খাস কামরায় নয়, বিচারিক আদালতের আদেশ-রায় দিতে হবে প্রকাশ্য আদালতে
বাংলাদেশ সুপ্রিম কোর্ট

অধস্তন আদালতের বিচারকদের শৃঙ্খলা বিধি অনুমোদনের আদেশ স্থগিত

অধস্তন আদালতের বিচারকদের চাকরির শৃঙ্খলা সংক্রান্ত ২০১৮ সালের আপিল বিভাগের অনুমোদনকে স্থগিত করেছেন দেশের সর্বোচ্চ আদালত।

আজ রোববার (২৯ জুন) প্রধান বিচারপতি ড. সৈয়দ রেফাত আহমেদ-এর নেতৃত্বে ছয় সদস্যের আপিল বিভাগ বেঞ্চ এই আদেশ দেন। বেঞ্চের অন্য ৫ জন হলেন— বিচারপতি মো. আশফাকুল ইসলাম, বিচারপতি জুবায়ের রহমান চৌধুরী, বিচারপতি মো. রেজাউল হক, বিচারপতি এস এম এমদাদুল হক ও বিচারপতি ফারাহ মাহবুব।

এদিনই রিভিউ আবেদনের ওপর আদেশের জন্য নির্ধারিত ছিল। আদালত ২০১৮ সালের পাঁচ সদস্যবিশিষ্ট আপিল বিভাগের আদেশ স্থগিত করেন, যেখানে বাংলাদেশ জুডিশিয়াল সার্ভিস (শৃঙ্খলা) বিধিমালা-২০১৭ অনুমোদন দেওয়া হয়েছিল।

এ আদেশের ফলে সংবিধানের ১১৬ অনুচ্ছেদ নিয়ে হাইকোর্টে যে রিট শুনানি চলছে, তা নিষ্পত্তি করতে আর কোনো বাধা থাকলো না বলে জানিয়েছেন আইনজীবী মোহাম্মদ শিশির মনির। এসময় আদালতে রাষ্ট্রপক্ষে ছিলেন অ্যাটর্নি জেনারেল মো. আসাদুজ্জামান।

এর আগে আইনজীবী মোহাম্মদ শিশির মনিরসহ আটজন আইনজীবী এই আদেশের বিরুদ্ধে রিভিউ আবেদন করেছিলেন।

তাঁদের মতে, এই বিধিমালার মাধ্যমে অধস্তন আদালতের বিচারকদের শৃঙ্খলা, বদলি, পদোন্নতি ও ছুটির বিষয়টি আইন মন্ত্রণালয়ের হাতে ন্যস্ত করা হয়—যা বিচার বিভাগের স্বাধীনতার পরিপন্থী।

শিশির মনির বলেন, “আজ শুনানিকালে বলেছি যে বিচার বিভাগকে “অ্যাসল্ট করে” এই শৃঙ্খলা বিধি গ্রহণ করা হয়েছিল তৎকালীন ভারপ্রাপ্ত প্রধান বিচারপতির নেতৃত্বে। কারণ, তার আগে নয়জন বিচারপতি এ বিষয়ে ভিন্ন আদেশ দিয়েছিলেন। এটি বিচার বিভাগের ইতিহাসে নজিরবিহীন ঘটনা। বিচার বিভাগকে ব্যবহার করে তৎকালীন সরকার বাধ্য করেছিল নিম্ন আদালতের বিচারকদের চাকরির শৃঙ্খলা-সংক্রান্ত বিধিমালা প্রণয়নের গেজেট সংক্রান্ত আদেশ দিতে। এটি দ্রুত রিভিউ করা প্রয়োজন বলেই আদালতের অনুমতি নিয়ে রিভিউটি করা হয়েছে।”

মাসদার হোসেন মামলার পটভূমি

১৯৯৯ সালের ২ ডিসেম্বর মাসদার হোসেন মামলার রায়ে আপিল বিভাগ বিচার বিভাগকে নির্বাহী বিভাগ থেকে পৃথক করার জন্য ১২ দফা নির্দেশনা দেয়। সেই ধারাবাহিকতায় শৃঙ্খলা বিধিমালা প্রণয়নের নির্দেশনা দেওয়া হয়, যাতে বিচার বিভাগ নিজস্ব ব্যবস্থাপনায় চলতে পারে।

১২ দফা নির্দেশনা নিম্নরূপ-

১. সংবিধানের ১৫২ (১) অনুচ্ছেদ অনুযায়ী রাষ্ট্রীয় সব বিভাগের কাজ সার্ভিস অব রিপাবলিকের ভেতরে পড়বে। তবে বিচার বিভাগের কাজ ও অবকাঠামোর সঙ্গে প্রজাতন্ত্রের সিভিল সার্ভিসের অনেক ভিন্নতা রয়েছে। বিচার বিভাগকে অন্যান্য সিভিল সার্ভিসের সঙ্গে একত্রিত করা যাবে না;

২. বিচারিক ম্যাজিস্ট্রেটদের নির্বাহী বিভাগ থেকে আলাদা করা এবং নির্বাহী বিভাগের ম্যাজিস্ট্রেটরা বিচারিক কাজ করতে পারবেন না;

৩. সিভিল সার্ভিস অর্ডার ১৯৮০ অনুযায়ী সব ম্যাজিস্ট্রেটকে পিএসসির অধীনে বিসিএস পরীক্ষার মাধ্যমে একসঙ্গে নিয়োগ দেওয়া হয়। একসঙ্গে নিয়োগ দেওয়া সংবিধান পরিপন্থি;

৪. এই রায় পাওয়ার পর যত দ্রুত সম্ভব জুডিশিয়াল সার্ভিস কমিশন বিধিমালা এবং কমিশন গঠন করতে হবে;

৫. সংবিধানের ১১৩ অনুচ্ছেদ অনুযায়ী রাষ্ট্রপতি জুডিশিয়ারির সবার চাকরির বিধিমালা (নিয়োগ, পদায়ন, বদলি পদোন্নতি ও ছুটিসহ অন্যান্য) প্রণয়ন করবেন;

৬. রাষ্ট্রপতি জুডিশিয়াল সার্ভিস পে-কমিশন বিধিমালা প্রণয়ন করবে;

৭. সংবিধানের ১১৬ অনুচ্ছেদ অনুযায়ী জুডিশিয়াল ম্যাজিস্ট্রেটদের নিয়ন্ত্রণ করার ক্ষমতা সুপ্রিম কোর্টের থাকবে;

৮. বিচার বিভাগ জাতীয় সংসদ বা নির্বাহী বিভাগের অধীনে থাকবে না এবং জুডিশিয়াল ম্যাজিস্ট্রেটসহ সব বিচারক স্বাধীনভাবে কাজ করবেন;

৯. জুডিশিয়ারির (নিম্ন আদালত) বার্ষিক বাজেট প্রণয়নের ওপর নির্বাহী বিভাগের কোনো হাত থাকবে না।

এই বাজেট সুপ্রিম কোর্ট প্রণয়ন এবং বরাদ্দ করবে;

১০. জুডিশিয়াল সার্ভিসের সদস্যরা প্রশাসনিক আদালতের আওতাভুক্ত থাকবেন;

১১. এই রায় অনুযায়ী বিচার বিভাগ পৃথককরণের জন্য সংবিধানে কোনো সংশোধন করার প্রয়োজন নেই। তবে পৃথককরণ আরও অর্থবহ করতে যদি সংবিধান সংশোধনের প্রয়োজন হয়, তবে তা করা যাবে;

১২. জুডিশিয়াল পে-কমিশন: জুডিশিয়াল পে-কমিশন জুডিশিয়ারির সদস্যদের বেতন-ভাতাসহ অন্যান্য সুবিধা বাড়ানোর বিষয়ে যতদিন পর্যন্ত রাষ্ট্রপতির কাছে সুপারিশ না করবে, ততদিন পর্যন্ত বর্তমান অবকাঠামো অনুযায়ী তার সব সুযোগ-সুবিধা ভোগ করবেন।

২০০৫ সালে এই রায় বহাল রাখেন আপিল বিভাগ। ওই রায়ের আলোকে নিম্ন আদালতের বিচারকদের চাকরির শৃঙ্খলা-সংক্রান্ত বিধিমালা প্রণয়নের নির্দেশনা ছিল।

২০১৬ সালে আইন মন্ত্রণালয় প্রস্তাবিত খসড়াটি আদালতে জমা দিলেও তা সরকারি কর্মচারী (শৃঙ্খলা ও আপিল) বিধিমালার মতো হওয়ায় আপিল বিভাগ তা বাতিল করে। পরবর্তীতে সংশোধিত খসড়ার ভিত্তিতে ২০১৭ সালের ১১ ডিসেম্বর প্রজ্ঞাপন জারি করা হয়।