ব্যারিস্টার কেয়া সেন : “নারী”অর্থাৎ মাতৃরূপ। জাতীয় কবি কাজী নজরুলের ভাষায় “বিশ্বের যা কিছু মহান সৃষ্টি, চির কল্যাণকর অর্ধেক তার করিয়াছে নারী অর্ধেক তার নর”। পৃথিবীর প্রতিটি ধর্মই নারীকে দিয়েছে গভীর মর্যাদা এবং সম্মান। ইসলাম ধর্মে নারী ও পুরুষকে সমান মর্যাদা দেওয়া হয়েছে। কুরআন ও হাদিসে নারী-পুরুষের দায়িত্বের ব্যাপারে স্পষ্ট নির্দেশনা দেওয়া রয়েছে এবং উভয়কেই তাদের কৃতকর্মের জন্য আল্লাহর নিকট সমানভাবে জিজ্ঞাসিত হবার বিধান রয়েছে। ইসলাম ধর্ম অনুযায়ী নারী এবং পুরুষ প্রত্যেকই তাদের কর্মফল অনুযায়ী সমানভাবে পরকালে প্রতিদান পাবেন।
হযরত মুহাম্মদ (সাঃ) নারী ও পুরুষ উভয়কেই শিক্ষা অর্জনের জন্য উৎসাহিত করেছেন এবং তিনি ঘোষণা করেছেন যে জ্ঞান অর্জন করা প্রতিটি মুসলিম পুরুষ ও নারীর নীতিগত এবং ধর্মীয় কর্তব্য। ইসলামে নারী এবং পুরুষ উভয়ের পর্দা সম্পর্কেও বলা হয়েছে। পবিত্র কোরআনের সূরা নূরে বলা হয়েছে “প্রত্যেক বিশ্বাসী পুরুষদের বলো, তারা যেন তাদের দৃষ্টিকে অবনত রাখে। এবং তাদের লজ্জাস্থান সমূহ হেফাজত করে। এটাই তাদের জন্য উত্তম পন্থা। আল্লাহ তায়ালা সে বিষয়ে সম্পূর্ণ অবগত। এবং বিশ্বাসী নারীদেরকে বল, তারা যেন তাদের দৃষ্টি অবনত রাখে। এবং তাদের লজ্জাস্থান সমূহের সংযত সংরক্ষণ করে এবং তাদের দৈহিক সৌন্দর্য ও অলংকারের প্রদর্শনী না করে। তবে, অনিবার্যভাবে যা উন্মুক্ত থাকে (তাতে কোনো দোষ নেই)। তারা যেন তাদের বক্ষের উপরে চাদর ঝুলিয়ে দেয় এবং তাদের স্বামী, পিতা, শশুর এবং সন্তানদের ছাড়া তাদের সৌন্দর্য প্রদর্শন না করে”। ২৪:৩০-৩১। এখান থেকে আমরা স্পষ্টই বুঝতে পারি যে নারীদেরকে সম্মান দেবার জন্য পুরুষদেরকে অবশ্যই তাদের দৃষ্টি সংযত রাখার কথা বলা হয়েছে।
আবার হিন্দু ধর্মেও নারীদেরকে দেওয়া হয়েছে সর্বোচ্চ স্থান। ঋকবেদে দেবী সুক্তে নারী শক্তিকে মহাবিশ্বের সারমর্ম হিসেবে ঘোষণা করা হয়েছে। হিন্দুদের উপনিষদ, পুরাণ এই সমস্ত শাস্ত্র গুলিতে নারীকে সবচেয়ে শক্তিশালী এবং ক্ষমতায়নকারী শক্তি হিসেবে উল্লেখ করা হয়েছে। শ্রীমদ ভগবত গীতার বিভূতি যোগের ৩৪ নং স্লোকে স্বয়ং ভগবান শ্রীকৃষ্ণ বলেছেন “আমি নারীগণের মধ্যে কীর্তি, শ্রী, বাক, স্মৃতি, মেধা, ধৃতি এবং ক্ষমা”। অর্থাৎ প্রতিটি নারীর মধ্যেই ঈশ্বরের প্রধান বিভূতি সমূহ বিরাজ করছে। সুতরাং নারীগণকে কোনভাবেই পাপী হিসেবে বিশেষায়িত করা যায় না। নারীকে বলা হয় শুভ্রময়ী। যা দ্বারা তার সৌন্দর্য ও পবিত্রতা বোঝানো হয়। অথচ বর্তমান সমাজে আমরা প্রতিনিয়ত দেখি নারীর প্রতি অবমাননা হিংসা-বিদ্বেষ এবং লাঞ্ছনা।
সম্প্রতি কুমিল্লার মুরাদনগর এর এক ধর্ষিতা নারীকে বিবস্ত্র করে তার ভিডিও চিত্র ধারণ করে কিছু মানুষরূপী পশু যেই বর্বরতার পরিচয় দিয়েছে সেই বিবস্ত্রতা শুধুমাত্র উক্ত ধর্ষিতা নারীর নয়। গোটা দেশ আজ বিবস্ত্র। গোটা নারী জাতি আজ বিবস্ত্র। একজন নারী যাকে ধর্ষণ করা হলো তার নিজ গৃহের দরজা ভেঙে, তারপর যখন সে সাহায্যের জন্য চিৎকার করলো তখন কিছু উৎসুক জনতা এসে তাকে সাহায্যের পরিবর্তে তার বিবস্ত্র/নগ্ন ভিডিও ধারণ করে তা সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ছড়িয়ে দিল। এ কেমন বর্বরতা? যেখানে শাস্তি দেবার জন্য অপরাধীকে দ্রুত আইনের হাতে তুলে দেবার জন্য উদগ্রীব হবার কথা এবং ধর্ষিতা মেয়েটিকে আব্রু দ্বারা আবদ্ধ করার কথা সেখানে তারা নগ্নতার উন্মক্ত আদিম বর্বর খেলায় মেতে উঠল। এই শতাব্দীতে দাঁড়িয়েও মানুষ কি সভ্য হবে না! প্রযুক্তির অপব্যবহার যেন দিনে দিনে বেড়েই চলেছে। ধর্ষিতা নারীকে সাহায্যের পরিবর্তে উল্টো তার চরিত্র নিয়ে প্রশ্ন তুলে তাকে যেন আরো মরমে মেরে ফেলছে এই তথাকথিত সুশীল সমাজ। বাংলাদেশের সাক্ষ্য আইনের ১৫৫ ধারার সংশোধনী অনুযায়ী বর্তমানে কোন ধর্ষণ মামলায় অভিযোগকারী নারীর চরিত্র নিয়ে প্রশ্ন তোলা আইনত অপরাধ।
যদিও পরবর্তীতে উক্ত ধর্ষক গ্রেফতার হয়েছে হয়তোবা ভিডিও ধারণকারীরাও গ্রেফতারের পথে কিন্তু, যেই নারীর নগ্ন ভিডিও এবং সাথে মারধরের চিত্র সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ছড়িয়ে দেওয়া হল এর দায়ভার কে নেবে। সমাজ! দুঃখিত আমাদের তথাকথিত সুশীল সমাজ কি কখনো ওই ধর্ষিতা লাঞ্ছিত মেয়েটিকে মুখ উঁচু করে সমাজে বাঁচতে দিবে। এর দায় এবং অভিশাপ কিন্তু সমাজ আর দেশকেই নিতে হবে।
এ প্রসঙ্গে বলতে চাই নারীর সম্মান এমন মূল্যবান যে তার অবমাননা হলে সেই অভিশাপে একটি দেশ ও সমাজ ধ্বংস হয়ে যেতে পারে। এক্ষেত্রে একটি পৌরাণিক উদাহরণ আনা যেতে পারে। মহাভারতে দ্রৌপদীর বস্ত্রহরণ করেছিল কৌরব পুত্র দুর্যোধন। যার ফলশ্রুতিতে পুরো কৌরব বংশ ধ্বংস হয়ে গিয়েছিল কুরুক্ষেত্র নামক যুদ্ধের ময়দানে। আবার মুসলিম ধর্মের সূরা আত- আয়াত: ৮২ তে বলা হয়েছে “সুতরাং তারা সামান্য হেসে নিক, শীঘ্রই তারা তাদের কৃতকর্মের জন্য প্রচুর কাঁদবে”। প্রস্তুত হও পাপীরা তোমাদের কান্নার জন্য, নারীকে অবমাননা করার জন্য।
যে জাতি নারীদের সম্মান করতে জানে না সে জাতি কখনো উন্নতি লাভ করতে পারে না। নারীর প্রতি সম্মান প্রদর্শন ভবিষ্যৎ প্রজন্মের পুরুষদের জন্য একটি শক্তিশালী উদাহরণ স্থাপন করে। আমরা সকলে জাগ্রত হই ভবিষ্যৎ প্রজন্মকে জাগ্রত করি নারীকে সম্মান করার জন্য। না হলে সেদিন আর দূরে নেই যখন মানুষরূপী অমানুষগুলো আমাদের চোখের সামনে ঘুরে বেড়াবে প্রকাশ্যে কোন দ্বিধা দ্বন্দ্ব ছাড়া।
লেখক : ব্যারিস্টার কেয়া সেন; আইনজীবী, বাংলাদেশ সুপ্রিম কোর্ট।