মো. জুনাইদ, সিনিয়র সহকারী জজ, সুনামগঞ্জ
মো. জুনাইদ, সিনিয়র সহকারী জজ, সুনামগঞ্জ

আইনগত সহায়তা (সংশোধন) আইন, ২০২৫: বাস্তবায়নের জন্য একটি কৌশলপত্র

মো. জুনাইদ : “বিচার বিভাগ সংস্কারে বিচারপ্রার্থী জনগণের স্বার্থই হতে হবে কেন্দ্রবিন্দু”—এই মৌলনীতিকে সামনে রেখে আইনগত সহায়তা (সংশোধন) আইন, ২০২৫ একটি যুগান্তকারী পদক্ষেপ হিসেবে বিবেচিত হচ্ছে। এটি কেবল একটি আইনি সংস্কার নয়, বরং বিচারপ্রাপ্তির প্রক্রিয়ায় কাঠামোগত পরিবর্তনের সূচনা। এই আইনের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ দিক হলো বাধ্যতামূলক বিকল্প বিরোধ নিষ্পত্তি (ADR) ব্যবস্থা, যা আদালতের বাইরে দ্রুত, মানবিক ও খরচ-সাশ্রয়ীভাবে বিরোধ নিষ্পত্তির একটি সম্ভাবনাময় পথ।
সরকার পর্যায়ক্রমে গেজেট জারি করে আইনটি কার্যকর করবে—এই নির্দেশনার আলোকে, একজন বিচারক, সাবেক লিগ্যাল এইড অফিসার, ADR অভিজ্ঞ ও তৃণমূল পর্যায়ের কাজের বাস্তবতার ভিত্তিতে একটি সুসংগঠিত বাস্তবায়ন কৌশলপত্র নিচে উপস্থাপন করা হলো:

১. ধাপে ধাপে বাস্তবায়ন (Pilot Implementation)

পাইলট জেলা নির্বাচন: পরীক্ষামূলক প্রয়োগের জন্য চট্টগ্রাম, যশোর, ময়মনসিংহ, সিলেট এবং বান্দরবান (যেখানে রাঙ্গামাটি ADR মডেল ইতোমধ্যে কার্যকর) নির্বাচিত করা যেতে পারে।
মূল্যায়ন ও প্রতিবেদন: প্রতি ৩-৬ মাস অন্তর বাস্তবায়ন মূল্যায়ন করে প্রতিবেদন তৈরি করা হবে।
ধাপে ধাপে সম্প্রসারণ: সফল জেলার অভিজ্ঞতা বিশ্লেষণ করে জাতীয় পর্যায়ে কার্যক্রম বিস্তৃত করা হবে।

২. দক্ষ মধ্যস্থতাকারী গঠন ও প্রশিক্ষণ

ADR প্যানেল গঠন: জেলা, উপজেলা ও ইউনিয়ন পর্যায়ে প্রশিক্ষিত, নিরপেক্ষ ও ভিকটিম-সংবেদনশীল মধ্যস্থতাকারীর তালিকা প্রস্তুত।
নারী ও প্রান্তিক জনগোষ্ঠীর বিষয়ক প্রশিক্ষণ: নারী, শিশু, আদিবাসী ও প্রান্তিক জনগোষ্ঠীর সঙ্গে কাজ করতে সক্ষম সংবেদনশীল মিডিয়েটর প্রস্তুতে বিশেষ প্রশিক্ষণ কার্যক্রম।

৩. মামলা শ্রেণিকরণ ও ভিকটিম-সংবেদনশীলতা

সংবেদনশীল মামলা বাদ: নারী ও শিশু নির্যাতন, পারিবারিক সহিংসতা ইত্যাদি ক্ষেত্রে ভিকটিমের সম্মতি ছাড়া বাধ্যতামূলক ADR প্রযোজ্য হবে না।
স্ক্রিনিং সেল গঠন: বিশেষজ্ঞদের নিয়ে গঠিত টিম ADR উপযোগী মামলা নির্বাচন করবে।

৪. সচেতনতা ও জনসম্পৃক্ততা

সেমিনার ও কর্মশালা: আইনজীবী, বিচারক, পুলিশ, সমাজকর্মী ও স্থানীয় নেতৃবৃন্দের অংশগ্রহণে প্রশিক্ষণ আয়োজন।
IEC ক্যাম্পেইন: রেডিও, টিভি, সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ADR সুবিধার প্রচার।
তথ্য উপকরণ: লিফলেট, পোস্টার, অ্যানিমেটেড ভিডিও তৈরি ও বিতরণ।

৫. অবকাঠামো ও প্রযুক্তি ব্যবহার

ADR সেন্টার স্থাপন: প্রতিটি জেলা ও উপজেলা লিগ্যাল এইড অফিসে নির্ধারিত ADR কক্ষ স্থাপন।
মানবসম্পদ ও লজিস্টিক: জনবল ও সরঞ্জাম ৪ গুণ পর্যন্ত বাড়ানো।
ডিজিটাল ব্যবস্থা: অনলাইন আবেদন, মনোনয়ন, শুনানি সময় নির্ধারণ ও রেকর্ড সংরক্ষণ পদ্ধতি চালু।
টোল-ফ্রি হেল্পলাইন: অভিযোগ, পরামর্শ ও তথ্য প্রদানের জন্য হেল্পলাইন চালু।

৬. তদারকি ও জবাবদিহি

ADR মনিটরিং বোর্ড: জেলা লিগ্যাল এইড কমিটির আওতায় পৃথক মনিটরিং ইউনিট গঠন।
অভিযোগ নিষ্পত্তি ব্যবস্থা: পক্ষপাত, দুর্ব্যবহার বা বেআইনি হস্তক্ষেপের অভিযোগের তদন্ত ও প্রতিকার নিশ্চিতকরণ।
সিসিটিভি নজরদারি: শব্দসহ সিসিটিভি স্থাপন ও ফুটেজ সংরক্ষণ (কমপক্ষে ২ বছর)।
উচ্চ পর্যায়ের তদারকি: জেলা ও দায়রা জজ এবং জাতীয় আইনগত সহায়তা সংস্থার সক্রিয় সম্পৃক্ততা।

৭. সময়সীমা ও পরিসংখ্যানভিত্তিক মূল্যায়ন

নিষ্পত্তির সময়সীমা: প্রতিটি ADR প্রক্রিয়া ২১-৩০ দিনের মধ্যে নিষ্পত্তির প্রচেষ্টা।
স্বয়ংক্রিয় মুক্তির বিধান: নির্ধারিত সময়ে নিষ্পত্তি না হলে আদালতে মামলা দায়েরের সুযোগ নিশ্চিতকরণ।
ত্রৈমাসিক প্রতিবেদন: ADR কার্যক্রমের সাফল্য, ব্যর্থতা ও পরিসংখ্যানভিত্তিক বিশ্লেষণ।

৮. বাজেট বরাদ্দ ও উন্নয়ন সহযোগিতা

জাতীয় বাজেট: আইনগত সহায়তার জন্য নির্দিষ্ট ও পর্যাপ্ত বাজেট বরাদ্দ।
আন্তর্জাতিক অংশীদারিত্ব: UNDP, GIZ, IDLO-এর কারিগরি ও আর্থিক সহায়তা গ্রহণ।

৯. পুরস্কার ও অনুপ্রেরণা

সেরা মধ্যস্থতাকারী পুরস্কার: সফল ও দক্ষ ADR পরিচালনাকারীদের সম্মাননা।
সহযোগী আইনজীবীদের স্বীকৃতি: ADR-এ সহায়ক ভূমিকা রাখা আইনজীবীদের আনুষ্ঠানিক স্বীকৃতি প্রদান।

উপসংহার

আইনগত সহায়তা (সংশোধন) আইন, ২০২৫ বাস্তবায়নের মাধ্যমে বিচার বিভাগ আরও মানবিক, জবাবদিহিমূলক ও নাগরিকবান্ধব হয়ে উঠতে পারে। এর ফলে আদালতের মামলা জট হ্রাস পাবে, ন্যায়বিচার আরও দ্রুত ও সহজলভ্য হবে। এই আইনের সাফল্য নির্ভর করবে বাস্তবমুখী পরিকল্পনা, দক্ষ জনবল, প্রযুক্তিনির্ভর ব্যবস্থাপনা এবং সর্বোপরি জনগণের সক্রিয় অংশগ্রহণের ওপর।
লেখক : মো. জুনাইদ; সিনিয়র সহকারী জজ, সুনামগঞ্জ।