আদালত হতে আপীল বিভাগে গমনকারী বাংলাদেশের প্রথম নারী বিচারপতি এবং সাবেক মহাপরিচালক, বিচার প্রশাসন প্রশিক্ষণ ইন্সটিটিউট, ঢাকা)-শাজনীন তাসনীম রহমান ছিলেন বিশিষ্ট শিল্পপতি লতিফুর রহমানের (ট্রান্সকম গ্রুপের মালিক)(প্রথম আলো পত্রিকার প্রকাশক) কনিষ্ঠ কন্যা। তিনি রাজধানীর স্কলাসটিকা স্কুলের নবম শ্রেণীতে পড়তেন।
মামলায় রাষ্ট্রপক্ষের বক্তব্য অনুযায়ী ২৩/০৪/১৯৯৮ খ্রিঃ তারিখ রাত ০৮:০০-১০:১৫ এর মধ্যে কোন এক সময়ে শাজনীনকে তার নিজের শোবার ঘরে ধর্ষণ এবং হত্যা করা হয়।ঘটনার সময় ঐ বাড়িতে একটি ডিনার পার্টি চলছিলো। ঘটনার পর পর বাড়িতে কর্মরত একজন কর্মচারী শহিদুল ইসলাম@ শহিদ পলাতক হয়ে যাওয়ায় তাকেসহ অজ্ঞাতনামা অভিযুক্ত শাজনীনকে ধর্ষণ ও হত্যা করেছে মর্মে দাবী করে লতিফুর রহমান ৩০২/৩৪ ধারায় মামলা দায়ের করেন। মামলার তদন্তকারী কর্মকর্তা তদন্ত শেষে গৃহভৃত্য অভিযুক্ত শহিদুল ইসলাম@শহীদ, বাড়ির রেনোভেটিং কাজে নিয়োজিত ইঞ্জিনিয়ার সৈয়দ সাজ্জাদ মাইনুদ্দীন হাসান@হাসান,গৃহকর্মী হুমায়ুন কবির@ হুমায়ুন, বাদল,শনিরাম মণ্ডল, পারভীন এবং এজতেমা খাতুন@ মিনু এর বিরুদ্ধে ৩০২/৩৪ ধারায় অভিযোগপত্র দাখিল করেন।
এই মামলায় অভিযুক্ত শহীদ দুইবার ১৬৪ ধারায় দোষ স্বীকারোক্তি প্রদান করেন।অভিযুক্ত মিনু, পারভীনও ১৬৪ ধারায় দোষ স্বীকারোক্তিমূলক বক্তব্য প্রদান করেন। প্রথমবারের ১৬৪ ধারার বক্তব্যে অভিযুক্ত শহীদুল নিজের নাম ছাড়া অন্য কারো নাম বলেননি।কিন্তু,দ্বিতীয়বারের দোষ স্বীকারোক্তিমূলক বক্তব্যে শহীদ অন্যান্য সকল অভিযুক্তের নাম বলেন। ১৬৪ ধারার বক্তব্যসমূহের প্রেক্ষিতে পরবর্তীতে তদন্তকারী কর্মকর্তা নিজেই এজাহারকারী হয়ে উপরোক্ত অভিযুক্তদের বিরুদ্ধে একই ঘটনার জন্য নারী ও শিশু নির্যাতন (বিশেষ বিধান) আইন, ১৯৯৫ আইনের ৬, ১৪ ধারায় ২য় আরেকটি মামলা দায়ের করেন।
২য় এজাহারে তদন্তকারী কর্মকর্তা উল্লেখ করেন- অভিযুক্ত সৈয়দ সাজ্জাদ মাইনুদ্দীন হাসান একজন ইঞ্জিনিয়ার এবং লতিফুর রহমান তাকে বাড়ির মেরামত কাজের জন্য নিয়োজিত করেছিলেন। একদিন কাজের ফাঁকে তিনি শাজনীনের কক্ষে আসেন এবং তাকে বাথরুমের জানালার সমস্যা দেখাতে বলেন। শাজনীন সমস্যা দেখানোর সময় হাসান তাকে জড়িয়ে ধরলে শাজনীন এই ঘটনা (Bathroom Incident) তার বাবাকে জানিয়ে হাসানকে উচিত শিক্ষা দেবেন বলেন। এতে হাসান ক্ষিপ্ত হয়। পরদিন তার বোনদের সাথে মৌলভীবাজারে বেড়াতে যাবেন বলে এবং তার পিতামাতা এর একদিন পর শিলং বেড়াতে যাবার বিষয় ছিলো বলে শাজনীন এই ঘটনা সাথে সাথে তার পিতামাতাকে জানাননি। মৌলভীবাজার গিয়ে শাজনীন এই ঘটনা তার বোন, ভগ্নিপতিদের জানান। তারা সবাই সিদ্ধান্ত নেন, শাজনীনের পিতা-মাতা দেশে ফিরলেই তাদের এই ঘটনা জানানো হবে। কিন্তু, শাজনীনের মা দেশে ফিরেই অসুস্থ হয়ে পড়লে এই ঘটনা আর জানানো হয়নি।
পরবর্তীতে, শাজনীনের মা সুস্থ হয়ে বাড়ি ফেরার পরে ডিনার পার্টির আয়োজন করা হয় এবং ঐ রাতেই শাজনীনকে ধর্ষণের পরে হত্যা করা হয়। হাসান বুঝতে পেরেছিলো শাজনীন তার পিতামাতাকে ঘটনা বলে দিলে সে বিরূপ অবস্থার সম্মুখীন হবে। তাই, সে অন্যান্য অভিযুক্তের সাথে পরিকল্পনা করে শাজনীনকে হত্যা করে প্রতিশোধ নেওয়ার জন্য। এইজন্য সে ডিনার পার্টির দিনটিকেই বেছে নেয়। পরিকল্পনা অনুযায়ী শহীদ শাজনীনকে ধর্ষণ করে হত্যা করে।
তদন্তকারী কর্মকর্তা এই মামলায়ও উপরোক্ত অভিযুক্তদের বিরুদ্ধে নারী ও শিশু নির্যাতন (বিশেষ বিধান)আইন, ১৯৯৫ আইনের অধীনে অভিযোগপত্র দাখিল করেন। ২২ জন সাক্ষীর সাক্ষ্য গ্রহণ শেষে নারী ও শিশু নির্যাতন (বিশেষ বিধান) আইন, ১৯৯৫ এর অধীনে গঠিত বিশেষ আদালত সকল অভিযুক্তকে মৃত্যুদণ্ডে দণ্ডিত করেন। মামলা বিচারাধীন থাকার সময়েই দুইজন অভিযুক্ত মৃত্যুবরণ করেন। সকল দণ্ডিত অভিযুক্তগণ হাইকোর্টে আপীল করেন। হাইকোর্ট সকল অভিযুক্তের মৃত্যুদণ্ড বহাল রাখলে দণ্ডিত ব্যক্তিগণ আপীলেট ডিভিশনে পৃথক পৃথক আপীল দায়ের করেন।আপীল বিভাগ সকল আপীল একসাথে শ্রবণ করেন।হাইকোর্টের রায়-State vs Shahidul Islam,58 DLR(2006)545(Md Ali Asgar khan J)- এ রিপোর্টেড হয়েছে।
হাইকোর্ট আপীল শুনানীর সময় অভিযুক্ত শহীদের দ্বিতীয় দোষ স্বীকারোক্তিমূলক বক্তব্যের উপর নির্ভর করেন। দ্বিতীয় দোষ স্বীকারোক্তিমূলক বক্তব্য দেওয়ার স্বল্প সময়ের মধ্যেই শহীদ তার বক্তব্য প্রত্যাহারের (Retract) আবেদন করেন এবং বলেন,তার প্রথম ১৬৪ ধারার দোষ স্বীকারোক্তিমূলক বক্তব্য সঠিক। দ্বিতীয় দোষ স্বীকারোক্তিতে তিনি নিজের নামসহ অন্যান্য অভিযুক্তের নাম বলেছিলেন। আপীলেট ডিভিশন পর্যালোচনায় বলেন, অভিযুক্তের দ্বিতীয় ১৬৪ ধারার দোষ স্বীকারোক্তি মূলক বক্তব্য সঠিক নয়।প্রথম দোষ স্বীকারোক্তিমূলক বক্তব্যে শহীদ বলেছিলেন-
“… সে(শাজনীন) শ্যামলা ছিলো।তবে সব সময় সাজিয়া থাকতো।ঐ অবস্থায় তাকে দেখতে দেখতে গত কোরবানীর ঈদের ৫/৬ দিন পূর্ব হইতে শাজনীনকে ধর্ষণ করিবার জন্য আমার ইচ্ছা জাগে। যতই শাজনীনকে দেখি ততই আমার এই ইচ্ছা বাড়তে থাকে।আমি তাকে ধর্ষণ করার জন্য সুযোগ খুঁজতে থাকি……”।
অভিযুক্ত শহীদ কর্তৃক অপরাধ করার জন্য আপীল বিভাগ এটিকে যথেষ্ট এবং বিশ্বাসযোগ্য কারণ (Motive) মর্মে গ্রহণ করেন। অভিযুক্ত শহীদ দাবি করেছিলেন তিনি শাজনীনকে হত্যা করেছেন। কিন্তু, ধর্ষণ করেননি। অভিযুক্ত পক্ষের বিজ্ঞ আইনজীবী এই বিষয়ে সুরতহাল এবং পোষ্টমর্টেম রিপোর্টের ফাইন্ডিংস আদালতের নিকট উপস্থাপন করেন। বিজ্ঞ আইনজীবী তার বক্তব্যে বলেন,পোষ্টমর্টেম রিপোর্টে ভিকটিমের শরীরে অভিযুক্ত শহীদের কোন Spermatozoa পাওয়া যায়নি।তাই,ধর্ষণের বিষয়টি প্রমাণিত হয়নি।অভিযুক্ত শহীদ তার ৩৪২ ধারার বক্তব্যেও একই দাবী করেন। পোষ্টমর্টেম রিপোর্ট অনুযায়ী ভিকটিমের শরীরে নিম্ন বর্ণিত আঘাত ছিলো-
“Multiple scratches/abrasions of different sizes and shapes on whole of the right breast”.“Vagina-congested. Abrasion present in RT & LT lateral wall of vagina.Labia Majora-congested & bruised(both).Hymen-ruptured,High vaginal swab examination-No SP seen.RM present.”
After holding post mortem examination and dissection of the wounds, it was the opinion that death was due to hemorrhage and shock as a result of above mentioned injuries which was ante-mortem and homicidal in nature. She was raped before homicide.(Underline Supplied)
সুতরাং, প্রশ্ন ছিলো অভিযুক্তের বীর্যের অনুপস্থিতিতে ধর্ষণ হতে পারে কিনা? এই মামলার সুরতহাল রিপোর্ট অনুযায়ী ভিকটিমের উরুতে এবং যৌনাঙ্গে বীর্য পাওয়া গিয়েছিলো।কিন্তু,পোস্ট মর্টেমকালে বীর্যের উপস্থিতি পাওয়া যায়নি। কিন্তু,হাইমেন ছিন্নবিচ্ছিন্ন ছিলো।অভিযুক্ত শহীদ তার দোষ স্বীকারোক্তিমূলক উভয় ১৬৪ ধারার বক্তব্যে ভিকটিমকে ধর্ষণ করেছিলেন মর্মে বক্তব্য প্রদান করেন।পোষ্টমর্টেম সম্পন্নকারী চিকিৎসক সাক্ষ্য প্রদানকালে বলেছিলেন,ভিকটিম সুস্পষ্টভাবে ধর্ষণের শিকার হয়েছিলেন।সুতরাং,যাবতীয় সাক্ষ্য,প্রমাণ অনুযায়ী ভিকটিমকে ধর্ষণ করা হয়েছিলো মর্মে আদালত সিদ্ধান্ত প্রদান করেন।এছাড়াও আদালত Moinul Haque vs State,56 DLR(AD)81-মামলার সিদ্ধান্ত উল্লেখ করেন।উক্ত মামলায় আদালত বলেছিলেন, শুধুমাত্র Spermatozoa পাওয়া না গেলেই বলা যাবে না যে, ভিকটিম ধর্ষণের শিকার হননি।অর্থাৎ,ভিকটিমের শরীরে Spermatozoa না থাকা বা না পাওয়া-ভিকটিম ধর্ষণের শিকার হননি তার একমাত্র প্রমাণ নয়।
এই বিষয়ে উপরোক্ত মামলায় আদালত বলেন-
“19. The observations in the postmortem examination report to the effect that no spermatozoa was found in the vaginal swab of the victim does not prove at all that victim was not raped before her murder, because presence of Spermatozoa is at all not necessary to prove rape.”
এই বিষয়ে আদালত আরো বলেন-
“It has been settled by so many decisions of the apex courts of this region that even complete penetration is not essential to constitute an offence of rape and even partial penetration with or without emission of semen and rupture of hymen is sufficient to constitute rape. ”
অর্থাৎ, ধর্ষণের অপরাধের ক্ষেত্রে আপীলেট ডিভিশনের স্বতঃসিদ্ধ সিদ্ধান্ত হলো-ধর্ষণের অপরাধের জন্য Complete Penetration এর প্রয়োজন নেই। যদি Rupture of Hymen হয়ে থাকে, Partial Penetration হলেও ধর্ষণের অপরাধ হয়ে যাবে। এক্ষেত্রে অভিযুক্তের বীর্য নির্গত হওয়া বা না হওয়া গুরুত্বপূর্ণ নয়। এই সিদ্ধান্ত আপীলেট ডিভিশন অসংখ্য মামলায় প্রদান করেছেন। শাজনীন হত্যা মামলায়ও ভিকটিমের Vaginal Swab এ Spermatozoa পাওয়া যায়নি।কিন্তু, Hymen Ruptured ছিলো। যৌনাঙ্গে আঘাতের চিহ্ন ছিলো। তাই, আদালত সিদ্ধান্ত প্রদান করেন যে, ভিকটিম মৃত্যুর পূর্বে ধর্ষণের শিকার হয়েছিলেন যা পোষ্ট মর্টেম রিপোর্টেও বলা হয়েছিলো।
শহীদসহ একাধিক অভিযুক্তকে দণ্ড প্রদানের ক্ষেত্রে হাইকোর্ট ভিকটিমের শরীরের আঘাত বিবেচনা করেছিলেন। ভিকটিমের ডান স্তনে বিভিন্ন সাইজের আঁচড়ের, জখমের চিহ্ন ছাড়াও শরীরে ছোট বড় ২৩টি ছুরিকাঘাতের চিহ্ন ছিলো।অর্থাৎ,হত্যাকারী indiscriminately ভিকটিমকে ছুরিকাঘাত করেছিলেন।ভিকটিম যখন বাধা দেওয়ার চেষ্টা করেছিলেন তখন হত্যাকারী ভিকটিমের মুলতঃ শরীরের সামনের দিকের প্রায় সকল অঙ্গে ছুরি দিয়ে আঘাত করেন। এই আঘাতগুলোর দৈর্ঘ্য, প্রস্থ,গভীরতা বিভিন্ন রকমের ছিলো।
আঘাতগুলোর দৈর্ঘ্য, প্রস্থ, গভীরতার বিভিন্নতা লক্ষ্য করে হাইকোর্ট এই বিষয়ে বলেন- ভিকটিমের শরীরে ভিন্ন ভিন্ন দৈর্ঘ্য, প্রস্থ, গভীরতার আঘাত থাকায় স্পষ্ট যে,একাধিক ব্যক্তি একাধিক অস্ত্র হত্যার সময় ব্যবহার করেছিলেন। আপীল বিভাগ এই ফাইন্ডিংস গ্রহণ করেননি। আপীল আদালত বলেন, ছুরি শরীরে কতটুকু প্রবেশ করেছে সেটার উপর নির্ভর করে আঘাতের দৈর্ঘ্য, প্রস্থ,গভীরতা ভিন্ন ভিন্ন হতে পারে। তাই,শুধুমাত্র ভিন্ন ভিন্ন দৈর্ঘ্য, প্রস্থ, গভীরতার আঘাত থাকার কারণে একাধিক ব্যক্তি হত্যাকাণ্ডে অংশগ্রহণ করেছে বা একাধিক অস্ত্র ব্যবহার করা হয়েছে-হাইকোর্টের এই সিদ্ধান্তে উপনীত হওয়াকে আপীল বিভাগ গ্রহণ করেননি।
এই মামলার গুরুত্বপূর্ণ বিষয় ছিলো- অভিযুক্ত হাসানের বাথরুমের ঘটনা (Bathroom incident)। কারণ,এই বিষয়টি থেকেই অভিযুক্ত হাসানের ঘটনার সাথে সংশ্লিষ্টতা শুরু। এই বিষয়কে কেন্দ্র করেই রাষ্ট্রপক্ষ অভিযুক্ত হাসানকে এই মামলায় জড়িয়েছে এবং সাক্ষ্য,প্রমাণ উপস্থাপন করেছে। রাষ্ট্রপক্ষের দাবী ছিলো- অভিযুক্ত হাসান ছিলেন এই হত্যাকান্ডের মূল ব্যক্তি (Master Mind)।তিনিই সম্পূর্ণ ঘটনা পরিকল্পনা করেছিলেন, তারিখ নির্ধারণ করেছিলেন এবং অপর অভিযুক্তদেরকে ঘটনা সংঘটনে নিয়োজিত করেছিলেন। কিন্তু,আপীল বিভাগ সাক্ষ্য, প্রমাণ পর্যালোচনায় বাথরুমের ঘটনাটি অনেক দেরীতে অর্থাৎ,শাজনীনের মৃত্যুরও অনেক দিন পরে প্রকাশ করায় এবং সাক্ষ্য,প্রমাণ দ্বারা সমর্থিত না হওয়ায় বিশ্বাসযোগ্য মর্মে গ্রহণ করেননি।
এই ঘটনায় থানায় প্রথমে হত্যা মামলা দায়ের করা হয়। হত্যা মামলাটিতে অভিযোগপত্র দেওয়ার পরে তদন্তকারী কর্মকর্তা এএসপি মজিবুর রহমান নিজেই এজাহারকারী হয়ে নারী ও শিশু নির্যাতন আইনে মামলা দায়ের করেন।এই মামলাটিতেও অভিযোগপত্র দেওয়া হলে ৩০২/৩৪ ধারার মামলাটি মহানগর অতিরিক্ত দায়রা জজ, ১ম আদালত কর্তৃক নারী ও শিশু নির্যাতন (বিশেষ বিধান) আইনের মামলাটির বিচার সাপেক্ষে স্থগিত (Stay) করা হয়। এই বিষয়ে আপীল বিভাগ বলেন,নারী ও শিশু নির্যাতন( বিশেষ বিধান) আইনে দ্বিতীয় এজাহার রুজু করা সম্পূর্ণ অপ্রয়োজনীয় এবং আইনের ব্যত্যয় ছিলো।
এই ঘটনাটি স্পষ্টভাবে ধর্ষণ এবং হত্যাকাণ্ডের হওয়ায় তদন্তকারী কর্মকর্তার উচিত ছিলো ৩০২/৩৪ ধারার মামলাটিতে ৩০২/৩৪ ধারায় অভিযোগপত্র না দিয়ে নারী ও শিশু নির্যাতন (বিশেষ আইন), ১৯৯৫ এর অধীনে অভিযোগপত্র দাখিল করা। কিন্তু, তদন্তকারী কর্মকর্তা ৩০২/৩৪ ধারার মামলা তদন্ত করতে গিয়ে ধর্ষণের আলামত এবং প্রমাণ পেয়ে ২য় একটি এজাহার দায়ের এবং তাতে অভিযোগপত্র দাখিল করে জটিল আইনগত পরিস্থিতির সৃষ্টি করেছিলেন, যেটি আইন এবং আদালতের কর্মপদ্ধতি সম্পর্কে তার অনভিজ্ঞতা কিংবা অতি উৎসাহী মানসিকতা প্রদর্শন করেছিলো যা সম্পূর্ণ মামলার দ্রুত বিচারে বাঁধার সৃষ্টি করেছিলো।
আদালত বলেন, বিচারিক আদালতের উচিত ছিলো হত্যাকাণ্ডের মামলাটিকে নারী ও শিশু নির্যাতনের আইনের মামলায় পরিবর্তিত (Convert) করা।কিন্তু,একই ঘটনায় দুইটি মামলা ভিন্ন ভাবে অগ্রসর হওয়ায় আদালতের মূল্যবান সময় নষ্ট এবং একই সাথে মামলাটির বিচার নিষ্পত্তিতে দীর্ঘ বিলম্বের কারণ হয়েছে মর্মে আদালত সিদ্ধান্তে উপনীত হন।
উল্লেখ্য যে, এই মামলাটির সম্পূর্ণ বিচারিক প্রক্রিয়া শেষ হতে প্রায় ১৮ বছর সময় লেগেছিলো। বিলম্বের অন্যতম কারণ ছিলো উভয় মামলায় অসংখ্যবার বিভিন্ন বিষয় নিয়ে অভিযুক্তগণের উচ্চ আদালতের দ্বারস্থ হওয়া। সাধারণভাবে যে কর্মকর্তা এজাহার দায়ের করেন,তিনি মামলাটি তদন্ত করেন না। কারণ,একই ব্যক্তি এজাহারকারী এবং তদন্তকারী কর্মকর্তা হলে একই ধরণের অর্থাৎ এজাহারের অনুরূপ তদন্ত রিপোর্টের আশংকা তথা যথাযথ তদন্ত না হওয়ার সম্ভাবনা থাকে। উচ্চ আদালত অসংখ্য সিদ্ধান্তে একই ব্যক্তির এজাহারকারী বা তদন্তকারী কর্মকর্তা হওয়াকে নিরুৎসাহিত করেছেন। এই ধরণের তদন্তকে অবিশ্বাস করে আদালত অভিযুক্তকে খালাস প্রদান করেছেন এমন উদাহরণও বিরল নয়।
এই মামলায় একই তদন্তকারী কর্মকর্তা উভয় মামলার অভিযোগপত্র দাখিল করায় তার মোটিভ সম্পর্কে আদালত সন্দেহ পোষণ করেন এবং আদালতের ফাইন্ডিংস অনুযায়ী তদন্তকারী কর্মকর্তা অজ্ঞাত কারণে অতি উৎসাহী ভূমিকা পালন করে একই ঘটনায় দুইটি মামলা করে দুইটি অভিযোগপত্র দাখিল করেছিলেন মর্মে মন্তব্য করেন। তার আচরণ,কর্মকাণ্ড বিবেচনায় তদন্তকারী কর্মকর্তার কর্তৃপক্ষ কর্তৃক তার বিরুদ্ধে শাস্তিমূলক ব্যবস্থা গ্রহণ করা উচিত মর্মে আদালত সিদ্ধান্ত প্রদান করেন।আদালত পর্যালোচনায় আরো বলেন, এই ঘটনায় দ্বিতীয় এজাহার দায়ের সম্পূর্ণ অপ্রয়োজনীয় এবং আইন বহির্ভূত ছিলো।
বিচারিক আদালত তথা নারী ও শিশু নির্যাতন বিশেষ ট্রাইন্যুনাল বিচার শেষ করে এই মামলায় অভিযুক্তদের মৃত্যুদণ্ড প্রদান করেছিলেন ২০০৩সালে।হাইকোর্ট রায় দিয়েছিলেন ২০০৬ সালে।আপীলেট ডিভিশন শুনানী শুরু করেছিলেন ২০১৬ সালে। এই দীর্ঘ বিলম্বের অনেকগুলো কারণের মধ্যে অন্যতম ছিলো একই ঘটনায় অবৈধ ২য় এজাহার ও অভিযোগপত্র দায়ের এবং সেই এজাহার, অভিযোগপত্রের প্রেক্ষিতে সাক্ষ্য গ্রহণ করে বিচার প্রক্রিয়া সম্পন্ন করা। এই সব কর্মকান্ডের মাঝে ১৮ বছর অতিক্রান্ত হওয়ার বিষয় উল্লেখ করে মহামান্য আপীল বিভাগ নারী ও শিশু নির্যাতন (বিশেষ আইন) আইনের মামলাটির Proceedings Quash না করে “সম্পূর্ণ ন্যায়বিচারের জন্য (Complete Justice)” সংবিধানের অনুচ্ছেদ ১০৪ প্রয়োগের সিদ্ধান্ত গ্রহণ করেন এবং রায় প্রদান করেন।
একই সঙ্গে,The Penal Code,1860 এর ৩০২/৩৪ ধারার স্থগিত মামলাটিকে ন্যায়বিচারের স্বার্থে Dropped/বাতিল করার সিদ্ধান্ত প্রদান করেন।আপীল বিভাগ অভিযুক্ত শহীদুল ইসলাম@শহীদের মৃত্যুদণ্ড বহাল রাখেন। কিন্তু,হাইকোর্টে বহাল থাকা অন্য সকল অভিযুক্তের আপীল আদালত গ্রহণ করেন এবং তাদেরকে খালাস প্রদান করেন। দণ্ডিত শহীদুল ইসলাম@শহীদ আপীল বিভাগের নিকট রিভিউ দায়ের করেন। মৃত্যুদণ্ড প্রদানের কারণ সম্পর্কে এই রিভিউ এর রায়ে গুরুত্বপূর্ণ আলোচনা রয়েছে। রিভিউ এর রায় Shahidul Islam vs State,70 DLR (AD) (2018) 68,(Hasan Foez Siddique J-সাবেক প্রধান বিচারপতি)- এ রিপোর্টেড হয়েছে।
রিভিউ শুনানীকালে অভিযুক্ত শহীদের পক্ষে মামলার মেরিট সম্পর্কে বক্তব্য প্রদান করা হয়নি। মৃত্যুদণ্ডে দণ্ডিত অভিযুক্ত শহীদের ১৪(চৌদ্দ) বছর ধরে কনডেম সেলে থাকার বিষয়টিকে প্রশমনমূলক পরিস্থিতি (Mitigating Circumstance) হিসেবে উল্লেখ করে দণ্ডিতের শাস্তি ফাঁসির দণ্ড হতে যাবজ্জীবন কারাদণ্ডে কমিয়ে আনার জন্য তার পক্ষে বিজ্ঞ কৌসুলী প্রার্থনা জানান।
রাষ্ট্রপক্ষে বলা হয়, অপরাধের প্রকৃতি এবং সাক্ষ্য-প্রমাণ বিবেচনায় আপীল বিভাগ যথাযথভাবে অভিযুক্তের শাস্তি সমুন্নত (upheld) রেখেছেন। আপীল বিভাগের রায় পর্যালোচনায় কোন ধরণের আইনগত ভুল রয়েছে (no error of law apparent on the face of the record) মর্মে প্রতীয়মান না হওয়ায় রায় হস্তক্ষেপ যোগ্য নয়।
আপীল বিভাগ মামলার ঘটনা, সাক্ষ্য-প্রমাণ পর্যালোচনা করেন। আদালত রায়ে বলেন-
……………………………………………….
At about 10-00 Pm on 23/04/1998 Shajneen, an unfortunate girl of 15 years, was killed most inhumanly and brutally after rape in her bedroom which was her most secured place. This Division, upholding the findings of the Tribunal and High Court Division observed that it been proved all reasonable doubt that victim Shajneen was raped before murder. Confessional statement of the petitioner recorded under section 164 of the Code of Criminal Procedure, post-mortem report, evidence and statement of the appellant made before the Tribunal at the time of examination under section 342 of the Code of criminal Procedure there is no doubt not only this vulture pounced upon the body of the victim but it had jeopardized the victim’s parents, her other family members and conscience of the society at large. It was a cold-blooded murder where rape was committed on an innocent and helpless girl, which was a treacherous and cowardly act of the petitioner.
আদালতের পর্যালোচনা অনুযায়ী অভিযুক্ত ভিকটিমকে হত্যার পূর্বে ধর্ষণ করেছেন। শকুনের মতো ভিকটিমের দেহ ছিন্ন বিচ্ছিন্ন করেছেন।অভিযুক্ত শুধুমাত্র ভিকটিমকেই আঘাত করেননি।বরং, ভিকটিমের পিতামাতা, পরিবার, স্বজন এবং রাষ্ট্রের,সমাজের বিবেককে আঘাত করেছেন।অভিযুক্ত ঠান্ডা মাথায় তার কাপুরুষোচিত কাজের মাধ্যমে নৃশংস উপায়ে নিরীহ,সাহায্যহীন ভিকটিমকে ধর্ষণ করে হত্যা করেছেন।
It is not possible to catalogue the reasons which may justify the pass of death sentence. But, when the murder has been committed in a brutal manner on a helpless child, the same may be awarded. It is a crime against society and the brutality of the crime shocks the judicial conscience that the court has the duty to impose the death sentence. The petitioner was servant of the PW-1 whose duty was to defend and protect the family members instead he, out of his sexual lust, did not bother to kill a child of 15 years old assaulting mercilessly. It was gruesome murder. So, dilution of sentence would be a misplaced sympathy and gross miscarriage of justice. The crime committed by petitioner was grotesque, diabolic and revolting. Since heinous crime was committed in cruel and diabolic manner, death sentence is justified sentence. It is true death for death may be, to some extent, inhuman. But it is equally true that when a man becomes a beast and menace to the society, he can be deprived of his life. The nature of the crime reveals that the petitioner is a menace to the society and sentence of imprisonment would be altogether inadequate.
আদালতের পর্যালোচনা অনুযায়ী কোন মামলায় কেন মৃত্যুদণ্ড প্রদান করা উচিত তা সঠিকভাবে বিন্যস্ত করা সব সময় সম্ভব নয়। কিন্তু, কোন ব্যক্তি যখন কোন নিরীহ, সাহায্যহীন শিশুকে নৃশংস উপায়ে হত্যা করে, তখন শাস্তি হিসেবে মৃত্যুদণ্ড প্রদান করা যায়। এই ধরণের অপরাধ সমাজের বিরুদ্ধে অপরাধ এবং অপরাধের নৃশংসতা আদালতের বিবেককে আঘাত করে বিধায় মৃত্যুদণ্ডে দণ্ডিত করা তখন আদালতের দায়িত্ব হয়ে পড়ে। অর্থাৎ, অপরাধের নৃশংসতা সমাজ এবং রাষ্ট্রের উপর আঘাত করে।এই ধরণের অপরাধে মৃত্যুদণ্ড প্রদান না করা ন্যায়বিচারের পরিপন্থী তথা বিচার ভ্রষ্টতা (Miscarriage of Justice)।
আদালতের বিবেচনায় অভিযুক্ত যে অপরাধ করেছেন তা ঘৃণ্য, নারকীয়, পৈশাচিক।এই ধরণের অপরাধের জন্য উপযুক্ত শাস্তি হলো মৃত্যুদণ্ড। আদালতের মতে হত্যার জন্য তথা একটি মৃত্যুর জন্য আরেকজনকে মৃত্যুদণ্ড প্রদান কখনো কখনো অমানবিক মনে হতে পারে।কিন্তু,কোন ব্যক্তি যখন পশুতে (Beast)পরিণত হয় বা সমাজের কলঙ্ক(Menace of the Society) বা সমাজের জন্য হুমকিতে (Threat to the Society) পরিণত হয়,তখন তাকে তার জীবন থেকে বঞ্চিত করা যায়। অর্থাৎ,মৃত্যুদণ্ডে দণ্ডিত করা যায়।এই বিষয়গুলোর সাথে আদালত ভারতীয় সুপ্রীম কোর্টের Laxman Naik vs State of Orissa, AIR 1995 SC 1387 এবং Molai vs State of Madhya Pradesh, AIR 2000 SC 177 মামলার সিদ্ধান্তকে বিবেচনা করেন।উপরোক্ত উভয় মামলা পরবর্তীতে শাস্তি সংক্রান্ত বিষয় এবং পদ্ধতি নির্ধারণে ইতিহাস সৃষ্টিকারী Ataur Mridha alias Ataur Vs. The State, 15 SCOB [2021] AD – মামলায় আমাদের মহামান্য আপীল বিভাগ রেফার করেছেন।
In the case of Laxman Naik vs state of Orissa reported in AIR 1995 SC 1387 the accused committed rape on his brother’s daughter aged 7 years in a lonely place of forest and thereafter killed her. Supreme Court of India observed that the evidence on record indicated how diabolically the accused had conceived of his plan and brutally executed it and such a calculated murder of a girl of a very tender age after committing rape on her would undoubtedly fall in the category of rarest of the rare case attracting to punishment other than the capital punishment.In the case of Molai vs State of Madhya Pradesh reported in AIR 2000 SC 177 Supreme Court of India expressed similar view. In the said case victim, a 16 year old girl alone in house preparing for her examination. Both accused, taking advantage of she being alone, committed rape on her and then killed her. It was observed-“We have very carefully considered the contentions raised on behalf of the parties. We have also gone through the various decisions of this court relied upon by the parties in the courts below as well as before us and in our opinion the present case squarely falls in the category of one of the rarest of the rare case, and if this be so, the courts below have committed no error in awarding capital punishment to each of the accused. It cannot be overlooked that Naveen, a 16 years old girl, was preparing for her 10th examination at her house and suddenly both the accused took the advantage of she being alone in the house and committed a most shameful act of rape .The accused did not stop there but they strangulated her by using her under-garment and thereafter took her to the septic tank along with the cycle and caused injuries with a sharp edged weapon. The accused did not even stop there but they exhibited the criminality in their conduct by throwing the dead body into the septic tank totally disregarding the respect for a human dead body. Learned counsel for the accused (appellants) could not point any mitigation circumstances from the record of the case to justify the reduction of the sentence of either of the accused. In a case of this nature, in our considered view, the capital punishment to both the accused is the only proper punishment and we see no reason to take a different view than the one taken by the Courts below”.
Laxman Naik vs State of Orissa, AIR 1995 SC 1387 মামলায় অভিযুক্ত তার ০৭ বছর বয়সী আপন ভাতিজীকে পূর্বপরিকল্পিতভাবে বনের মধ্যে নিয়ে গিয়ে ধর্ষণ করেছিলেন এবং নৃশংস উপায়ে হত্যা করেছিলেন। অভিযুক্ত ভিকটিমের আপন চাচা হওয়ায় অভিযুক্তেরই দায়িত্ব ছিলো ভিকটিমকে রক্ষা করা। কিন্তু, অভিযুক্ত সে বিশ্বাস ভঙ্গ করে নিজেই ভিকটিমকে বনে নিয়ে গিয়ে ধর্ষণ করে হত্যা করেছেন। আদালতের বিবেচনায় অপরাধের ধরণ এবং নৃশংসতা অনুযায়ী এই ঘটনা বিরল থেকে বিরলতম (Rarest of the Rare), যার জন্য মৃত্যুদণ্ড প্রদান করা যেতে পারে। সুতরাং,ভিকটিমের বয়স,অপরাধের ধরণ,নৃশংসতা একটি ঘটনাকে বিরল থেকে বিরলতম প্রমাণ করলে, সেই ধরণের অপরাধের জন্য মৃত্যুদণ্ডে দণ্ডিত করা যেতে পারে।
অন্যদিকে, Molai vs State of Madhya Pradesh, AIR 2000 SC 177-মামলায় ভিকটিম তার ঘরে বসে পরীক্ষার প্রস্তুতি নিচ্ছিলেন। বাসায় একা থাকার কারণে দুইজন অভিযুক্ত তার ঘরে ডুকে তাকে ধর্ষণ করেন। অভিযুক্তরা সেখানেই থেমে না গিয়ে ভিকটিমের অর্ন্তবাস দিয়ে প্যাঁচিয়ে শ্বাসরোধ করে ভিকটিমকে হত্যা করেন। অভিযুক্তরা সেখানেও থামেননি। এরপর তারা ভিকটিমকে ধারালো অস্ত্র দ্বারা অসংখ্য আঘাত করেন। অভিযুক্তরা সেখানেও থেমে না গিয়ে, তার দেহকে সেপটিক ট্যাঙ্কের ভেতর নিক্ষেপ করেন।অপরাধের প্রকৃতি, গভীরতা এবং অপরাধীদের নৃশংসতা বিবেচনা করে ভারতীয় সুপ্রীম কোর্ট অপরাধটিকে Rarest of the Rare হিসেবে বিবেচনা করেন এবং মৃত্যুদণ্ডকে একমাত্র শাস্তি মর্মে হিসেবে নির্ধারণ করেন। উভয় মামলার ঘটনাবলী থেকে প্রতীয়মান হয় উভয় মামলায় ভিকটিম ছিলেন শিশু। উভয় ভিকটিমকে হত্যা করা হয়েছিলো। উভয় ভিকটিমকে ধর্ষণ করা হয়েছিলো। শরীরে অসংখ্য আঘাতের চিহ্ন ছিলো। উভয় ঘটনায় লাশ গোপন করার চেষ্টা ছিলো। উভয় ঘটনায় একটি অপরাধ করার পরে অভিযুক্তরা আরেকটি অপরাধের দিকে ধাবিত হয়েছেন, যার ফলে ঘটনাটি Rarest of the Rare মর্মে আদালতের নিকট প্রতীয়মান হয়েছে।
আমাদের দেশে সাধারণতঃ একটি অপরাধকে শুধুমাত্র একটি অপরাধ হিসেবে দেখা হয়।কিন্তু হত্যা মামলা বা এই ধরণের ক্ষেত্রে আমরা দেখেছি ভারতীয় সুপ্রীম কোর্ট অপরাধকে মামলার ঘটনা, প্রদর্শিত নৃশংসতা প্রভৃতি বিষয়ের উপর নির্ভর করে সাধারণ (Ordinary), বিরল (Rare) এবং বিরলতম( Rarest of the Rare) –এই তিনটি ভাগে ভাগ করেছেন। সাধারণ (Ordinary) এবং বিরল (Rare) এই দুই ধরণের অপরাধের ক্ষেত্রে শাস্তি হলো যাবজ্জীবন কারাদণ্ড বা কোন ধরনের রেয়াত বা রিমিশন ব্যতীত নির্দিষ্ট সময়ের কারাদন্ডসহ যাবজ্জীবন (যেমন- ২০/২৫/৩০/৪০/৫০ বছর) ।সুনির্দিষ্ট সময়ের কারাদণ্ডাদেশ প্রদান করলে ঐ সময় পার না হওয়া পর্যন্ত সরকার তাকে ক্ষমা করতে পারে না।অর্থাৎ ভারতীয় সুপ্রীম কোর্ট সুনির্দিষ্ট অপরাধের ক্ষেত্রে সরকারের ক্ষমা করার ক্ষমতাকেও সংকুচিত করেছে।ভারতীয় সুপ্রীম কোর্ট শুধুমাত্র বিরল থেকে বিরলতর( Rarest of the Rare) ঘটনার ক্ষেত্রেই মৃত্যুদণ্ড প্রদান করে থাকেন।
আমাদের আদালতগুলোতে সাধারণতঃ ঘটনার উপর নির্ভর করে এই ধরণের বিভাজন করা হয় না। শাজনীন একজন কিশোরী/ শিশু ছিলেন। ঘটনার সময় তিনি তার কক্ষে একা ছিলেন। অভিযুক্ত শহীদ ছিলেন তাদেরই ঘরের গৃহভৃত্য যার দায়িত্ব ছিলো শাজনীনসহ অন্যদের রক্ষা করা।দেখাশোনা করা। কিন্তু,অভিযুক্ত শহীদ সে বিশ্বাস ভঙ্গ করে তার যৌন লালসা চরিতার্থ করার জন্য পরিবারের সবাই নীচতলায় অনুষ্ঠানে থাকার সুবাদে একা পেয়ে পরিকল্পনা বা সুযোগ অনুযায়ী নিরপরাধী, সাহায্যহীন শাজনীনকে ধর্ষণ করেছেন।অভিযুক্ত সেখানেই থেমে থাকেননি।এরপর,অসংখ্য ছুরিকাঘাত করে নৃশংসভাবে ভিকটিমকে হত্যা করেছেন এবং পালিয়ে গিয়েছেন। যখন সাক্ষীরা টের পান ততক্ষণে অনেক দেরী হয়ে গিয়েছে। ভিকটিম তার নিজ ঘরে ধর্ষণ ও হত্যার শিকার হন। ভিকটিমের পুরো শোবার কক্ষ ছিলো রক্তে রঞ্জিত। ভিকটিমের কাপড় চোপড় ছিলো অবিন্যস্ত, ছেঁড়া।প্যান্টি ছিলো হাঁটুর নীচ পর্যন্ত নামানো।পুরো শরীরে ছিলো ছুরিকাঘাতের চিহ্ন। এই বিষয়গুলো বিবেচনা করে আপীল বিভাগ এই ঘটনাকে Rarest of the Rare বলে বিবেচনা করেছেন এবং এই জন্য ভারতীয় সুপ্রীমকোর্টের প্রায় একই ধরণের দুটি ঘটনাকে নজীর হিসেবে উল্লেখ করেছেন।
From the nature of the offence it appears to us that the petitioner is not anyway entitled to get any sympathy. We do not find any mitigating or extenuating circumstances on record for commutation of the sentence of death. Delay in the disposal of this case cannot by itself be a ground for commuting the sentence of death to one of imprisonment for life since the crime committed by the petitioner was premeditated, senseless, dastardly and beyond all human reasonings.Accordingly, we do not find any substance in the petition. thus, the review petition is dismissed.
Mitigating Circumstance বিবেচনার সবচেয়ে প্রকৃষ্ট উদাহরণ হলো Nalu vs State, 32 BLD(AD)247 =17BLC(AD)204- মামলা। আপীলেট ডিভিশনের অসংখ্য মামলায় বিচার নিষ্পত্তিতে দীর্ঘদিনের বিলম্ব (Delay),দীর্ঘদিনের কারাবাস,কনডেম সেলে মৃত্যু যন্ত্রণায় থাকা,বয়স,১৬৪ ধারায় দোষ স্বীকার করা এবং কৃত অপরাধের জন্য লজ্জিত হওয়া প্রভৃতিকে Mitigating Circumstanceহিসেবে বিবেচনা করা হয়েছে।এই মামলায় অভিযুক্ত শহীদ একজন কম বয়সী তরুণ ছিলেন।তিনি ফাঁসির দণ্ড শ্রবণের পর থেকে প্রায় ১৪ বছর কনডেম সেলে মৃত্যু যন্ত্রণায় ছিলেন।এর আগেও ধৃত হওয়ার পর থেকে তিনি কারাগারে ছিলেন।তিনি ধৃত হওয়ার পর থেকে কখনোই জামিন লাভ করেননি।এই বিষয়গুলোকে আদালত Mitigating Circumstance হিসেবে বিবেচনা করেননি।
বরং,বিলম্ব (Delay) শাস্তি কমানোর জন্য একমাত্র কারণ হতে পারে না মর্মে আদালত সিদ্ধান্ত প্রদান করেন।আদালতের বিবেচনা অনুযায়ী, অভিযুক্ত শহীদ যে অপরাধ করেছেন এবং যে পন্থায় করেছেন তার জন্য কোন ক্রমেই সহানুভূতি প্রদর্শন করা যায় না।তার প্রতি সহানুভূতি প্রদর্শন করা হলে তা হবে ভুল জায়গায় সহানুভূতি প্রদর্শন।সুতরাং,পূর্বপরিকল্পিত উপায়ে নৃশংসভাবে ধর্ষণ এবং হত্যা করায় শাজনীন হত্যাকান্ডকে আপীল বিভাগ Rarest of the Rare কেস হিসেবে বিবেচনা করেছেন এবং অভিযুক্ত শহীদের মৃত্যুদণ্ড বহাল রেখে রিভিউ খারিজ করেছেন। দণ্ডিত শহীদ মহামান্য রাষ্ট্রপতির নিকট দণ্ড মওকুফের জন্য আবেদন করলেও তা প্রত্যাখ্যাত হয়। যাবতীয় প্রক্রিয়া শেষে দণ্ডিত অভিযুক্ত শহীদুলের ফাঁসির দণ্ড ২৭ নভেম্বর, ২০১৭ খ্রিঃ রাত পৌনে দশটায় কাশিমপুর হাই সিকিউরিটি কারাগারে কার্যকর করা হয়।
এই রায়ের অনন্য দিক হলো আপীল বিভাগ মামলাটির প্রকৃতি, অপরাধের ধরন, অপরাধীর বিভিন্ন বিষয় বিবেচনা করেছেন। আপীল বিভাগ দণ্ডিত অভিযুক্তের কৃত অপরাধ বিবেচনা করেছেন তথা Crime Test করেছেন। Crime Test অনুযায়ী অভিযুক্তের অপরাধ ছিলো মানবিক বোধ বিবর্জিত। অভিযুক্ত অপরাধ সংঘটনকালে ভিকটিমের প্রতি ভয়ংকর নৃশংসতা প্রদর্শন করেছিলেন।আদালত অভিযুক্তের বিভিন্ন বিষয় বিবেচনা তথা Criminal Test করেছিলেন।অভিযুক্তের বয়স কম ছিলো। দীর্ঘ সময় কনডেম সেলে মৃত্যু যন্ত্রণায় ছিলেন।আদালত ভারতীয় সুপ্রীম কোর্টের ২টি মামলা R-R Test করেছেন।সার্বিক অবস্থা বিবেচনায় আদালত অভিযুক্তের পক্ষে Mitigating Circumstance (criminal test) পাননি।
বরং,সবগুলো Aggravating Circumstance (Crime Test) পেয়েছেন। আদালত মামলাটিকে বিরল থেকে বিরলতম মামলা হিসেবে সাব্যস্ত করেন এবং অভিযুক্তের মৃত্যুদণ্ড বহাল রাখেন। এই মামলার রায় ঘোষণার সময় আদালতের বিবেচনায় Rarest for The Rare অন্যতম বিবেচনা হলেও পরবর্তীতে আতাউর রহমানের মামলায় মহামান্য আপীল বিভাগ অপরাধীর শাস্তি নির্ধারণের সময় Crime Test (Aggravating Circumstance), Criminal Test (Mitigating Circumstance) এবং এই দুইটি বিবেচনায় Comparative Proportionality Test এর বিধান উল্লেখ করেন। অর্থাৎ,আমাদের আদালত ভারতীয় Rarest of The Rare Theory এবং Fixed Time Imprisonment (without remission) গ্রহণ না করে Comparative Proportionality Test গ্রহণ করেছেন।মহামান্য আদালত কি কি বিষয় কিভাবে বিবেচনা করতে হবে সে সম্পর্কে বিচারকদের অনুসরণীয় নীতি সম্পর্কে আতাউর রহমানের রায়ে বলেছেন-
There is no guidance to the Judge in regard to selecting the most appropriate sentence of the cases. The absence of sentencing guidelines is resulting in wide discretion which ultimately leads to uncertainly in awarding sentences. A statutory guideline is required for the sentencing policy. Similarly, a properly crafted, legal framework is needed to meet the challenging task of appropriate sentencing. The judiciary has enunciated certain principles such as deterrence, proportionality, and rehabilitation which are needed to be taken account while sentencing. The proportionality principle includes factors such as mitigating and aggravating circumstances. The imposition of these principles depends on the fact and circumstances of each case. The guiding considerations would be that the punishment must be proportionate. The unguided sentencing discretion led to an unwarranted and huge disparity in sentences awarded by the courts of law. The procedure prescribed by law, which deprives a person of life and liberty must be just, fair and reasonable and such procedure mandates humane conditions of detention preventive or punitive. The main aim of punishment in judicial thought, however, is still the protection of society and the other objects frequently receive only secondary consideration when sentences are being decided. While deciding on quantum of sentence as accused getting away with lesser punishment would have adverse impact on society and justice system. Sentencing for crimes has to be analyzed on the touchstone of three tests viz. crime test, criminal test and comparative proportionality test.
150. The legislature defines the offence with sufficient clarity and prescribes the outer limit of punishment and a wide discretion in fixing the degree of punishment within that ceiling is allowed to the Judge. On balancing the aggravating and mitigating circumstances as disclosed in each case, the Judge has to judiciously decide what would be the appropriate sentence. In judging an adequate sentence, the nature of the offence, the circumstances of its commission, the age and character of the offender, the injury to the individuals or to the society, whether the offender is a habitual, casual or a professional offender, affect of punishment on the offender, delay in the trial and the mental agony suffered by the offender during the prolonged trial, an eye to correction and reformation of the offender are some amongst many factors that have to be taken into consideration by the Courts. In addition to those factors, the consequences of the crime on the victim while fixing the quantum of punishment because one of the objects of the punishments is doing justice to the victim. A rational and consistent sentencing polices requires the removal of several deficiencies in the present system. An excessive sentence defects its own objective and tends to undermine the respect for law.” (emphasis/underline supplied)”
মহামান্য আদালতের নির্দেশনা অনুযায়ী শাস্তি নির্ধারণের ক্ষেত্রে আদালতকে ৩টি টেস্ট তথা Crime Test, Criminal Test এবং Comparative Proportionality Test করতে হবে।শাস্তি হতে হবে কৃত অপরাধের সাথে সামঞ্জস্যপূর্ণ বা সমানুপাতিক।মামলার প্রকোপনমূলক পরিস্থিতি (Aggravating Circumstance) এবং প্রশমনমূলক পরিস্থিতি (Mitigating Circumstances) পারষ্পরিক বিবেচনা ও তুলনা করতে হবে। দোষী সাব্যস্তকৃত অপরাধীর সংশোধন সম্ভব কিনা সেটিও লক্ষ্য রাখতে হবে।
শাস্তি নির্ধারণের সময় “….the nature of the offence, the circumstances of its commission, the age and character of the offender, the injury to the individuals or to the society, whether the offender is a habitual, casual or a professional offender, effect of punishment on the offender, delay in the trial and the mental agony suffered by the offender during the prolonged trial, an eye to correction and reformation of the offender……”- বিবেচনা করতে হবে।
শাজনীন ২৩-০৪-১৯৯৮ খ্রিঃ তারিখ রাতে ধর্ষণ এবং নির্মমভাবে হত্যাকাণ্ডের শিকার হয়েছিলেন। প্রায় ১৯ বছর পরে একই সময়ে দণ্ডিত অভিযুক্ত শহীদের মৃত্যুদণ্ড কার্যকর করা হয়েছিলো। নিঃসন্দেহে দীর্ঘ বিচারিক প্রক্রিয়া শেষে আদালতের রায়ে শাজনীন তার হত্যার বিচার পেয়েছেন। কিন্তু,তার অন্তহীন নির্নিমেষ চাহনি শেষ হয়েছে কি?
লেখক : অতিরিক্ত জেলা ও দায়রা জজ, লক্ষ্মীপুর।