মো. ফারুক রেজা

অবৈধভাবে সম্পত্তি থেকে উচ্ছেদের বিরুদ্ধে আইনগত সুরক্ষা: ফৌজদারি কার্যবিধির ১৪৫ ধারা ও সুনির্দিষ্ট প্রতিকার আইনের ৯ ধারা তুলনামূলক আলোচনা

মো: ফারুক রেজা : জমি বা স্থাবর সম্পত্তির মালিকানা বা দখল নিয়ে বিরোধ প্রায়ই সহিংসতার দিকে মোড় নেয়। এ ধরনের পরিস্থিতিতে আইনগত প্রতিকারের একাধিক প্রতিকারের মধ্যে দুটি প্রধান উপায় হলো ফৌজদারি কার্যবিধির ধারা ১৪৫ এবং সুনির্দিষ্ট প্রতিকার আইনের ধারা ৯। উভয় ধারাই বেআইনিভাবে দখলচ্যুত ব্যক্তিকে দখল ফিরে পেতে সহায়তা করে, তবে তাদের প্রক্রিয়া, লক্ষ্য ও ফলাফল ভিন্ন। এই নিবন্ধে দুটি ধারার সাদৃশ্যতা, বৈসাদৃশ্যতা এবং দখল পুনরূদ্ধারের সুযোগ বিশ্লেষণ করা হয়েছে।

জনশান্তি বজায় রাখার প্রতিরোধমূলক ব্যবস্থা

ফৌজদারি কার্যবিধির ১৪৫ ধারা একটি প্রতিরোধমূলক ফৌজদারি প্রক্রিয়া যা সম্পত্তির মালিকানা নির্ধারণ করে না, বরং শান্তি রক্ষার জন্য সাম্প্রতিক দখল নির্ধারণ করে । এই ধারা অনুযায়ী জমি বা পানি সংক্রান্ত বিরোধের কারণে শান্তিভঙ্গ রোধ করতে জেলা ম্যাজিস্ট্রেট বা বিশেষ ক্ষমতাপ্রাপ্ত নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেটকে ক্ষমতা প্রাপ্ত হয়। পুলিশ প্রতিবেদন বা অন্যান্য নির্ভরযোগ্য তথ্যের ভিত্তিতে বিজ্ঞ নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট একটি লিখিত আদেশ জারী করেন এবং পক্ষগণকে তাদের বাস্তব দখলের ভিত্তিতে লিখিত বক্তব্য দিতে বলেন। (উপ-ধারা ১)।

উক্ত লিখিত আদেশ জারীর ক্ষেত্রে সাম্প্রতিক দখল বিষয়টি বিবেচনা করা হয়। বিরোধ শুরর আগের ২ মাসের মধ্যের দখল বিষয়টি যাচাই করা হয় (উপ-ধারা ৪)।

যদি প্রমাণিত হয় যে কোনো পক্ষকে জোড়পূর্বক বা বেআইনিভাবে বেদখল করা হয়েছে, তবে ম্যাজিস্ট্রেট তাদের দখল ফিরিয়ে দিতে পারেন (উপ-ধারা ৪ ও উপ-ধারা ৬)।

উক্ত ধারা বলে দখলের একটি অস্থায়ী আদেশ জারী হয়, যা স্থায়ী সমাধানের জন্য দেওয়ানী আদালতের রায়ের উপর নির্ভরশীল। যদি জেলা নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট বা বিশেষ ক্ষমতাপ্রাপ্ত নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট প্রয়োজন মনে করেন তাহলে সম্পত্তি ক্রোকের আদেশ প্রদান করতে পারেন (উপ-ধারা ৪)। আলোচ্য ধারা মালিকানার প্রশ্ন নিষ্পত্তি করে না।

দখল পুনরূদ্ধারে দেওয়ানী প্রতিকার

সুনির্দিষ্ট প্রতিকার আইনের ৯ ধারা একটি দেওয়ানী প্রতিকার যা সেই সব ব্যক্তিদের জন্য যারা অবৈধভাবে ও সম্মতি ব্যতিরেকে ভোগদখলীয় সম্পত্তি হতে তাদের উচ্ছেদ করা হয়েছে। এই ধারায় দখল পুনরূদ্ধারে মালিকানা প্রমাণের প্রয়োজন নেই। উক্ত ধারা বলে অবৈধভাবে দখলচ্যুত ব্যক্তি দ্রূত দখল ফিরে পেতে পারে। মোকাদ্দমা দায়েরের প্রেক্ষিতে শুধু পূর্বের দখল এবং বেআইনি উচ্ছেদ প্রমাণ করলেই আদালত দখল ফিরিয়ে দেওয়ার আদেশ দেন।

এমনকি প্রতিপক্ষ উক্ত স্থাবর সম্পত্তি নিয়ে মালিকানা দাবি করলে বা দাবির স্বপক্ষে প্রমানাদি দিলে তা আলাদা মোকাদ্দমা নিষ্পত্তি করতে হয়। উক্ত ধারা বলে আদালত দখল ফিরে পাওয়ার চূড়ান্ত ডিক্রি, যা সাধারণত অপিলযোগ্য নয়। তবে উক্ত আইনে প্রতিকারের জন্য বেআইনি দখলচ্যুত হওয়া থেকে ৬ মাসের মধ্যে মোকাদ্দমা দায়ের করতে হয় তবে সরকারের বিরূদ্ধে উক্ত ধারার আলোকে মোকাদ্দমা করা যায় না।

ফৌজদারি কার্যবিধির ধারা ১৪৫ ও সুনির্দিষ্ট প্রতিকার আইনের ৯ ধারার তুলনামূলক বিশ্লেষণ

সাদৃশ্যতা

উভয় ক্ষেত্রেই মালিকানা বিষয়ে বিরোধ নিস্পত্তি ছাড়াই অবৈধভাবে দখলচ্যুত ব্যক্তির দখল ফিরিয়ে দেওয়া হয় এবং উক্ত ধারা সমূহতে দ্রূত প্রতিকার নিশ্চিত হয়।

যদি জনশান্তির জন্য হুমকি থাকে, তবে ফৌজদারি কার্যবিধি ১৪৫ ধারার অধীনে, উচ্ছেদ হওয়া ব্যক্তি বা পুলিশ ম্যাজিস্ট্রেটের কাছে যেতে পারেন।

ম্যাজিস্ট্রেট তদন্ত করে সম্পত্তি জব্দ করতে পারেন এবং প্রয়োজনে দখল ফেরত দিতে পারেন যদি ২ মাসের মধ্যে জোরপূর্বক উচ্ছেদ হয়ে থাকে।

দখল হারানো ব্যক্তি মালিকানা ছাড়াই সুনির্দিষ্ট প্রতিকার আইনের ৯ ধারা অনুযায়ী দেওয়ানী মোকাদ্দমা করে দখল পুনরূদ্ধার করতে পারেন, যদি উচ্ছেদ অবৈধভাবে ও আইনি প্রক্রিয়া ছাড়া হয়ে থাকে।

বৈসাদৃশ্যতা

উভয় ধারার ধরনের মধ্যে অনেকটা মিল থাকলেও তাদের মধ্যে কিছুটা তারতম্যতা রয়েছে। ফৌজদারি কার্যবিধি ১৪৫ ধারার অধিনে সাধারণত জন শান্তি রক্ষার জন্য প্রয়োগ করা হয় এবং ইহা ফৌজদারি আইনে বর্ণিত একটি প্রতিকার। অপরদিকে সুনির্দিষ্ট প্রতিকার আইনের ৯ ধারা নাগরিকদের (ব্যক্তিগত অধিকার পুনরূদ্ধার) জন্য প্রয়োগ করা হয়। যেহেতু ১৪৫ ধারার কার্যক্রম ফৌজদারি কার্যবিধির আলোকে পরিচালিত হয় তাই এর প্রয়োগ নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট কর্তৃক বাস্তবায়ন করা হয় এবং পুলিশ রিপোর্টের ভিত্তিতে নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট আদেশ প্রদান করেন।

অপরদিকে সুনির্দিষ্ট প্রতিকার আইনের ৯ ধারায় ব্যক্তি কর্তৃক মোকাদ্দমা দায়ের করা হয় এবং আদালতে উপস্থিত স্বাক্ষীদের স্বাক্ষীর আলোকে দেওয়ানী আদালত আদেশ প্রদান করেন। কার্যবিধি ১৪৫ অনুসারে প্রতিকারের জন্য দখলচ্যুত হওয়ার ২ মাসের মধ্যে আবেদন করতে হবে এবং ম্যাজিস্ট্রেট কর্তৃক প্রদত্ত আদেশের বিরূদ্ধে উচ্চ আদালতে চ্যালেঞ্জ করা যায় তবে ৯ ধারা অনুযায়ী দখলচ্যুত হওয়ার ৬ মাসের মধ্যে মোকাদ্দমা দায়ের করতে হয় ও উক্ত ধারায় দেওয়ানী আদালত প্রদত্ত আদেশের বিরূদ্ধে আপিলের সুযোগ নেই তবে রিভিসনের সুযোগ রয়েছে।

কোন ধারা কখন প্রযোজ্য?

ফৌজদারি কার্যবিধির ১৪৫ ধারা এবং সুনির্দিষ্ট প্রতিকার আইনের ৯ ধারা উভয়ই আইনগতভাবে শক্তিশালী উপায় যা জনশৃঙ্খলা বজায় রাখা ও ব্যক্তিগত দখল রক্ষা করার উদ্দেশ্যে প্রণীত। প্রথমটি প্রতিরোধমূলক যা রাষ্ট্রের পক্ষ থেকে নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেটের মাধ্যমে, এবং দ্বিতীয়টি ব্যক্তিগত উদ্যোগে দেওয়ানী আদালতের মাধ্যমে প্রয়োগযোগ্য।

এই ধারাদ্বয় আমাদের আইনের মূলনীতি প্রতিফলিত করে যে, কেউ শক্তিতে নয়, কেবল মাত্র আইনের মাধ্যমে, আদালতের আদেশের মাধ্যমে কোন স্থাবর সম্পত্তি দখল নেওয়া যেতে পারে। প্রকৃত মালিকও তার স্থাবর সম্পত্তি আইনগত উপায় ব্যতিত দখল নিতে পারবে না। তবে এখানে উল্লেখ্য যে উভয় ধারাই দখল পুনরূদ্ধারে সহায়ক, তবে পরিস্থিতি অনুযায়ী সঠিক ধারা বেছে নেওয়া জরুরী। যথাযথ ধারার আলোকে আইনগত পদক্ষেপ নিলে জটিলতা এড়ানো যায়। সম্পত্তি বিরোধে সচেতনতা ও সময়মতো আইনি ব্যবস্থাই ন্যায়বিচার নিশ্চিত করে।

লেখক: মো. ফারুক রেজা, আইনজীবী, বাংলাদেশ সুপ্রীম কোর্ট। ই-মেইল: farukreza2000@yahoo.com