ধর্ষণ প্রতিরোধে কঠোর আইন ও বিচারব্যবস্থার চ্যালেঞ্জ
মোঃ ইব্রাহীম খলিলুল্লাহ্

আমরা কেমন সংবিধান চাই?

মোঃ ইব্রাহীম খলিলুল্লাহ্‌ : ২০২৪ সালের জুলাইআগস্টের ছাত্রজনতার গণঅভ্যুত্থান শুধু একটি সরকারের পতনই ঘটায়নিবরং আমাদের সংবিধানের কার্যকারিতা নিয়েও গুরুতর প্রশ্ন তুলেছে। এই আন্দোলনে ১০০০এর বেশি মানুষের প্রাণহানি এবং ২০,০০০এর বেশি আহত হওয়ার ঘটনা প্রমাণ করে যেআমাদের সংবিধান জনগণের মৌলিক অধিকার রক্ষায় কতটা অসহায়। আবু সায়েদের মতো নিরস্ত্র ছাত্রের উপর নির্বিচারে গুলিবর্ষণ এবং পরবর্তীতে ব্যাপক গণহত্যা সংবিধানের কার্যকারিতা নিয়ে সাধারণ মানুষের মনে গভীর সংশয় সৃষ্টি করেছে। এই বাস্তবতায় প্রশ্ন জাগেআমাদের সংবিধান কি জনগণের আশাআকাঙ্ক্ষার প্রতিফলননাকি এটি ক্ষমতাসীনদের স্বৈরাচারকে বৈধতা দেওয়ার উপকরণ?

মুক্তিযুদ্ধের অনুপস্থিতি ও জাতিগত পরিচয়ের সংকট

বাংলাদেশের সংবিধানের সবচেয়ে আশ্চর্যজনক দিক হলোযে মহান মুক্তিযুদ্ধের ফলশ্রুতিতে এই রাষ্ট্রের জন্মসেই মুক্তিযুদ্ধ‘ শব্দটিই সংবিধানে অনুপস্থিত। সংবিধানের প্রস্তাবনায় কেবল জাতীয় স্বাধীনতার জন্য ঐতিহাসিক যুদ্ধ” উল্লেখ আছেযা একটি জাতির সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ অধ্যায়কে যথাযথ মর্যাদা দিতে ব্যর্থ। এটি শুধু আবেগের বিষয় নয়বরং সাংবিধানিক স্বীকৃতির প্রশ্ন।

জাতিগত পরিচয় নিয়েও রয়েছে মৌলিক সমস্যা। সংবিধান অনুযায়ী আমরা জাতি হিসেবে বাঙালি‘, কিন্তু নাগরিক হিসেবে বাংলাদেশি। এই দ্বৈততা শুধু শব্দগত নয়বরং এটি বাংলাদেশে বসবাসরত ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠীর অস্তিত্বকে অস্বীকার করে। চাকমামারমাগারোসাঁওতালসহ অসংখ্য জাতিগোষ্ঠী যারা মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণ করেছিল এবং আজও এই ভূমিতে বসবাস করছেতারা সাংবিধানিকভাবে বাঙালি‘ নয়। সংবিধানে কেবল বাঙালি‘ জাতির উল্লেখ করে এই সকল জনগোষ্ঠীকে তাদের ন্যায্য স্বীকৃতি থেকে বঞ্চিত করা হয়েছেযা সাংবিধানিক সমতার নীতির সাথে সাংঘর্ষিক।

অপরিবর্তনীয়তার জটিলতা ও গণতান্ত্রিক সংকট

পঞ্চদশ সংশোধনীর মাধ্যমে সংবিধানের ৭ক ধারা সংযোজন করে সংবিধানের প্রায় একতৃতীয়াংশ অনুচ্ছেদকে অপরিবর্তনীয় করে দেওয়া হয়েছে। এই বিধান মৌলিক কাঠামো তত্ত্বের দোহাই দিয়ে প্রণীত হলেও এটি মূলত জনগণের সাংবিধানিক অধিকারের উপর আঘাত। একটি গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রে জনগণের প্রতিনিধিদের মাধ্যমে সংবিধান সংশোধনের যে ক্ষমতা থাকার কথাতা খর্ব করে দেওয়া হয়েছে।

বিশেষজ্ঞরা যুক্তি দেখান যে, “সংবিধানের অপরিবর্তনীয় ধারাগুলো বিচারবিভাগীয় পর্যালোচনার ক্ষমতাকেও বাতিল করে দিয়েছে। এটি সাংবিধানিক আদালতের স্বাধীনতাকেও ক্ষুণ্ন করে। সংবিধান কোনো ধর্মগ্রন্থ নয় যে তা অপরিবর্তনীয় থাকবে। বরং এটি একটি জীবন্ত দলিলযা সময়ের সাথে তাল মিলিয়ে পরিবর্তিত হওয়ার ক্ষমতা রাখে।

জীবনধারণের মৌলিক অধিকারের প্রহসন

সংবিধানের ১৫ অনুচ্ছেদে খাদ্যবস্ত্রআবাসনশিক্ষা ও চিকিৎসার মতো মৌলিক প্রয়োজনের কথা উল্লেখ আছে। কিন্তু এগুলো রাষ্ট্রীয় নীতির মূলনীতির অধীনে রাখা হয়েছেযা আদালতে প্রয়োগযোগ্য নয়। অর্থাৎ একজন নাগরিক এই অধিকারগুলোর জন্য আদালতে যেতে পারবে না। বিশেষজ্ঞরা মনে করেন, “মৌলিক নীতিগুলো বিচারিকভাবে প্রয়োগযোগ্য নয়কিন্তু সংবিধান ব্যাখ্যায় এগুলো গুরুত্বপূর্ণ

একদিকে সংবিধানে জীবনের অধিকার প্রয়োগযোগ্যঅন্যদিকে জীবন ধারণের জন্য প্রয়োজনীয় খাদ্যের অধিকার প্রয়োগযোগ্য নয়—এটি কতটা অর্থহীনজাতীয় মানবাধিকার কমিশনের পর্যবেক্ষণ অনুযায়ী, “খাদ্যের অধিকারের প্রত্যক্ষ সাংবিধানিক স্বীকৃতি ব্যক্তিদের এই অধিকার লঙ্ঘনের ক্ষেত্রে প্রতিকারের সুযোগ দেবে এবং সরকারি পদক্ষেপের স্বচ্ছতা ও জবাবদিহিতা বৃদ্ধি করবে

অনুচ্ছেদ ৭০একনায়কতন্ত্রের সাংবিধানিক ভিত্তি

সংবিধানের ৭০ অনুচ্ছেদ সংসদীয় গণতন্ত্রের জন্য একটি বড় হুমকি। এই ধারা অনুযায়ী কোনো সংসদ সদস্য তার দলের বিপক্ষে ভোট দিলে তার আসন বাতিল হয়ে যাবে। গবেষকরা যুক্তি দেখান যে, “৭০ অনুচ্ছেদ গণতন্ত্রকে পিছিয়ে দিচ্ছে এবং সংসদে গণতান্ত্রিক মূল্যবোধ প্রতিষ্ঠায় বাধা সৃষ্টি করছে। এই বিধানের ফলে সংসদে বিতর্ক ও মতের স্বাধীনতা খর্ব হয়যা গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়ার মূল ভিত্তিকে দুর্বল করে।

২০২ৄ সালের গণঅভ্যুত্থানের অন্যতম কারণ ছিল সংসদের অকার্যকারিতা। যেই সংসদ জনগণের প্রত্যাশার প্রতিফলন ঘটানোর কথাসেই সংসদ হয়ে উঠেছিল সরকারি সিদ্ধান্তে সিলমোহর দেওয়ার যন্ত্র। গবেষণায় দেখা গেছে, “৭০ অনুচ্ছেদের কারণে সংসদে বাকস্বাধীনতা অর্থহীন হয়ে পড়েছে

২০২৪ সালের গণঅভ্যুত্থানসাংবিধানিক ব্যর্থতার প্রমাণ

২০২৪ সালের জুলাই বিপ্লব প্রমাণ করেছে যেআমাদের সংবিধান ক্ষমতার অপব্যবহার রোধে অকার্যকর। কোটা সংস্কার আন্দোলন থেকে শুরু হওয়া এই গণঅভ্যুত্থানে সরকারি বাহিনীর নির্বিচার গুলিবর্ষণ এবং ছাত্রলীগের হামলা সংবিধানের মৌলিক অধিকারের বিধানগুলোকে সম্পূর্ণ অর্থহীন করে তুলেছিল।

গবেষণায় দেখা গেছে, “জনগণের হতাশা স্বৈরাচারী শাসনমানবাধিকার লঙ্ঘনের অভিযোগ এবং বিরোধী ব্যক্তিত্বদের বিরুদ্ধে লক্ষ্যবস্তু পদক্ষেপসহ বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ ঘটনার কারণে তীব্র হয়েছিল। এই পরিস্থিতি প্রমাণ করে যেআমাদের সংবিধান কর্তৃত্ববাদী শাসন প্রতিরোধে অপর্যাপ্ত।

আমাদের প্রত্যাশিত সংবিধান

আমাদের নতুন সংবিধানে মুক্তিযুদ্ধের যথাযথ স্বীকৃতি থাকতে হবে। জাতিগত পরিচয়ে শুধু বাঙালি‘ নয়বরং বাংলাদেশি‘ হিসেবে সকল জাতিগোষ্ঠীর সমান মর্যাদা নিশ্চিত করতে হবে। খাদ্যবস্ত্রআবাসনশিক্ষা ও চিকিৎসার মতো মৌলিক প্রয়োজনগুলো হতে হবে প্রয়োগযোগ্য অধিকারযার জন্য নাগরিকরা আদালতে যেতে পারবে।

সংবিধানের অপরিবর্তনীয়তার বিধান তুলে দিয়ে এটিকে একটি জীবন্ত দলিলে পরিণত করতে হবে। ৭০ অনুচ্ছেদের মতো গণতন্ত্রবিরোধী বিধান বাতিল করে সংসদে প্রকৃত বিতর্ক ও মতের স্বাধীনতা নিশ্চিত করতে হবে।

সর্বোপরিআমাদের প্রত্যাশিত সংবিধান হবে প্রকৃতই জনগণের সংবিধান—যা হবে সাম্যন্যায়বিচার ও মানবিক মর্যাদার প্রতীক। যে সংবিধান নিশ্চিত করবে যেআবু সায়েদের মতো আর কোনো নিরপরাধ তরুণকে স্বৈরশাসকের বুলেটের সামনে প্রাণ দিতে হবে না। সেই সংবিধানই পারবে বাংলাদেশকে একটি প্রকৃত গণতান্ত্রিক ও ন্যায়ভিত্তিক রাষ্ট্র হিসেবে গড়ে তুলতে।

লেখকমোঃ ইব্রাহীম খলিলুল্লাহ্‌সহসভাপতিবাংলাদেশ ল অ্যালায়েন্স (বিএলএ)। ইমেইলibrahimkhalilullah010@gmail.com