চেকের মামলা দেওয়ানী মোকদ্দমার মতো সংশোধনী ও প্রাসঙ্গিক আইন
অ্যাডভোকেট সিরাজ প্রামাণিক

জমি আপনার, দখল অন্যের, কী করবেন?

সিরাজ প্রামাণিক : একজনের নামে থাকা জমি ১২ বছর ধরে অন্য কেউ ভোগদখলে থাকলেই জমি তার হয়ে যাবে-এমন ভ্রান্ত ধারনার দিন শেষ। আপনি জমি কিনেছেন কিংবা উত্তরাধিকারসূত্রে জমি পেয়েছেন। জমির মালিকানা সংক্রান্ত সকল কাগজপত্র আপ-টু-ডেটও আছে। নিজের জমি, অথচ আপনার দখলে নেই। গায়ের জোরে কিংবা সামান্য অজুহাত দেখিয়ে জমি দখল করে নিয়েছে কিংবা আংশিক দখল করে নিয়ে নিয়েছে কিংবা জমি দাবী করে বসছে। এখন কী করবেন?

আমাদের সুনির্দিষ্ট প্রতিকার আইন ১৮৭৭ এর ধারা ৯ এ বলা আছে- ‘স্থাবর সম্পত্তি হতে যদি কেউ অন্যায়ভাবে দখলচ্যূত হন, তাহলে তিনি অথবা তার মাধ্যমে দাবিদার কোন ব্যক্তি মামলার মাধ্যমে তার দখল পুনরুদ্ধার করতে পারেন। অন্যদিকে ফৌজদারী কার্যবিধির ধারা ১৪৫ উপধারা ৬ এ বলা আছে, আইনসঙ্গতভাবে উচ্ছেদ না হওয়া পর্যন্ত দখলে থাকা পক্ষ দখল বহাল রাখিবে। ‘দখল সব সময় বৈধ স্বত্বকে অনুসরণ করে। (৩৮ ডিএলআর (এডি) ২২)।

অন্যত্র বলা আছে- ‘আসল বা প্রকৃত মালিকের যদি বৈধ স্বত্বাধিকারের অস্তিত্ব থাকে, তবে দখল করলেই বিরুদ্ধ দখল সৃষ্টি হয় না (২০ বিএলডি (হাইকোট) ৪০৭)।’

উচ্চ আদালতের এই সকল সিদ্ধান্ত থেকে সহজেই বুঝা যায়, জবর দখল স্বীকৃত কোন পন্থা হতে পারে না, সেটা ১২ কেন ১০০ বছর হলেও। একটি উদাহরণ দিলে বিষয়টি আরও পরিস্কার হয়ে উঠবে। বৈধ দলিল ছাড়া শুধুমাত্র ১২ বছর বা ২০ বছর দখলে থাকলে রহিমের সম্পত্তির মালিক করিম হয়ে যাবে। এটা কোন আইন হতে পারে না।

আপনাদেরকে আরেকটি বিষয় জানিয়ে রাখি, জমি থেকে বেদখল হলে দখল পুনরুদ্ধারের জন্য ফৌজদারি ও দেওয়ানি দুই আদালতে মামলা করা যায়। কোনো ব্যক্তি তাঁর সম্পত্তি থেকে বেদখল হওয়ার দুই মাসের মধ্যে তিনি ওই ব্যক্তিকে বেদখল করার চেষ্টা থেকে বিরত করার জন্য বা সম্পত্তিতে ওই দখলকারী ব্যক্তির প্রবেশ বারিত করে আদেশ প্রদানের জন্য নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট আদালতে ফৌজদারি কার্যবিধির ১৪৪ অথবা ১৪৫ ধারার বিধান অনুসারে মামলা করতে পারবেন।

এ ধরনের মামলা অল্প সময়ের মধ্যেই নিষ্পত্তি হয়ে থাকে। মামলা দায়ের হলে ম্যাজিস্ট্রেট অপর পক্ষের ওপর সমন জারি করবেন। উভয় পক্ষের বক্তব্য এবং সাক্ষ্য-প্রমাণ শেষে সম্পত্তির দখলদার নির্ণয় করবেন। এসিল্যান্ডের মাধ্যমে সরেজমিনে তদন্তের ভিত্তিতে প্রকৃত দখলদার নির্ণয় করা হতে পারে। এরপর আইনানুগভাবে উচ্ছেদের আদেশ দেওয়া হয়।

আর দখল সংক্রান্ত বিষয়ে দীর্ঘ সময় অতিবাহিত হয়ে গেলে, আপনি সুনির্দিষ্ট প্রতিকার আইনের ৮ ধারা অনুযায়ী প্রতিকার চেয়ে দেওয়ানি আদালতে মামলা করতে পারেন। আইনটির ৮ ধারা অনুযায়ী, আপনাকে ওই জমিতে স্বত্ব বা মালিকানা আছে বলে প্রমাণ দিতে হবে। এ ধারার স্বত্ব প্রমাণসহ মামলা করার ক্ষেত্রে বেদখল হওয়ার পর থেকে ১২ বছরের মধ্যে মোকদ্দমা দায়ের করতে হবে। এ ক্ষেত্রে জমির মূল্যের ওপর ভিত্তি করে সেই অনুপাতে কোর্ট ফি জমা দিয়ে মোকদ্দমা করতে হয়।

এছাড়া “ভূমি অপরাধ প্রতিরোধ ও প্রতিকার আইন” অনুয়ায়ী জমির প্রকৃত মালিক দ্রুত ও কার্যকর প্রতিকার পেতে সরাসরি নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেটের কাছে আবেদন করতে পারবেন।

এ আইনের ৭ নম্বর ধারা অনুযায়ী, যদি কেউ বৈধ মালিকানাধীন জমি থেকে আপনাকে উচ্ছেদের চেষ্টা করে কিংবা দখল করে নেয়, তাহলে আপনি সরাসরি সংশ্লিষ্ট নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেটের কাছে লিখিত আবেদন করে প্রতিকার পেতে পারেন। আবেদন প্রাপ্তির পর নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট অপর পক্ষকে কারণ দর্শানোর জন্য নোটিশ প্রদান করবেন। প্রয়োজন হলে সরেজমিন তদন্ত বা সংশ্লিষ্ট সার্ভেয়ারের মাধ্যমে যাচাই করবেন। যাচাই শেষে যথাযথ আদেশ প্রদান করবেন। জরুরি হলে মোবাইল কোর্ট পরিচালনা করে দখলদার উচ্ছেদ করে প্রকৃত মালিককে জমির দখল ফিরিয়ে দিতে পারবেন। আদেশ অমান্য করলে ওয়ারেন্ট ইস্যু করে আইনানুগ ব্যবস্থা নিতে পারবেন। এমনকি ভবিষ্যতে এমন ঘটনা যেন না ঘটে, সে জন্য বন্ড/মুচলেকা নেওয়ারও ব্যবস্থা করতে পারবেন। এই ধরনের অভিযোগ ৪৫ দিনের মধ্যে নিষ্পত্তির কথা বলা হয়েছে আইনে।

তবে, জমি উত্তরাধিকার সূত্রে প্রাপ্ত হয় এবং এখনো বণ্টন না হয় বা দেওয়ানী আদালতে মামলা চলমান থাকে, তাহলে নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট হস্তক্ষেপ করতে পারবেন না। সে ক্ষেত্রে আপনি দেওয়ানী আদালতে বিচারকের দৃষ্টি আকর্ষণ করে মোবাইল কোর্টের জন্য আবেদন করতে পারেন।

লেখক: বাংলাদেশ সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবী, আইনগ্রন্থ প্রণেতা ও পিএইচ. ডি ফেলো। ইমেইলঃ ংবৎধল.ঢ়ৎধসধহরশ@মসধরষ.পড়স