ফেনী জেলার সোনাগাজী পারিবারিক আদালত এক রায়ে বাদীর পক্ষে দেনমোহর আদায়ে আংশিক ডিক্রি প্রদান করেছে। পাশাপাশি আদালত তালাকনামা জালিয়াতির অভিযোগে তার বিরুদ্ধে ফৌজদারি মামলার নির্দেশ দিয়েছে।
আজ সোমবার (৩০ জুন) ফেনী জেলার সোনাগাজী পারিবারিক আদালতের বিচারক সহকারী জজ সবুজ হোসেন এ রায় দেন।
সংশ্লিষ্ট আদালতের বেঞ্চ সহকারী হারিস মাহমুদ মজুমদার ল’ইয়ার্স ক্লাব বাংলাদেশ ডটকমকে জানান, ইতোমধ্যে মাননীয় বিচারক সবুজ হোসেন নিজেই ওই আদেশ অনুযায়ী ফেনী সদর আমলী আদালতের মাননীয় সিনিয়র জুডিশিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট বরাবর লিখিত অভিযোগ প্রেরণ করেছেন।
মামলার প্রেক্ষাপট
নুসরাত জাহান, সোনাগাজী উপজেলার বাসিন্দা, তার প্রাক্তন স্বামী আবদুল গোফরান ও তার পরিবারের তিন সদস্যের বিরুদ্ধে ২০২১ সালে ফ্যামিলি স্যুট নং ২৬/২০২১ হিসেবে একটি মামলা দায়ের করেন।
মামলায় তিনি দেনমোহর, ইদ্দতকালীন খোরপোষ, আসবাবপত্র ও পূর্বে হাওলাত হিসেবে দেওয়া অর্থসহ মোট নয় লাখ ত্রিশ হাজার টাকা দাবি করেন।
বাদীর দাবি ছিল, ১৮ জুলাই ২০১৯ তারিখে ইসলামী শরিয়ত মোতাবেক রেজিস্ট্রি কাবিননামার মাধ্যমে বিবাহ সম্পন্ন হয়।
দেনমোহর নির্ধারণ করা হয় সাত লাখ টাকা, যার মধ্যে দুই লাখ টাকা তাৎক্ষণিক পরিশোধ করা হয় এবং পাঁচ লাখ টাকা বকেয়া থেকে যায়।
তিনি আরও দাবি করেন, বিবাহের সময় তার পিতা দুই লাখ টাকার আসবাবপত্র দেন এবং বিবাহের কিছুদিন পর স্বামী বিদেশ যাবে বলে হাওলাত হিসেবে দুই লাখ টাকা নেন।
বাদী অভিযোগ করেন, বিবাদী স্বামী বিদেশে গিয়ে তার খোঁজখবর নেয়নি, বরং পরিবারের পক্ষ থেকে মানসিক ও শারীরিক নির্যাতনের শিকার হন তিনি।
এই পরিস্থিতিতে ৮ মে ২০২১ তারিখে ইসলামি শরিয়ত মোতাবেক তিনি স্বামীকে তালাক দেন এবং এরপর ইদ্দতকালীন খোরপোষ বাবদ মাসিক ১০ হাজার টাকা করে তিন মাসের ৩০ হাজার টাকা দাবি করেন।
বিবাদীপক্ষের জবাব
বিবাদীপক্ষ আদালতে লিখিত জবাব দাখিল করে দাবি করেন, বাদী প্রকৃত তালাকের আগে অন্য এক ব্যক্তিকে বিয়ে করেন এবং বিষয়টি স্থানীয় সালিশের মাধ্যমে উভয়পক্ষ মেনে নিলেও বাদী মিথ্যা ও জাল কাগজপত্র তৈরি করে আদালতে মামলা করেছেন।
তারা অভিযোগ করেন, তালাকনামায় উল্লিখিত তারিখ জাল এবং নোটিশ ও হলফনামায় ঘষামাজা করে তারিখ পরিবর্তন করা হয়েছে।
তারা আরও বলেন, বাদী ইদ্দতকাল যথাযথভাবে পালন করেননি এবং যে পরিমাণ টাকা ও আসবাবপত্র দাবি করা হয়েছে তা অসত্য। বরং বাদী নিজেই বিবাহের সময় উপহার ও স্বর্ণালঙ্কার আত্মসাৎ করেছেন বলে দাবি করেন।
আদালতের পর্যবেক্ষণ ও সিদ্ধান্ত
সোনাগাজী পারিবারিক আদালতের বিচারক সবুজ হোসেন মামলার নথি, উভয় পক্ষের জবানবন্দি ও দাখিলকৃত কাগজপত্র বিশ্লেষণ করে রায় প্রদান করেন।
আদালত কাবিননামার মাধ্যমে বিবাহের বিষয়টি ও দেনমোহর বাবদ পাঁচ লাখ টাকা পাওনার বিষয়টি নিশ্চিত করেন।
আদালত বলেন, বাদী তার মৌখিক ও দালিলিক সাক্ষ্য দ্বারা দেনমোহর প্রমাণ করতে সক্ষম হয়েছেন।
তবে আদালত তার রায়ে উল্লেখ করেন, বাদীর দাখিলকৃত তালাকনামা ও হলফনামায় উল্লেখিত তারিখসমূহ ঘষামাজা করে জালিয়াতির মাধ্যমে পরিবর্তন করা হয়েছে। স্ট্যাম্পের পেছনে তারিখ মুছে ফেলে নতুন তারিখ লেখা হয়েছে, যা প্রমাণ করে যে তালাক সংক্রান্ত নথিপত্র জাল করা হয়েছে। এই কারণে আদালত ওই হলফনামা বাজেয়াপ্ত করেন।
আদালতের পর্যবেক্ষণে আরও উঠে আসে, বাদী ৮ মে ২০২১ তারিখে তালাক প্রদানের দাবি করলেও তিনি ১১ সেপ্টেম্বর ২০২১ তারিখে দ্বিতীয় বিয়ে করেন, যা তালাকের ৯০ দিন পূর্ণ হওয়ার আগেই সম্পন্ন হয়। ফলে বাদী ইদ্দতকালীন খোরপোষ পাওয়ার অধিকার রাখেন না।
এছাড়াও আদালত বলেন, বাদী তার অন্যান্য দাবি—যেমন হাওলাতের টাকা ও আসবাবপত্র প্রদান সংক্রান্ত বিষয়াদি—উপযুক্ত প্রমাণাদির অভাবে প্রমাণ করতে পারেননি।
আদেশের সারাংশ
বিচারক তার রায়ে বলেন, মামলার প্রেক্ষিতে বাদী দেনমোহর বাবদ পাঁচ লাখ টাকা পাওয়ার যোগ্য। আদালত প্রতিপক্ষ আবদুল গোফরানকে এই টাকা আদেশপ্রাপ্তির ৬০ দিনের মধ্যে পরিশোধের নির্দেশ দিয়েছেন। ব্যর্থ হলে বাদী আদালতের মাধ্যমে টাকা আদায়ের ব্যবস্থা নিতে পারবেন।
তবে তালাক সংক্রান্ত হলফনামা ও নোটিশে জালিয়াতির প্রমাণ পাওয়ায় আদালত বাদী নুসরাত জাহানের বিরুদ্ধে বাংলাদেশ দণ্ডবিধির ৪৬৫ ও ৪৭১ ধারা অনুযায়ী জাল দলিল প্রস্তুত ও জাল দলিল খাঁটি হিসেবে ব্যবহারের অভিযোগে ফৌজদারি মামলা দায়েরের নির্দেশ দিয়েছেন।
আদালত এই রায়কে একটি ফৌজদারি অভিযোগ হিসেবে গণ্য করার কথা উল্লেখ করে আদেশের অনুলিপি চীফ জুডিশিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট, ফেনী বরাবর প্রেরণের নির্দেশ দেন।
প্রযোজ্য আইন
এই মামলার রায়ে বাংলাদেশ দণ্ডবিধি, ১৮৬০ এর ধারা ৪৬৫ (জালিয়াতি) ও ৪৭১ (জাল দলিল খাঁটি হিসেবে উপস্থাপন) প্রযোজ্য করা হয়েছে। পাশাপাশি পারিবারিক আদালত অধ্যাদেশ, ১৯৮৫ অনুযায়ী দেনমোহর ও ইদ্দতকালীন খোরপোষ সংক্রান্ত বিষয়গুলো নির্ণয় করা হয়।
আদালতে প্রেরিত অভিযোগপত্র
রায়ের পরপরই বিচারক সবুজ হোসেন ফেনী সদর আমলী আদালতের সিনিয়র জুডিশিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট বরাবর অভিযোগপত্র প্রেরণ করেন। অভিযোগপত্রে তিনি বলেন—
নুসরাত জাহান কর্তৃক ইচ্ছাকৃতভাবে জালিয়াতি করে তালাকের হলফনামা তৈরি করা এবং আদালতে তা খাঁটি দলিল হিসেবে উপস্থাপন করা স্পষ্টতই The Penal Code, 1860 এর ৪৬৫ ও ৪৭১ ধারা মোতাবেক শাস্তিযোগ্য অপরাধ। আদালতের রায়ের নির্দেশ অনুযায়ী আমি এই অভিযোগ দায়ের করছি, যাতে তার বিরুদ্ধে যথাযথ শাস্তিমূলক ব্যবস্থা গ্রহণ করা যায়।
বিচারক তার লিখিত অভিযোগের সঙ্গে মামলার রায়ের একটি অনুলিপিও সংযুক্ত করেন এবং আইনানুগ ব্যবস্থা গ্রহণের জন্য আহ্বান জানান।
এই অভিযোগের গুরুত্ব
এই ধরনের অভিযোগ বিরল হলেও অত্যন্ত তাৎপর্যপূর্ণ। এটি প্রমাণ করে, আদালত শুধু রায় প্রদানে সীমাবদ্ধ নয় বরং জালিয়াতির মতো গুরুতর অপরাধের বিরুদ্ধে আইনানুগ ব্যবস্থা গ্রহণেও সক্রিয় ভূমিকা পালন করতে প্রস্তুত। এই ঘটনায় আদালতের নিরপেক্ষতা ও ফৌজদারি বিচারে স্বচ্ছতা নিশ্চিতের প্রতিচ্ছবি পাওয়া যায়।
নজিরবিহীন সিদ্ধান্ত
এই রায় বাংলাদেশের পারিবারিক আদালত ব্যবস্থায় একটি গুরুত্বপূর্ণ নজির হিসেবে বিবেচিত হবে। বিচারক নিজেই ফৌজদারি অভিযোগ দাখিল করে দেখিয়েছেন যে, আদালতে মিথ্যা তথ্য ও জাল দলিল উপস্থাপন করলে তার পরিণাম হতে পারে ভয়াবহ।
এ ধরনের সিদ্ধান্ত ভবিষ্যতে দেনমোহর, তালাক ও খোরপোষ সংক্রান্ত মামলাগুলিতে দলিল যাচাই-বাছাইয়ের গুরুত্ব আরো বাড়াবে এবং বিচার ব্যবস্থায় স্বচ্ছতা বজায় রাখতে সহায়ক হবে।