অধস্তন আদালত উপজেলা পর্যায়ে সম্প্রসারণে রাজনৈতিক ঐকমত্য
জাতীয় ঐকমত্য কমিশনের আলোচনা

অধস্তন আদালত উপজেলা পর্যায়ে সম্প্রসারণে রাজনৈতিক ঐকমত্য

অধস্তন আদালত উপজেলা পর্যায়ে ধাপে ধাপে সম্প্রসারণের বিষয়ে রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে নীতিগত ঐকমত্য হয়েছে। তবে অবকাঠামো, কারাগার, যোগাযোগসহ ছয়টি বিষয়ের বাস্তবতা বিবেচনায় নিয়ে এ সিদ্ধান্ত কার্যকর করার আহ্বান জানিয়েছেন অংশগ্রহণকারী নেতারা।

গতকাল সোমবার রাজধানীর ফরেন সার্ভিস একাডেমিতে অনুষ্ঠিত দিনব্যাপী আলোচনায় এ সিদ্ধান্তে পৌঁছায় জাতীয় ঐকমত্য কমিশন। আলোচনায় ৩০টি রাজনৈতিক দল অংশ নেয়।

বিচার বিভাগ সংস্কার কমিশনের সুপারিশ অনুযায়ী উপজেলা পর্যায়ে আদালত সম্প্রসারণের প্রস্তাব নিয়ে আলোচনা হয়। এর আগে বিভাগীয় শহরে হাইকোর্ট বেঞ্চ স্থাপনের বিষয়ে ইতোমধ্যে ঐকমত্য হয়েছে।

আলোচনায় বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য সালাহউদ্দিন আহমদ বলেন, দ্বীপ বা দুর্গম এলাকার ক্ষেত্রে বিচারসেবা পৌঁছাতে কিছু উপজেলায় আদালত স্থাপন জরুরি হলেও অবকাঠামোর অভাব একটি বড় চ্যালেঞ্জ।

তিনি জানান, কোনো কোনো জায়গায় কারাগার বা ন্যূনতম সুযোগ-সুবিধা না থাকায় স্থায়ীভাবে আদালত বসানো বাস্তবসম্মত নয়।

জাতীয় নাগরিক পার্টির (এনসিপি) যুগ্ম আহ্বায়ক জাবেদ রাসিন প্রস্তাব করেন, প্রতিটি উপজেলায় না হলেও সংসদীয় আসনভিত্তিকভাবে আদালত সম্প্রসারণ করা যেতে পারে। এতে আদালতের বিকেন্দ্রীকরণ বাস্তবসম্মতভাবে সম্ভব হবে।

গণসংহতি আন্দোলনের প্রধান সমন্বয়কারী জোনায়েদ সাকি বলেন, মামলা বাড়ার শঙ্কার চেয়ে বিচারসেবা মানুষের দোরগোড়ায় পৌঁছে দেওয়ার দিকটি বেশি গুরুত্ব পাওয়ার কথা। তাই উপজেলা আদালতের বিষয়টি শুধু সংখ্যায় বিচার না করে নাগরিক অধিকার নিশ্চিতের অংশ হিসেবে দেখতে হবে।

জামায়াতের সহকারী সেক্রেটারি জেনারেল হামিদুর রহমান আজাদ প্রশ্ন তোলেন, দুর্নীতির ভয়ে বিচার সেবা কেন পিছিয়ে থাকবে?

তিনি বলেন, দুর্নীতি যেখানেই হোক, উপজেলা আদালত এর সমাধান নয়, তবে মানুষের ন্যায্য সেবা পাওয়ার অধিকার প্রতিষ্ঠায় এটি একটি কার্যকর উদ্যোগ হতে পারে।

আলোচনার শেষে সাংবাদিকদের ব্রিফিংয়ে ঐকমত্য কমিশনের সহসভাপতি আলী রীয়াজ জানান, দলগুলো উপজেলা পর্যায়ে অধস্তন আদালত সম্প্রসারণের ব্যাপারে একমত। তবে এ ক্ষেত্রে কিছু পূর্বশর্ত এবং কাঠামোগত প্রস্তুতি বিবেচনায় নিতে হবে।

আলী রীয়াজ জানান, ছয়টি বিষয় বিবেচনায় নেওয়ার কথা বলা হয়েছে।

সেগুলো হলো—

১. জেলা সদরে অবস্থিত সদর উপজেলা আদালত জেলা জজকোর্টের সঙ্গে সংযুক্ত করা।

২. বিদ্যমান চৌকি আদালত ও উপজেলা আদালত প্রয়োজনীয় সংস্কার ও অবকাঠামো নির্মাণ করা।

৩. জেলা সদরের কাছাকাছি উপজেলায় নতুন আদালত স্থাপন না করা ও প্রয়োজনীয় জরিপ পরিচালনা করা।

৪. অবশিষ্ট উপজেলায় জনসংখ্যার ঘনত্ব, ভৌগোলিক অবস্থান ও বৈশিষ্ট্য, যাতায়াতব্যবস্থা, দূরত্ব, অর্থনৈতিক অবস্থা ও মামলার সংখ্যা বিবেচনায় পর্যায়ক্রমে আদালত স্থাপন করা।

৫. অধস্তন আদালতের জন্য প্রয়োজনীয় অবকাঠামো ও অর্থ বরাদ্দ নিশ্চিত করা।

৬. আইনগত সহায়তা কার্যক্রম উপজেলা পর্যায় পর্যন্ত সম্প্রসারণ করা।

সুপ্রিম কোর্ট প্রশাসনের তথ্য অনুযায়ী, বর্তমানে দেশের ২৩টি জেলার ৪৩টি উপজেলায় ৭১টি চৌকি আদালত কার্যক্রম পরিচালনা করছে।

প্রসঙ্গত, এর আগে গত বৃহস্পতিবার বিভাগীয় পর্যায়ে হাইকোর্টের স্থায়ী বেঞ্চ করার বিষয়ে ঐকমত্য হয়েছিল। গতকালের আলোচনায় বিএনপির সালাহউদ্দিন আহমদ বলেন, আগের দিন তিনি বলেছিলেন, সুপ্রিম কোর্টের সঙ্গে আলোচনা করে হাইকোর্টের বেঞ্চ বিভাগীয় পর্যায়ে স্থানান্তর করতে হবে। কিন্তু সাংবাদিকদের সামনে সিদ্ধান্ত ঘোষণার সময় এটি উল্লেখ করা হয়নি।

গতকালের আলোচনা শেষে আলী রীয়াজ সাংবাদিকদের বলেন, বিভাগীয় পর্যায়ে হাইকোর্টে বিকেন্দ্রীকরণের বিষয়ে সিদ্ধান্ত হয়েছিল যে এ বিষয়ে একই সঙ্গে সুপ্রিম কোর্টের সঙ্গে আলোচনা করা হবে।

জরুরি অবস্থা জারির বিধান নিয়ে নতুন প্রস্তাব

একই আলোচনায় রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে জরুরি অবস্থা জারির বিদ্যমান বিধান পরিবর্তনের প্রয়োজনীয়তা নিয়েও ঐকমত্য হয়।

সংবিধানের ১৪১ অনুচ্ছেদ অনুযায়ী, রাষ্ট্রপতি সর্বোচ্চ ১২০ দিনের জন্য জরুরি অবস্থা ঘোষণা করতে পারেন। এ ঘোষণার জন্য প্রধানমন্ত্রীর প্রতিস্বাক্ষর প্রয়োজন হয়।

ঐকমত্য কমিশনের নতুন প্রস্তাবে বলা হয়েছে, রাষ্ট্রপতি সর্বোচ্চ ৯০ দিনের জন্য জরুরি অবস্থা জারি করতে পারবেন এবং তা মন্ত্রিসভার লিখিত অনুমোদন সাপেক্ষে হতে হবে।

নতুন প্রস্তাবনায় বলা হয়, জরুরি অবস্থার সময়েও কিছু মৌলিক অধিকার সীমাবদ্ধ করা যাবে না। ধর্ম, বিবেক, চিন্তা ও জীবন রক্ষার অধিকার অব্যাহত থাকবে।

এছাড়া, কোনো ব্যক্তিকে অন্যায়ভাবে গ্রেফতার বা নির্যাতন করা যাবে না, কিংবা অতিরিক্ত শাস্তি দেওয়া যাবে না।

এনসিপির জাবেদ রাসিন প্রস্তাব করেন, জরুরি অবস্থা তিনটি পর্যায়ে ভাগ করা হোক। যুদ্ধকালীন পরিস্থিতিতে রাষ্ট্রপতি সংসদের অনুমোদন নিয়ে জারি করতে পারবেন। মহামারি বা প্রাকৃতিক দুর্যোগে মন্ত্রিসভার সিদ্ধান্ত যথেষ্ট হবে। আর অভ্যন্তরীণ গোলযোগে মৌলিক অধিকার স্থগিত করা যাবে না।

বিএনপির সালাহউদ্দিন আহমদ বলেন, আলোচনার মাধ্যমে এই প্রস্তাবগুলো সংসদে উপস্থাপন করা যেতে পারে। তবে প্রতিবারই বলা হচ্ছে পরবর্তী সংসদে যাবে, বাস্তবায়নের রূপরেখা কোথায়, তা পরিষ্কার নয়।

আলোচনার এক পর্যায়ে এনসিপির জাবেদ রাসিন বলেন, বারবার যদি বলা হয় পরবর্তী সংসদে হবে, তবে এখন আলোচনা বন্ধ করে দেওয়া উচিত। একইভাবে সালাহউদ্দিন বলেন, দিনে দিনে দীর্ঘ আলোচনায় কমিশনের উদ্দেশ্য নিয়েই সন্দেহ তৈরি হচ্ছে।

আলোচনা শেষে আলী রীয়াজ বলেন, জরুরি অবস্থার বিধান যাতে রাজনৈতিক উদ্দেশ্যে ব্যবহৃত না হয়, সে বিষয়ে সকল দল একমত। সংবিধানের ১৪১ অনুচ্ছেদের সংশোধন, সংযোজন ও পরিমার্জন নিয়েও ঐকমত্য গঠিত হয়েছে।

আগামী বৃহস্পতিবারের আলোচনায় এই প্রস্তাবগুলোর ভিত্তিতে চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত আসবে বলে তিনি আশাবাদ ব্যক্ত করেন।

আলোচনায় আরও উপস্থিত ছিলেন কমিশনের সদস্য বদিউল আলম মজুমদার, সফর রাজ হোসেন, ইফতেখারুজ্জামান, মো. আইয়ুব মিয়া এবং প্রধান উপদেষ্টার বিশেষ সহকারী মনির হায়দার।