ফাইজুল ইসলাম : বাংলাদেশের বিচার ও নিরাপত্তা ব্যবস্থা আজ এক গভীর নৈতিক সংকটে উপনীত হয়েছে। আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর কার্যকর ভূমিকা না থাকা, তাদের গ্রহণযোগ্যতা, রাজনৈতিক প্রশ্রয় এবং বিচারহীনতার সংস্কৃতি—এসব কারণেই আমরা আজ বিশ্বজিৎ দাসের মত নিরীহ পথচারী কিংবা ব্যবসায়ী সোহাগের নির্মম হত্যাকাণ্ড দেখতে বাধ্য হচ্ছি। রাষ্ট্র ও সমাজ হিসেবে আমাদের এই প্রশ্নের উত্তর খুঁজতে হবে: নাগরিকের জীবনের নিরাপত্তা নিশ্চিত করার দায়িত্ব যখন রাষ্ট্রের,তখন রাষ্ট্র ব্যর্থ হলে এই ব্যর্থতার দায় কে নেবে?
আইনের দৃষ্টিতে রাষ্ট্রের দায়িত্ব
বাংলাদেশ সংবিধানের ৩১ ও ৩২ অনুচ্ছেদে প্রত্যেক নাগরিকের জীবন, স্বাধীনতা ও আইনের সমান সুরক্ষা নিশ্চিত করার কথা বলা হয়েছে।
৩১ অনুচ্ছেদ: “আইনের আশ্রয় ব্যতীত এবং আইনের দ্বারা প্রতিষ্ঠিত কর্তৃপক্ষ ব্যতিরেকে কোনো ব্যক্তিকে জীবন, স্বাধীনতা, দেহ, খ্যাতি বা সম্পত্তি হইতে বঞ্চিত করা যাইবে না।”
৩২ অনুচ্ছেদ: “কোনো ব্যক্তিকে জীবন বা ব্যক্তিস্বাধীনতা হইতে বঞ্চিত করা যাইবে না, আইনানুযায়ী না হলে।”
অন্যদিকে, বাংলাদেশ পেনাল কোড ১৮৬০ এবং ফৌজদারি কার্যবিধি ১৮৯৮ (CrPC)-তে অপরাধ দমন ও দ্রুত তদন্তের জন্য আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর করণীয় নির্ধারণ করা আছে।
CrPC-এর ধারা ৫৪ অনুসারে, পুলিশ কোনো ব্যক্তি “যে কারণে গ্রেফতারযোগ্য”—তাৎক্ষণিকভাবে গ্রেফতার করতে পারে।
ধারা ১৫৪ ও ১৫৬ অনুসারে, ফৌজদারি অপরাধের ক্ষেত্রে পুলিশ অভিযোগ গ্রহণ করে তদন্ত শুরু করতে বাধ্য। এক্ষেত্রে পুলিশের কালক্ষেপণের প্রশ্নই আসে না।
প্রশ্ন হচ্ছে অপরাধ তো রাজনৈতিক দল করে না অপরাধ করে ব্যক্তি। আইনে অভিযুক্তদের বিচার হবে, রাজনৈতিক দলের তো বিচার হওয়ার প্রশ্নই আসে নাতবে বাস্তবতা হলো, এই আইনের প্রয়োগে বড় ধরনের শৈথিল্য লক্ষ্য করা যায়।
বিশ্বজিৎ হত্যা মামলার পর্যালোচনা: কাগুজে ন্যায়বিচার?
মামলার নাম: State vs. Sumon and others (2013)
ঘটনা: ২০১২ সালের ৯ ডিসেম্বর, পল্টন এলাকায় নিরীহ বিশ্বজিৎ দাসকে ছাত্রলীগের কিছু সদস্য কুপিয়ে হত্যা করে। ঘটনাস্থলের ৫০ গজের মধ্যেই আইনশৃঙ্খলা বাহিনী অবস্থান করছিল কিন্তু তারা হস্তক্ষেপ করেনি।এমনকি ঘটনার পরও তাদের সেখানে উপস্তিতি লক্ষ্য করা যায় নাই।
বিচার: ২০১৩ সালে ৮ জনকে মৃত্যুদণ্ড ও ১৩ জনকে যাবজ্জীবন কারাদণ্ড দেওয়া হয়।
বাস্তবতা: বেশ কয়েকজন পলাতক, অনেকে রাজনৈতিক আশ্রয়ে রক্ষা পাচ্ছেন।প্রকাশ্য হত্যাকাণ্ডের সাথে যুক্ত থেকে তারা মুক্তি পেয়ে ঘুরে বেড়াচ্ছেন।
মূল শিক্ষা
আইন অনুযায়ী বিচার হয়েছে, কিন্তু execution বা প্রয়োগে ব্যর্থতা প্রকট।এতে আমাদের ঔপনিবেশিক আইনের অন্ধ অনুকরণও অনেক বড় একটি কারণ।।রাষ্ট্র নিজের নাগরিকের জীবনের নিরাপত্তায় যে due diligence রাখা উচিত ছিল, তা করা হয়নি—যা International Covenant on Civil and Political Rights (ICCPR), Article 6 ও 9 এর চূড়ান্ত লঙ্ঘন।
সোহাগ হত্যাকাণ্ড: রাষ্ট্রীয় নিশ্চুপতা ও মিডিয়া তৎপরতা
২০২৫ সালের জুলাইয়ে ঢাকায় প্রকাশ্যে ব্যবসায়ী সোহাগকে কুপিয়ে হত্যা করা হয়। ভাইরাল হওয়া ভিডিওতে দেখা যায়, বেশ কয়েকজন ঘাতক একের পর পাথর দিয়ে আঘাত করে যাচ্ছে—কিন্তু আশেপাশে পুলিশ অনুপস্থিত।
ঘটনার ২৪ ঘণ্টা পরেও পুলিশ সুনির্দিষ্ট অভিযান চালাতে পারেনি।
এখানে প্রশ্ন উঠে—
আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর প্রাথমিক সাড়া কেন এত দেরি হলো?
সিসিটিভি ফুটেজ থাকা সত্ত্বেও গ্রেফতার বিলম্ব কেন?
রাষ্ট্র কি সংবিধানের ৩১ ও ৩২ অনুচ্ছেদের অধীনে নাগরিকের জীবন রক্ষা করতে ব্যর্থ হলো?
বিচারহীনতার বাস্তবচিত্র: কিছু গুরুত্বপূর্ণ রায় ও বিশ্লেষণ
১. Rabeya Khatun vs. Government of Bangladesh (2008) মামলায় হাইকোর্ট বলেছিলেন, “If the State fails to protect life & security , it loses its legitimacy to govern.” সোজা অর্থে: রাষ্ট্রের বৈধতা আসে জনগণের সুরক্ষার মাধ্যমে। এটি ব্যর্থ হলে সে দায়িত্ববোধের প্রশ্ন উঠে।এটা একাডেমিক আলোচনা রাষ্ট্রের দায় আসলেই কতটুকু?
২. BLAST vs. Bangladesh (2003) এই মামলায় হাইকোর্টে বলা হয়—রাষ্ট্রকে “preventive protection measures” নিতে হবে—শুধু বিচার নয়, আগেভাগে অপরাধ ঠেকানোও রাষ্ট্রের দায়িত্ব।গুম,খুন ও বর্বরদশার সভ্যতা থেকে আমাদের মানসিকতার পরিবর্তন ছাড়া মূলত আইনের শাসন একটি প্রহসন।
আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর ভূমিকা ও রাজনৈতিক প্রভাব: একটি ন্যায্য প্রশ্ন
রাজনৈতিক দলগুলোর ছত্রছায়ায় অনেক অপরাধীর বিচার বিলম্বিত হয় বা উপেক্ষিত হয়। এক্ষেত্রে “Rule of Law” বা আইনের শাসন নয়, বরং “Rule by Law” তথা শক্তিশালীদের সুবিধার্থে আইনের প্রয়োগ দেখা যায়।এখানেই এই প্রবাদের যবনিকাপাত হয় আইন দুর্বলদের উপর সবলদের শোষণের সবচেয়ে বড় মাধ্যম।এর মূল কারণ আমাদের দেশে ব্যক্তির বিচারের চেয়ে মানুষ রাজনৈতিক সংশ্লিষ্টতার বিচার করে ফেলে,বিচারের আগেই কাউকে অভিযুক্তর বদলে অপরাধী বলা এটা আমাদের একটি করুণ বাস্তবতা।
বিচারহীনতার সংস্কৃতি:
১.ভুক্তভোগীরা অভিযোগ করতে গেলে থানায় হয়রানি হয়
২.মামলার তদন্তে রাজনৈতিক প্রভাব পড়ে
৩.দ্রুত বিচার প্রক্রিয়া দীর্ঘসূত্রতায় পরিণত হয়
এমন পরিস্থিতি সংবিধানের ২৭ ও ৩১ অনুচ্ছেদের সরাসরি লঙ্ঘন।
আমাদের করণীয়: আইনি সংস্কার ও নাগরিক সচেতনতা
১. পুলিশ জবাবদিহিতা কমিশন গঠন:
একটি স্বাধীন Complaints Commission গঠন করে পুলিশি ব্যর্থতার বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতে হবে।পার্শ্ববর্তী দেশ ভারতে পুলিশের ভূমিকা নিয়ে খুব সোচ্চার।প্রমুখ উন্নত দেশ যেমন যুক্তরাজ্য,কানাডায়,অস্ট্রেলিয়া ও হংকং এর মডেল অনুসরণ করা যেতে পারে।
২. Fast-track Tribunal:
বিশেষভাবে আলোচিত হত্যাকাণ্ডের জন্য দ্রুত বিচার ট্রাইব্যুনাল গঠন করা জরুরি, যাতে দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি হয়।অপরাধী যেন কোনভাবেই আইনের বেড়াজাল হতে মুক্ত হতে না পারে।Retributive form of Justice in modern jurisprudence তত্ব অনুসরণ করে রাষ্ট্রকে অনেক সময় অপরাধ দমনে বেশ কঠোর হতে হবে।
৩. Witness Protection Act প্রণয়ন:
হত্যা মামলায় সাক্ষীরা নিরাপত্তাহীনতায় ভোগেন। আলাদা সাক্ষী সুরক্ষা আইন ছাড়া ন্যায়বিচার অসম্ভব।যেমন একটা ঘটনা তুলে ধরা যাক ফরিদপুরের বোয়ালমারী উপজেলার পরমেশ্বরদী ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান ও আওয়ামী লীগ নেতা মান্নান মাতুব্বরের বাড়িতে হামলা, লুটপাট এবং অগ্নিসংযোগের ঘটনায় মামলা হয়েছে বিগত সরকারের সময়। এ সময় ধারালো অস্ত্র দিয়ে কুপিয়ে চেয়ারম্যানের ছেলে মাসুদ মাতুব্বর (৩৫), চেয়ারম্যানের ভাতিজা শাকিল মাতুব্বরকে (২৬) আহত করা হয়।
এলাকাবাসী সূত্রে জানা গেছে, মানবতাবিরোধী অপরাধের দায়ে সালথা উপজেলার যদুনন্দী ইউনিয়নের বারখাদিয়া গ্রামের বাসিন্দা আবুল কালাম আজাদ ওরফে বাচ্চু রাজাকারের মৃত্যুদণ্ড দেওয়া হয়। যদিও রায়ের পর থেকে আবুল কালাম আজাদ পলাতক রয়েছেন। এই মামলার সাক্ষী ছিলেন চেয়ারম্যান মান্নান মাতুব্বর। তার সাক্ষ্যের ভিত্তিতে বাচ্চু রাজাকারের ফাঁসির রায় হয় বলে ধারণা করেন আবুল কালামের অনুসারীরা।
অনলাইন গণমাধ্যম বাংলা ট্রিবিউন এর বরাতে একটু জ্বলজ্বলে উদাহরণ তুলে ধরলাম। আমাদের মামলার সাক্ষীদর নিরাপত্তা দেয়া সরকারের আইনি দায়িত্ব বলে আমি মনে করি।
৪. আইনজীবী ও নাগরিকদের সম্মিলিত সচেতনতা
নাগরিক সমাজ, বিশ্ববিদ্যালয়, আইনজীবী ও মিডিয়াকে সম্মিলিতভাবে ন্যায়বিচারের সংস্কৃতি গড়ে তুলতে হবে।গবেষকদের প্রণোদনা দিয়ে সরকার খুব দ্রুত এর একটা ফলাফল বের করে জনগণের মাঝে শান্তি শৃংখলার প্রসার ঘটাতে পারে।
ন্যায়বিচারের পথে রাষ্ট্রকে ফিরিয়ে আনুন
বিশ্বজিৎ বা সোহাগ—তাঁদের মৃত্যু যেন শুধুই ব্যক্তিগত ট্র্যাজেডি না হয়, বরং তা হোক জাতির বিবেক জাগরণের কারণ।রাষ্ট্রের দায়িত্ব শুধু অপরাধ পরবর্তী বিচার নয়, বরং অপরাধ প্রতিরোধ করা।এজন্য রাষ্ট্রকে সুশাসন, জবাবদিহিতা, এবং আইন প্রয়োগে নিরপেক্ষতা নিশ্চিত করতে হবে—আমরা হয়তো ভবিষ্যতে আর একটি বিশ্বজিৎ বা সোহাগ হত্যার সাক্ষী হব না।
লেখক : ফাইজুল ইসলাম; প্রভাষক, আইন বিভাগ, প্রাইম বিশ্ববিদ্যালয় এবং এম ফিল গবেষক, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়।