তথ্য গোপন করে বৈধ বিয়ে—ধর্মীয়, আইনগত ও আন্তর্জাতিক প্রেক্ষাপটে স্বামীর প্রতিকার
আল মুস্তাসিম নবী নিকু

দেনমোহর আদায়ে সময়সীমা: তালাকের পরও কি নারীর দাবি থেকে থাকে?

আল মুস্তাসিম নবী নিকু : বাংলাদেশে মুসলিম নারীদের অধিকারের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্নগুলোর একটি হলো দেনমোহর। অনেক সময় দেখা যায়, স্বামী ও স্ত্রীর মধ্যে বিবাহবিচ্ছেদ (তালাক) হওয়ার বহু বছর পর স্ত্রী দেনমোহর দাবি করতে চাইছেন, কিন্তু তখন অনেকেই প্রশ্ন তোলেন: “এতদিন পর আর কি দেনমোহর চাওয়া যায়?”

এমনকি অনেক নারী নিজেরাও ধরে নেন যে এখন আর আইনিভাবে কিছু করার সুযোগ নেই। এই লেখা সেই প্রশ্নেরই উত্তর দেয় — আইন অনুযায়ী ডিভোর্সের ৩ বছর পরও দেনমোহর চাওয়া যাবে কিনা, এবং যদি না যায়, তবে কোন পরিস্থিতিতে যাবে।

দেনমোহর কী এবং এর ধরণ

স্ত্রীর প্রতি স্বামীর আর্থিক দায়িত্ব ও সম্মানসূচক একটি পরিমাণ অর্থ, যা বিয়ের সময়ই নির্ধারিত হয় তাকেই দেনমোহর বলা হয়। এটি ইসলামিক শরীয়ত ও বাংলাদেশে মুসলিম পারিবারিক আইনে স্বীকৃত একটি অধিকার।

দেনমোহর দুই প্রকার হয়ে থাকে

১. তাৎক্ষণিক দেনমোহর (Prompt Dower): এটি সেই অংশ যা স্ত্রী যেকোনো সময় চাইলে দাবি করতে পারেন। এটি বিয়ের পরপরই বা স্ত্রী চাইলে সঙ্গে সঙ্গেই পরিশোধ করতে হয়। স্বামী যদি এটি দিতে অস্বীকার করেন, তবে সেই অস্বীকারের তারিখ থেকে তিন বছরের মধ্যে মামলা করতে হবে।

২. বিলম্বিত দেনমোহর (Deferred Dower) : এটি সেই অংশ যা সাধারণত তালাক বা স্বামীর মৃত্যুর পর পরিশোধযোগ্য হয়। অর্থাৎ, তালাক বা মৃত্যু ঘটার পর স্ত্রী এই দেনমোহর দাবি করতে পারেন।

Limitation Act অনুযায়ী সময়সীমা

বাংলাদেশের দেওয়ানি কার্যবিধি ও Limitation Act, 1908 অনুযায়ী দেনমোহর দাবি করার ক্ষেত্রেও নির্দিষ্ট সময়সীমা রয়েছে। এর মূল উদ্দেশ্য হলো — ন্যায্য দাবি থাকলেও তা অনির্দিষ্ট কালের জন্য ঝুলিয়ে না রাখা।

➤ তাৎক্ষণিক দেনমোহরের ক্ষেত্রে: স্বামী যখনই পরিশোধে অস্বীকৃতি জানাবেন, সেই তারিখ থেকে তিন (৩) বছরের মধ্যে মামলা করতে হবে।

➤ বিলম্বিত দেনমোহরের ক্ষেত্রে: তালাকের দিন বা স্বামীর মৃত্যুর দিন থেকেই তিন বছরের মধ্যে মামলা দায়ের করতে হবে। তিন বছরের বেশি delay হলে, মামলাটি সাধারণত তামাদি (time-barred) হিসেবে খারিজ হয়ে যেতে পারে।

তাহলে তালাকের ৩ বছর পর মামলা করলে কী হবে?

যদি স্ত্রী তালাকের ৩ বছরের বেশি সময় পর দেনমোহর আদায়ের জন্য মামলা করেন এবং এটি বিলম্বিত দেনমোহরের দাবি হয়, তাহলে আদালত সাধারণত সেই মামলা গ্রহণ করবে না।

কারণ এটি আইন অনুযায়ী সময়সীমা অতিক্রম করেছে বলে ধরা হয়। কিন্তু এখানেই বিষয়টি শেষ নয় — আইন সবসময়ই নমনীয়তা ও বিচারবোধের জায়গা রাখে। কিছু ব্যতিক্রম রয়েছে যেখানে স্ত্রীদের তবুও দাবি করতে পারেন।

ব্যতিক্রম বা বিশেষ পরিস্থিতি

১. নতুন করে অস্বীকৃতি (Fresh Cause of Action): যদি তালাকের কয়েক বছর পর স্বামী নতুন করে দেনমোহর দিতে অস্বীকার করেন, এবং সেই অস্বীকৃতির ঘটনা প্রমাণ করা যায়, তাহলে সময়সীমা নতুন করে সেই তারিখ থেকে শুরু হতে পারে। একে বলা হয় fresh cause of action।

২. ন্যায়বিচারের স্বার্থে বিলম্ব মাফ চাওয়া (Condonation of Delay): আদালত কিছু কিছু ক্ষেত্রে সময়সীমার বিলম্ব মাফ করতে পারে যদি প্রমাণ হয়—

  • স্ত্রী অসুস্থ ছিলেন

  • অর্থনৈতিকভাবে অক্ষম ছিলেন

  • স্বামী প্রতারণা করে দেনমোহরের বিষয়টি এড়িয়ে গেছেন

  • আইনগত জ্ঞানের অভাবে যথাসময়ে মামলা করতে পারেননি

এই পরিস্থিতিতে স্ত্রীকে অবশ্যই “Delay Condonation Petition” দাখিল করতে হয় এবং যথাযথ কারণ ব্যাখ্যা করতে হয়।

মামলার দৃষ্টান্ত

বাংলাদেশে বিভিন্ন দেওয়ানি মামলায় দেখা গেছে, তালাকের বহু বছর পরও স্ত্রী দেনমোহর দাবি করেছেন, কিন্তু আদালত সময়সীমা পার হয়ে গেছে এই যুক্তিতে মামলা খারিজ করে দিয়েছেন।

তবে এমন রায়ও আছে যেখানে স্বামী নতুন করে অস্বীকার করায় আদালত দাবি গ্রহণ করেছেন। এখানে মূল বিষয় হয়ে দাঁড়ায় — “Cause of Action” কবে সৃষ্টি হয়েছে?

উপসংহার

ডিভোর্সের ৩ বছর পরও দেনমোহর দাবি করা সম্ভব কিনা — এর উত্তর নির্ভর করে মূলত তিনটি বিষয়ের ওপর:

  • দেনমোহরটি তাৎক্ষণিক না বিলম্বিত?

  • স্বামী কবে অস্বীকার করেছেন তা দিতে?

  • দাবি করার বিলম্বের পেছনে যৌক্তিক কারণ আছে কিনা?

আইনের চোখে “সময়” অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। সময়মতো পদক্ষেপ না নিলে, ন্যায্য দাবি থেকেও বঞ্চিত হতে পারেন।

বিশেষ দ্রষ্টব্য : এই লেখাটি কেবল মুসলিম নারীদের ক্ষেত্রে প্রযোজ্য। হিন্দু, খ্রিস্টান বা অন্যান্য ধর্মাবলম্বীদের ক্ষেত্রে ভিন্ন আইন প্রযোজ্য হয়।

লেখক : আল মুস্তাসিম নবী নিকু; অ্যাডভোকেট, ঢাকা ও পাবনা জজ কোর্ট । ই-মেইল: almustashimnobi.niku@gmail.com