আবদুল্লাহ আল আশিক : কোর্ট কাচারির টয়লেট যারা ব্যবহার করেছেন তাদের জন্য একটি কৌতুক আমি ডেডিকেটেড করতে চাই। কৌতুকটি কিছুটা এই রকম। এক বন্ধু আরেক বন্ধুকে বললেন, ‘জানিস, আমাদের বাড়ির সবাই বাথরুম সিঙ্গার। বাথরুমে গেলেই গান করে।’ অন্য বন্ধুটি জিজ্ঞেস করলেন, ‘ইন্টারেস্টিং, কিন্তু কেনো?’ প্রথম বন্ধুটি উত্তর দিলেন, ‘কারণ আমাদের বাথরুমের দরজায় একটাও সিটকানি নাই।’
কি ভয়ংকর? ভাবুন, আপনি কোথাও টয়লেট ব্যবহার করছেন অথচ সেই টয়লেটে সিটকানি নেই। ট্যাপে পানি নেই। কেসিংয়ে টিস্যু নেই। বেসিনে হ্যান্ডওয়াশ বা সাবান নেই। চারিদিকে নোংরা ও দুর্গন্ধে আপনার দফারফা হওয়ার অবস্থা। এর চেয়ে দুঃখজনক বিষয় আর কি হতে পারে।
বাংলাদেশের অধিকাংশ সরকারি প্রতিষ্ঠানের চিত্র অনেকটা সামঞ্জস্যপূর্ণ। ঢাকা মেডিক্যাল কিংবা অন্যান্য সরকারি হাসপাতাল গুলোর টয়লেটকে প্রথম কাতারে রেখেই, ২য় কাতারে থাকা আমি আদালত প্রাঙ্গণের টয়লেটনামা নিয়ে লিখছি। যদি ‘একটি টয়লেটের আত্মকথা’ রচনা লিখতে আহ্বান করা হয় তবে ঢাকার কোর্ট কাচারির টয়লেটগুলো সবার আগে তাদের দুর্দশা ও হতাশার কথা তুলে ধরবে।
বর্তমানে ঢাকার জজ কোর্টের আদালত প্রাঙ্গণে বিচারিক কার্যক্রম পরিচালনা হয় ৭টি ভবনে, আর ভবনগুলো মহানগর বিল্ডিং, জেলা জজ পুরাতন ভবন, রেবতি মেনশন, জেলা জজ ৮ম তলা, নির্বাহী আদালত, সিজিএম ভবন, সিএমএম ভবন নামে বেশি পরিচিত। উল্লেখিত ভবনে বিচারিক কার্যক্রম পরিচালনাকালীন সময়ে প্রতিনিয়ত হাজার হাজার মানুষের পদচারণ ঘটছে। প্রতিদিন আইনজীবী, বিচারপ্রার্থী, প্রশাসন ও আদালতের স্টাফ মিলে মানুষের উৎসব তৈরি হয় সেখানে। রঙেন মানুষের বিচরণ। মহিলা, শিশু, বৃদ্ধ, অসুস্থ ইত্যাদি নানান প্রকারের মানুষ। সবার ঐ একটাই প্রার্থনা, ন্যায় বিচার।
এই মানুষগুলোর জন্য ঢাকার আদালত ন্যায় বিচার প্রতিষ্ঠা করতে সক্ষম হলেও স্বাস্থ্যকর পরিবেশ প্রদান করতে রীতিমতো হিমশিম খাচ্ছে। বিশেষ করে স্বাস্থ্যকর টয়লেট সেবা প্রদানের ক্ষেত্রে ঢাকার আদালত প্রাঙ্গণ পুরোপুরি ব্যর্থ। যদি মহানগর দায়রা জজ আদালত ভবনের কথা বলি, ৩য় তলায় মাত্র একটি টয়লেট বিদ্যমান। ৫ম তলার টয়লেট বেশিরভাগ সময়ই বন্ধ থাকে। তৃতীয় তলার টয়লেটের পাশে চেয়ার নিয়ে একজন পরিচ্ছন্ন কর্মী বসে থাকলেও টয়লেট এর অবস্থা শোচনীয়।
কারণ মহানগর আদালতের টয়লেটটি দুধ, সোনা ও চান্দী দিয়ে ধুলেও সেটার চেহারার কোনো পরিবর্তন হবে না। প্রয়োজন টয়লেটটির সংস্কার। পুরাতন জেলা জজ বিল্ডিং এর প্রায় প্রতিটি ফ্লোরে টয়লেট থাকলেও নেই কোনো পরিচ্ছন্ন কর্মী। বেশির ভাগ সময় থাকে না পানি, দরজার সিটকানি নেই, টয়লেটের চারিদিকে টিস্যু পড়ে একটা ছেড়ে দে মা কেন্দে বাঁচি অবস্থা।
জেলা জজের ৮ম তলা বিল্ডিং এর ঐ একই অবস্থা। কোথাও হাত ধোয়ার জন্য হ্যান্ডওয়াশ বা সাবানের কোনো ব্যবস্থা নেই। সিজিএম আদালতের ৬ষ্ঠ তলায় একটি মাত্র স্থান নির্ধারণ করা হয়েছে টয়লেট এর জন্য। যদিও সেখানে ঐ একই চিত্র। সিএমএম আদালতের দুই জায়গার টয়লেটেই দরজায় সিটকানি থাকলেও হাত ধোয়ার জন্য নেই সুব্যবস্থা। অন্যান্য ভবন গুলোতেও একই চিত্র চোখে পড়ে। অর্থাৎ ঢাকা জজ কোর্ট প্রাঙ্গণে পর্যাপ্ত টয়লেট এর ব্যবস্থা আছে, তবে একটিও ব্যবহার উপযোগী নয়। সংস্কার এর অভাবে ও পরিচ্ছন্ন কর্মীদের দায়িত্ব অবহেলায় ওগুলো পুরোপুরি ব্যবহার অনুপযোগী হয়ে উঠেছে।
এই মুহূর্তে প্রয়োজন মাননীয় মহানগর দায়রা জজ ও জেলা জজ সহ বিজ্ঞ চীফ জুডিশিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট ও মেট্রোপলিটন ম্যাজিস্ট্রেট মহোদয়ের সঠিক পদক্ষেপ গ্রহণ। বিচারপ্রার্থী ব্যক্তিদের স্বাস্থ্যকর টয়লেট সেবা দেওয়াটাও একটা গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। শুধুমাত্র ঢাকা জজ কোর্টের আদালত প্রাঙ্গণে টয়লেট সেবার মান নিয়ে আমরা চিন্তিত নই, এই চিন্তা বাংলাদেশের প্রত্যেকটি আদালতেই। যে আদালত নাগরিকদের সাংবিধানিক অধিকার নিশ্চিত করে, ন্যায় বিচার প্রতিষ্ঠা করে, সেই আদালত চাইলে অবশ্যই নাগরিকদের একটা স্বাস্থ্যকর টয়লেটও উপহার দিতে পারবে। দরকার শুধুমাত্র সঠিক পরিকল্পনা, সৎ ইচ্ছা ও দায়বদ্ধতা।
বাংলাদেশ সুপ্রীম কোর্ট ভবনের টয়লেটগুলোর কথা যদি বলি তাহলে তুলনামূলক ভাবে নিম্ন আদালতের চেয়ে ওগুলো কিছুটা ব্যবহার উপযোগী। তবে উপযুক্ত পরিচ্ছন্ন কর্মী ও তদারকি সেল না থাকায় হ্যান্ডওয়াশ বা সাবান কোথাও পরিলক্ষিত হয় না। সুপ্রীম কোর্টের এনেক্স বিল্ডিং এর টয়লেট এর বেশিরভাগ দরজা গুলোতে নেই কোনো সিটকানি। হ্যান্ডওয়াশার ও কমোড গুলো নষ্ট। বিজয়-৭১ বিল্ডিং এর কোনো কোনো বেসিন এর কল চুরি হয়ে গেছে।
এদিক সেদিক ময়লা টিস্যু পড়ে থাকে। কোথাও কোনো পরিচ্ছন্ন কর্মী পরিলক্ষিত হয় না। অথবা পরিচ্ছন্ন কর্মী থাকলেও তারা তাদের দায়িত্ব অবহেলা করে চলছে। এমতাবস্থায় প্রয়োজন সঠিক পদক্ষেপ গ্রহণ। বিশেষ করে, কয়েকটি ফ্লোরের টয়লেট গুলোকে নোটডাউন করে কয়েকজন পরিচ্ছন্ন কর্মীকে ফুলটাইম তত্ত্বাবধানের দায়িত্ব প্রদান করলে রাষ্ট্রীয় সম্পদ যেমন রক্ষা পাবে তেমনি বিচারপ্রার্থী ব্যক্তিবর্গের জন্য স্বাস্থ্যকর টয়লেট সেবা নিশ্চিত হবে।
উল্লেখ্য যে, ইদানীং কালের বাংলাদেশের সুপ্রীম কোর্ট ও ব্র্যাক এর যৌথ উদ্যোগকে সাধুবাদ জানাই। ইতিমধ্যে সুপ্রীম কোর্ট প্রাঙ্গণে নারী ও শিশু বান্ধব স্বাস্থ্যসম্মত টয়লেট স্থাপন করা হয়েছে। যার কারিগরি সহযোগিতা করছে ভূমিজ। এই প্রকল্প বাংলাদেশের প্রতিটি আদালতে ছড়িয়ে যাবে বলে আমি আশাবাদী।
আদালত প্রাঙ্গণ যেমন ন্যায় বিচারের পূর্ণ ভূমি, তেমনি হয়ে উঠুক নাগরিকদের স্বাস্থ্যসেবা নিশ্চিত করনের প্রকৃষ্ট উদাহরণ।
লেখক : আবদুল্লাহ আল আশিক, অ্যাডভোকেট, বাংলাদেশ সুপ্রীম কোর্ট।