মো. রায়হানুল ওয়াজেদ চৌধুরী
মো. রায়হানুল ওয়াজেদ চৌধুরী

ব্যারিস্টার সৈয়দ ইশতিয়াক আহমেদ: আইন ও বিচারাঙ্গনের এক আলোকবর্তিকা

মো. রায়হানুল ওয়াজেদ চৌধুরী : বাংলাদেশের আইন ও বিচার ব্যবস্থার ইতিহাসে ব্যারিস্টার সৈয়দ ইশতিয়াক আহমেদ একটি উজ্জ্বল অধ্যায়। তিনি শুধু একজন খ্যাতনামা আইনজীবীই ছিলেন না, ছিলেন সংবিধান বিশেষজ্ঞ, মানবাধিকারকর্মী এবং গণতন্ত্র ও আইনের শাসনের এক অবিচল অধিকারী। সততা, নিরপেক্ষতা ও পেশাদারিত্বের এক অনন্য দৃষ্টান্ত হয়ে তিনি আজও প্রজন্ম থেকে প্রজন্মে অনুপ্রেরণার উৎস হয়ে আছেন।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে অর্থনীতিতে স্নাতক সম্পন্ন করে তিনি যুক্তরাজ্যের লন্ডনের লিঙ্কনস ইন থেকে ব্যারিস্টার-অ্যাট-ল ডিগ্রি এবং লন্ডন স্কুল অব ইকোনমিকস থেকে দ্বিতীয় মাস্টার্স ডিগ্রি অর্জন করেন।

আইন পেশায় যুক্ত হয়ে তিনি স্বল্প সময়েই অসাধারণ প্রতিভার স্বাক্ষর রাখেন। ছাত্রজীবনে তিনি রাজনৈতিক সচেতনতা ও প্রতিবাদী চেতনার জন্য একাধিকবার কারাবরণ করেন। ভাষা আন্দোলন থেকে শুরু করে স্বৈরাচারবিরোধী আন্দোলনে তিনি ছিলেন সক্রিয় অংশগ্রহণকারী।

আইনজীবী হিসেবে তাঁর দক্ষতা, যুক্তির ক্ষমতা ও নৈতিক অবস্থান তাঁকে বিচারপতি, সহকর্মী এবং জনগণের শ্রদ্ধা অর্জনে সক্ষম করে তোলে। তিনি ছিলেন বাংলাদেশ সুপ্রিম কোর্টের সিনিয়র আইনজীবী এবং অসংখ্য সাংবিধানিক মামলার মুখ্য আইনজীবী। তাঁর আইনি বিশ্লেষণ প্রায়শই জাতীয় নীতি নির্ধারণে প্রতিফলিত হয়েছে। ‘অ্যামিকাস কিউরি’ হিসেবে আদালতে তাঁর মতামত ছিল আদালতের জন্য বিশেষ গুরুত্বপূর্ণ।

তাঁর সবচেয়ে ঐতিহাসিক অবদান হলো বিচার বিভাগকে নির্বাহী বিভাগ থেকে পৃথক করার আন্দোলনে নেতৃত্বদান। ২০০১ সালের তত্ত্বাবধায়ক সরকারে উপদেষ্টা হিসেবে ‘মাসদার হোসেন মামলায়’ তিনি নিঃস্বার্থ ও নির্ভীকভাবে অংশ নেন, যার রায়ের মাধ্যমে বিচার বিভাগের স্বাধীনতা সাংবিধানিক ভিত্তি পায়।

আরও পড়ুনকিংবদন্তি আইনজীবী ব্যারিস্টার সৈয়দ ইশতিয়াক আহমেদের ২২তম মৃত্যুবার্ষিকী আজ

তিনি ১৯৭২ সালে অতিরিক্ত অ্যাটর্নি জেনারেল, ১৯৭৮ সালে অ্যাটর্নি জেনারেল এবং জাতিসংঘে বাংলাদেশের স্থায়ী প্রতিনিধি হিসেবে গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্ব পালন করেন। দুবার তত্ত্বাবধায়ক সরকারের উপদেষ্টা হিসেবে আইন, বিচার ও অর্থ মন্ত্রণালয়সহ গুরুত্বপূর্ণ দপ্তর পরিচালনা করেন। তাঁর নেতৃত্বে এসব দায়িত্ব পালন ছিল নিরপেক্ষতা, স্বচ্ছতা ও দক্ষতার অনন্য উদাহরণ।

পেশাগত জীবন ছাড়াও তিনি ছিলেন সামাজিক, সাংস্কৃতিক ও নীতি নির্ধারণী নানা কর্মকাণ্ডে সক্রিয়। তিনি ছিলেন BLAST-এর প্রতিষ্ঠাতা চেয়ারম্যান, বাংলা একাডেমি ও CPD’র সঙ্গে যুক্ত এবং BILIA’র দীর্ঘদিনের নেতৃত্বে ছিলেন। দরিদ্র ও প্রান্তিক জনগোষ্ঠীর পক্ষে আইনি সহায়তা প্রদানে তিনি ছিলেন অগ্রণী।

ব্যক্তিগত জীবনেও তিনি ছিলেন একটি উজ্জ্বল পারিবারিক ঐতিহ্যের ধারক। তাঁর স্ত্রী ড. সুফিয়া আহমেদ ছিলেন দেশের প্রথম নারী জাতীয় অধ্যাপক ও ভাষা আন্দোলনের একজন সম্মানিত সংগঠক। তাঁর সন্তানেরাও বিভিন্ন ক্ষেত্রে প্রতিষ্ঠিত, বিশেষ করে পুত্র বিচারপতি সৈয়দ রেফাত আহমেদ দেশের বিচার ব্যবস্থার উচ্চ আসনে আসীন।

২০০৩ সালের ১২ জুলাই ব্যারিস্টার সৈয়দ ইশতিয়াক আহমেদের প্রয়াণে দেশ হারায় একজন সজ্জন, জ্ঞানী ও অসাধারণ মূল্যবোধসম্পন্ন আইনবিদকে। তবে তাঁর আদর্শ, কর্ম ও নৈতিক অবস্থান আজও তরুণ আইনজীবী ও সমাজ চিন্তকদের প্রেরণা যোগায়।

তিনি বিশ্বাস করতেন— “বিচার শুধু আদালতে নয়, মানুষের হৃদয়েও প্রতিফলিত হওয়া উচিত।”

লেখক: মো. রায়হানুল ওয়াজেদ চৌধুরী; আইনজীবী, বাংলাদেশ সুপ্রীম কোর্ট ও চট্টগ্রাম জেলা ও দায়রা জজ আদালত।