তথ্য গোপন করে বৈধ বিয়ে—ধর্মীয়, আইনগত ও আন্তর্জাতিক প্রেক্ষাপটে স্বামীর প্রতিকার
আল মুস্তাসিম নবী নিকু

তথ্য গোপন করে বৈধ বিয়ে: ধর্মীয়, আইনগত ও আন্তর্জাতিক প্রেক্ষাপটে স্বামীর প্রতিকার

আল মুস্তাসিম নবী নিকু : বিবাহ একটি পবিত্র ও গুরুতর সামাজিক চুক্তি, যা কেবল দুইজন মানুষের নয় বরং দুইটি পরিবারের মধ্যে আস্থা, ভালোবাসা ও বিশ্বাসের বন্ধন স্থাপন করে। ইসলাম ধর্ম, বাংলাদেশের প্রচলিত আইন এবং আন্তর্জাতিক পারিবারিক নীতিমালায় বিবাহকে কেন্দ্র করে যে মূল্যবোধ ও নীতিমালা প্রতিষ্ঠিত, তার মূল ভিত্তি হল সততা ও স্বচ্ছতা

কিন্তু যখন একজন নারী পূর্বের বৈবাহিক সম্পর্ক ইচ্ছাকৃতভাবে গোপন রেখে পুনরায় বিয়ে করেন, তখন বিষয়টি নৈতিক, ধর্মীয় এবং আইনগত তিনটি দৃষ্টিকোণ থেকেই প্রশ্নবিদ্ধ হয়।

বাস্তবঘটনা: বিয়েতে তথ্য গোপন করে প্রতারণা

এই প্রবন্ধে আলোচিত একটি বাস্তবধর্মী ঘটনা—একজন নারী তার দুটি তালাকপ্রাপ্ত বিয়ের তথ্য গোপন রেখে তৃতীয় বিয়ে সম্পন্ন করেন। বিয়ের পর তথ্য প্রকাশ হলে স্বামী প্রতারিত অনুভব করেন এবং জানতে চান:

“এই পরিস্থিতিতে আমি কী ধরনের আইনি, ধর্মীয় ও আন্তর্জাতিক প্রতিকার পেতে পারি—বিশেষ করে আমি যদি বিদেশে অবস্থান করি?”

ইসলামি শরিয়তের দৃষ্টিকোণ: বিয়েতে সততা অপরিহার্য

ইসলাম ধর্মে বিয়ের পূর্বশর্ত হিসেবে সততা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। তালাকপ্রাপ্ত নারী ইদ্দতকাল শেষে পুনরায় বিয়ে করতে পারেন, এটি শরিয়াহ অনুযায়ী বৈধ। তবে পূর্বের বিয়ের তথ্য গোপন রেখে নতুন করে বিবাহ করা ধর্মীয়ভাবে প্রতারণা হিসেবে বিবেচিত হয়।

হাদীসের দৃষ্টান্ত:

“যে প্রতারণা করে, সে আমার উম্মতের অন্তর্ভুক্ত নয়।”
— (সহীহ মুসলিম)

অতএব, তথ্য গোপন করে বিয়ে করা ইসলাম অনুযায়ী ধোঁকা ও গুনাহর কাজ

মোহরের অধিকার ও প্রতারণার প্রভাব

ইসলামী আইনে বিয়ে বৈধ হলে স্ত্রী মোহরের অধিকারী হন। তবে বিয়েতে প্রতারণা প্রমাণিত হলে আদালত:

  • মোহরের পরিমাণ কমিয়ে দিতে পারে

  • কখনও কখনও মোহরের সম্পূর্ণ দাবিও বাতিল করতে পারে

বাংলাদেশের প্রচলিত আইন অনুযায়ী বিয়েতে তথ্য গোপন

Muslim Family Law Ordinance অনুসারে, তালাকপ্রাপ্ত নারী পুনরায় বিয়ে করতে পারেন এবং সেই বিয়ে আইনগতভাবে বৈধ। তবে যদি পূর্বের বিয়ের তথ্য ইচ্ছাকৃতভাবে গোপন রাখা হয়, তবে তা আইন অনুযায়ী প্রতারণা

দেওয়ানি প্রতিকার (Family Court)

স্বামী Family Courts Ordinance, 1985 অনুযায়ী নিম্নলিখিত প্রতিকার চাইতে পারেন:

  • বিয়ে বাতিলের আবেদন (Fraud বা ভুল সম্মতির ভিত্তিতে)

  • মোহরের দাবি প্রত্যাখ্যান

  • তালাক ও ইদ্দতকাল সম্পর্কিত নির্দেশনা

ফৌজদারি প্রতিকার (Criminal Law)

বাংলাদেশ দণ্ডবিধি, ১৮৬০ অনুযায়ী প্রযোজ্য ধারা:

ধারা বিষয়
৪১৭ প্রতারণা
৪১৯ ভুয়া পরিচয়ে প্রতারণা
৪৯৫ পূর্বের বিয়ের তথ্য গোপন রেখে পুনরায় বিয়ে (সর্বোচ্চ ৭ বছরের সাজা)

ধারা ৪৯৫ সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ, কারণ এটি সরাসরি বিবাহ প্রতারণার বিরুদ্ধে প্রযোজ্য।

প্রাসঙ্গিক মামলা: রেফারেন্স

State vs Khadija Begum, 45 DLR (1993)
এই মামলায় স্ত্রী প্রতারণার মাধ্যমে বিয়ে করেন। আদালত রায়ে বলেন, প্রতারণা প্রমাণিত হলে স্বামী মোহরের পরিমাণ কমানোর অধিকার রাখেন

বিদেশে অবস্থানরত স্বামীর আইনি প্রতিকার

যদি স্বামী বিদেশে অবস্থান করেন, তবে তিনিও আইনি প্রতিকার নিতে পারেন নিচের উপায়ে:

১. Power of Attorney (POA)

  • বিদেশে নোটারি পাবলিকের মাধ্যমে POA তৈরি

  • বাংলাদেশ দূতাবাসে সত্যায়ন

  • দেশের রেজিস্ট্রি অফিসে নিবন্ধন

  • সংশ্লিষ্ট ব্যক্তির মাধ্যমে মামলা দায়ের

২. ভার্চুয়াল শুনানি (Virtual Hearing)

Zoom/Skype-এর মাধ্যমে কিছু আদালতে ভার্চুয়াল শুনানির সুযোগ রয়েছে। এর জন্য আবেদন করে অনুমতি নিতে হয়।

৩. দূতাবাসের সহায়তা

বিদেশ থেকে বাংলাদেশ দূতাবাসে লিখিত অভিযোগ দেওয়া যায়, যা সংশ্লিষ্ট থানায় প্রেরিত হয়ে তদন্তের আওতায় আসতে পারে।

দেওয়ানি ও ফৌজদারি মামলা একসাথে চালানো যায় কি?

হ্যাঁ, দেওয়ানি ও ফৌজদারি মামলা একসাথে এবং সমান্তরালভাবে চালানো সম্ভব।

রেফারেন্স:

  • C. Verghese v. T. J. Poonan, AIR 1970 SC 1876

  • Rupchand vs Mahadeo Prasad, AIR 1956 Pat 173

এই রায়গুলোতে বলা হয়েছে, দেওয়ানি আদালত ব্যক্তিগত ক্ষতি (যেমন বিয়ে বাতিল, মোহর প্রত্যাখ্যান) আর ফৌজদারি আদালত অপরাধমূলক প্রতারণা নিয়ে বিচার করতে পারে।

উপসংহার: সততা ও স্বচ্ছতা ছাড়া বিবাহের বন্ধন দুর্বল

তথ্য গোপন করে বিয়ে করা:

  • ইসলামী ধর্মে নৈতিক বিচ্যুতি

  • বাংলাদেশের আইনে প্রতারণামূলক অপরাধ

যদিও বিয়ে বৈধ হতে পারে, তথাপি প্রতারণা প্রমাণ হলে স্বামী ফ্যামিলি কোর্টে বিয়ে বাতিল, মোহর প্রত্যাখ্যান ও ফৌজদারি আদালতে প্রতারণা মামলা দায়ের করতে পারেন। বিদেশে অবস্থান করলেও Power of Attorney ও ভার্চুয়াল শুনানির মাধ্যমে প্রতিকার নেওয়া সম্ভব।

বিয়ে কেবল দুটি মানুষের সম্পর্ক নয়, এটি সমাজে বিশ্বাস, সম্মান ও দায়বদ্ধতার প্রতিচ্ছবি। তাই প্রতারণার শিকার ব্যক্তি যেমন আইনগত প্রতিকারের অধিকারী, তেমনি সমাজের প্রতিও আমাদের দায়িত্ব—সততা ও স্বচ্ছতার নীতিতে পারিবারিক সম্পর্ক গড়ে তোলা

লেখক : অ্যাডভোকেট, ঢাকা জজ কোর্ট। ই-মেইল: almustashimnobi.niku@gmail.com