মো. জুনাইদ

“আপনার কান এখনো চিলে নেয়নি? তাহলে শোনেন একবার…”

মো. জুনাইদ : রাঙ্গামাটির পাহাড়ি পথ পেরিয়ে অনেক দিন লিগ্যাল এইড অফিসে কাজ করেছি। আপোষে নিস্পত্তি করেছি হাজারো ভূমি বিরোধ, সম্পত্তি বন্টন আর ভাড়াটিয়া-বাড়িওয়ালার ঝামেলা। কিন্তু সব অভিজ্ঞতার মধ্যেও কিছু কিছু ঘটনা আজও মনে পড়ে, যেমন— ১২ বছর ধরে কাপ্তাই লেকে দখল হয়ে থাকা একটি “খোপ” (মাছ ধরার জায়গা) মাত্র ৭ দিনে ফিরিয়ে দিতে পেরেছিলাম, শুধু একখানা লিগ্যাল এইডের নোটিশে! মালিক খোপ ফিরে পেয়ে চোখের জল ধরে রাখতে পারেননি।

আজ, যখন লিগ্যাল এইড নিয়ে নতুন আইন হয়েছে, তখন অনেকের কানে যেন খবরই যায়নি। কেউ বলে, “কোর্টের আদেশ ছাড়া কিছু হবে নাকি?”, কেউ সন্দেহ করে, “বিলম্ব ছাড়া কিছু হয় নাকি?”

তাই ভাবলাম, সরাসরি প্রশ্ন-উত্তরের গল্পেই বলি—এই নতুন আইনে কী বদল এসেছে।

১. জরুরি আদেশের দরকার হলে কি হবে? কোর্টে দৌড়াতে হবে?

নতুন আইনের ২১(ঘ) ধারা বলছে—লিগ্যাল এইড অফিসার নিজেই জরুরি আদেশ দিতে পারবেন। অফিসে যদি অভিজ্ঞ বিচারক থাকেন, ফলাফল হবে বাস্তবিকই চমৎকার। তাহলে আর “লিগ্যাল এইডে ঘুরতে ঘুরতে মারা খাবে”—এমন কথার দিন শেষ।

২. বিবাদী নোটিশ পেয়ে পাত্তা না দিলে কী হবে? একতরফা আদেশ?

না, লিগ্যাল এইড কোনো জোর করে রায় দেয় না। নোটিশ জারির পর কেউ না এলে সেটা রিপোর্টে লেখা হবে। তখন বাদী চাইলে সরাসরি কোর্টে মামলা করবেন। তবে বাস্তবে দেখা গেছে—৯৫% বিবাদী নোটিশ পেয়ে হাজির হন, কারণ তারা জানেন, একজন বিচারকের নেতৃত্বে বিষয়টি দ্রুত ও নিরপেক্ষভাবে মীমাংসা হতে পারে।

৩. আপোষের সময়সীমা কত?

লিগ্যাল এইডে “হবে হবে” বলে সময়ক্ষেপণ নয়—নিয়ম অনুযায়ী, নোটিশ প্রাপ্তির ৭ দিনের মধ্যে আপোষ চেষ্টার সমাপ্তি। আধুনিক যুগে মোবাইলেই নোটিশ হলে ২৪ ঘণ্টায়ও নিষ্পত্তি সম্ভব।

৪. একই বিষয়ে কোর্টেও মামলা, আবার লিগ্যাল এইডে? litigant-এর ধৈর্য কতটুকু?

সত্যি কথা, বিচারপ্রার্থী মানুষ এখন শান্তিপূর্ণ ও দ্রুত সমাধান চায়। বাটোয়ারা মামলার মতো জটিল বিষয়গুলো আদালতে যেখানে ২০–৩০ বছর চলে, সেখানে লিগ্যাল এইডে ১ বছরের মধ্যেই নিষ্পত্তি সম্ভব। আর যদি মোট ৩০% আবেদনও নিষ্পত্তি হয়, সেটাও বিপ্লবের শুরু।

৫. ভেলুয়েশন বাড়িয়ে মানুষ সরাসরি যুগ্ম কোর্টে যেতে চাইবে না?

সচেতন নাগরিক এবং দায়িত্বশীল আইনজীবীরা জানেন—এই আইন মানুষের উপকারে এসেছে। বাটোয়ারা মামলা এখন সবচেয়ে বেশি হয়রানিমূলক। সেই মামলা যদি ১ বছরে নিষ্পত্তি হয়, তাহলে মানুষ কোর্টে ৩০–৪০ বছরের মামলা চালিয়ে লাভ কী?

৬. লিগ্যাল এইডের সিদ্ধান্ত কি রায়-ডিক্রি হিসেবে গণ্য হবে? দলিল বা খতিয়ান সংশোধন হবে?

২১(গ) ধারা অনুযায়ী, লিগ্যাল এইডের আপোষ নিষ্পত্তি কার্যকর আদেশ হিসেবে গৃহীত হবে। নামজারী, দলিল রেজিস্ট্রেশন বা খতিয়ান সংশোধনের ক্ষেত্রেও এই সিদ্ধান্ত কার্যকর হবে।

৭. ভূমি অফিস বা রেজিস্ট্রি অফিস মানবে তো?

লিগ্যাল এইডের সিদ্ধান্ত তো উভয় পক্ষের সম্মতিতে গৃহীত আপোষ। তাই কোর্টে দাখিল হলে তা রায় হিসেবেই বিবেচিত হবে। আইনগত কোনো ত্রুটি থাকলে সংশোধনের সুযোগও রয়েছে।

৮. ঢাকা-চট্টগ্রামে ২০ জন করে অফিসার লাগবে? বাজেট? অবকাঠামো?

একটি ট্রায়াল আইন হিসেবে এই প্রক্রিয়া শুরু হলেও ভবিষ্যতে প্রতি জেলায় একজন চীফ ও ২ জন সহকারী লিগ্যাল এইড অফিসার দায়িত্বে থাকবেন।
অবসরপ্রাপ্ত বিচারক ও প্রশিক্ষিত মেডিয়েটররা যুক্ত হলে একে এক অসাধারণ সাফল্যে রূপ দেওয়া সম্ভব।

৯. চলমান মামলা কেন লিগ্যাল এইডে যাবে না? বিচারক চাইলে?

চায় সবাই, বাদী-বিবাদী-বিচারক সবাই। কিন্তু কিছু পক্ষ, বিশেষত হেরে যাওয়ার আশঙ্কা থাকা পক্ষ বা কিছু আইনজীবী আদালতের সময় নষ্ট করতে চান। তবে এখনকার সচেতন নাগরিকরা নিজেরাই চান—দ্রুত সমাধান, কম খরচে ন্যায়বিচার।

১০. চেকের মামলা, তামাদি ইস্যু, হয়রানি—এগুলো কীভাবে ঠেকানো যাবে?

আইন বলছে—লিগ্যাল এইড প্রক্রিয়ার সময়টুকু তামাদি গণনায় ধরা হবে না। মানে, কেউ হয়রানির সুযোগ নিতে পারবে না।

১১. আপোষ জোর করে হবে? বাধ্য করবে কে?

না, কখনই না। আপোষ সবসময়ই স্বেচ্ছায় হয়। কেউ আপোষে রাজি না থাকলে লিখিতভাবে জানিয়ে দিবে। তখন আবেদন সরাসরি কোর্টে যাবে—একটুও সময় নষ্ট হবে না।

শেষকথা

১৯৫০ সালের State Acquisition and Tenancy Act এর ট্রাইব্যুনাল চালু হতে লেগেছিল ৬০ বছর। এই আইন যদি ১ বছর সময় নিয়ে, অবকাঠামো গড়ে তুলে, দক্ষ বিচারক ও মেডিয়েটর দিয়ে বাস্তবায়ন হয়— তাহলে বাংলাদেশের ন্যায়বিচার ব্যবস্থায় নীরব বিপ্লব ঘটবে।

লেখক : মো. জুনাইদ; সাবেক লিগ্যাল এইড অফিসার, রাঙ্গামাটি পার্বত্য জেলা।