কক্সবাজার লিগ্যাল এইড অফিস : এক বছরে অর্থ আদায় ৯২ লাখ, মামলা নিষ্পত্তি ১১৫৪
জেলা লিগ্যাল এইড অফিস, কক্সবাজার

আপোষ-মীমাংসায় কক্সবাজার লিগ্যাল এইড অফিসের রেকর্ড

মুহাম্মদ আবু সিদ্দিক ওসমানী : দেশের অন্যতম অনুকরণীয় আইনগত সহায়তা কেন্দ্র হিসেবে আত্মপ্রকাশ করেছে কক্সবাজার জেলা লিগ্যাল এইড অফিস। ২০২৪ সালে এই অফিসে মামলা নিষ্পত্তির হার দাঁড়িয়েছে ১৩২.৮৫%, যা লিগ্যাল এইড কার্যক্রমের ইতিহাসে এক নতুন রেকর্ড।

কক্সবাজার জেলা লিগ্যাল এইড অফিসার ও সিনিয়র সহকারী জজ সাজ্জাতুন নেছা লিপি জানান, গত বছর এডিআর (Alternative Dispute Resolution) পদ্ধতিতে ১১৮৫টি বিরোধের নিষ্পত্তি করা হয়েছে। এতে ১৭৪৮ জন উপকারভোগী সরাসরি উপকৃত হয়েছেন। এদের মধ্যে ১১৮২ জন নারী, ৫৩৯ জন পুরুষ এবং ২৭ জন শিশু রয়েছেন।

তিনি জানান, শুধুমাত্র আপোষ-মীমাংসার মাধ্যমেই বিভিন্ন খাত থেকে আদায় হয়েছে ১ কোটি ১ লাখ ৮২ হাজার ২০০ টাকা। এই অর্থের মধ্যে মোহরানা, ক্ষতিপূরণ, চিকিৎসা খরচ, জমি সংক্রান্ত অর্থ, বিদেশে পাঠানোর টাকা ফেরত, সন্তান ও স্ত্রীর ভরণপোষণ ইত্যাদি অন্তর্ভুক্ত রয়েছে।

২০২৪ সালে কক্সবাজার লিগ্যাল এইড অফিসে ১৬০৯টি এডিআর আবেদন জমা পড়ে। এর মধ্যে ২০২৩ সালের আবেদন ছিলো ৭১৭টি, আর ২০২৪ সালের নতুন আবেদন ৮৯২টি। এই সংখ্যাটি আগের বছরের তুলনায় উল্লেখযোগ্য হারে বেড়েছে।

সেবা গ্রহণকারীদের সংখ্যা বাড়ছে

২০২৪ সালে লিগ্যাল এইড অফিস থেকে ৪২২০ জনকে বিভিন্নভাবে সহায়তা দেওয়া হয়েছে। এর মধ্যে ৩৭৭ জনকে মামলা সংক্রান্ত আইনি সহায়তা এবং ৩৮৪৩ জনকে বিনামূল্যে আইনি পরামর্শ দেওয়া হয়। পরামর্শপ্রাপ্তদের মধ্যে ২৬৫৭ জন নারী, ১১৫৯ জন পুরুষ ও ২৭ জন তৃতীয় লিঙ্গের মানুষ রয়েছেন।

সচেতনতা কর্মসূচি

কক্সবাজার লিগ্যাল এইড অফিস বছরজুড়ে ১৮টি সচেতনতা কার্যক্রম চালিয়েছে। এর মধ্যে ছিল মাসিক সভা, প্যানেল আইনজীবীদের কর্মশালা, ক্লায়েন্ট ফলোআপ, ইউনিয়ন পর্যায়ের সেমিনার, উখিয়া ও রামুতে মতবিনিময় সভা এবং রেডিও প্রোগ্রাম। এইসব অনুষ্ঠানে ৩৪২ জন নারী ও ৭১৫ জন পুরুষ অংশগ্রহণ করেন

আদালতের জট কমাচ্ছে লিগ্যাল এইড

কক্সবাজার জেলা আইনজীবী সমিতির সাধারণ সম্পাদক অ্যাডভোকেট মোহাম্মদ তাওহীদুল আনোয়ার বলেন, ‘‘যদি এডিআর না হতো, তাহলে এই ১১৮৫টি বিরোধের অর্ধেক আদালতে মামলা হিসেবে রুজু হতো। এতে নিয়মিত আদালতে প্রায় ৬০০ মামলা বাড়তো। এর ফলে মামলা জট আরও ভয়াবহ হতো।’’

জনবান্ধব সেবা কাঠামো

অফিসের নাগরিক সেবার মান বৃদ্ধিতে সিটিজেন চার্টার, মাতৃদুগ্ধ কর্নার, ওয়েটিং চেয়ার, মিডিয়েশন রুম, পরামর্শ বক্স, এলইডি মনিটর-এ সচেতনামূলক ডকুমেন্টারি প্রদর্শন ইত্যাদি ব্যবস্থা করা হয়েছে।

আইনজীবী ও জনগণের প্রশংসা

কক্সবাজার জেলা আইনজীবী সমিতির সভাপতি অ্যাডভোকেট ছৈয়দ আলম বলেন, “লিগ্যাল এইড অফিসের সক্রিয় ভূমিকার ফলে মামলার সংখ্যা কমেছে। জনগণ সহজেই ন্যায্য বিচার পাচ্ছে।”

বর্ষসেরা প্যানেল আইনজীবী অ্যাডভোকেট আবদুর রশিদ বলেন, ‘‘এখন লিগ্যাল এইড অফিস শুধু অস্বচ্ছলদের আইনি সহায়তার জায়গা নয়, বরং ন্যায্য অধিকার নিশ্চিত করার প্রাণকেন্দ্রে পরিণত হয়েছে। তবে অফিসে আরও জনবল নিয়োগ ও অবকাঠামো উন্নয়ন জরুরি।’’

ব্যক্তিগত গল্প

উপকারভোগী আনোয়ারা বেগম ও হামিদ হোসেন দম্পতি বলেন, ‘‘লিগ্যাল এইড অফিস না থাকলে আমাদের সংসার ভেঙে যেত। এখন আমাদের সন্তান বাবা-মাকে একসঙ্গে পাচ্ছে।’’

ভবিষ্যৎ পরিকল্পনা

সরকারের নতুন আইনে ৯টি ধারায় মামলা দায়েরের আগে বাধ্যতামূলকভাবে লিগ্যাল এইড অফিসে আপোষ-মীমাংসার চেষ্টা করতে হবে। ফলে এই অফিসের গুরুত্ব আরও বেড়ে গেছে।

কক্সবাজার জেলা লিগ্যাল এইড কমিটির সভাপতি ও সিনিয়র জেলা ও দায়রা জজ আব্দুল মজিদ এর নির্দেশনায় অফিসটি এখন দেশের অনুকরণীয় মডেল হয়ে উঠেছে।