সাঈদ শুভ : সাবেক প্রধান বিচারপতি এ বি এম খায়রুল হককে একটি হত্যা মামলায় গ্রেপ্তার দেখানোর বিষয়ে কিছু গুরুতর আইনী প্রশ্ন উঠেছে। গণমাধ্যম মারফত জানতে পারলাম যাত্রাবাড়ীতে যুবদল নেতা হত্যা মামলায় তাকে গ্রেপ্তার দেখানো হয়েছে।
এখন প্রশ্ন হলো, সাবেক প্রধান বিচারপতি এ বি এম খায়রুল হক কি যাত্রাবাড়ীতে যুবদল নেতা হত্যাকাণ্ডে কোনোভাবে সম্পৃক্ত? আইন বিশেষজ্ঞ অনেকের মতে সাবেক এই প্রধান বিচারপতিকে হত্যা মামলায় গ্রেপ্তার দেখানোর ঘটনা অনেকগুলো প্রশ্নের জন্ম দিয়েছে। এটাকে ন্যায়বিচার প্রশ্নবিদ্ধ করার প্রক্রিয়া হিসেবেও চিত্রায়িত করছেন তারা।
অনেকের মতে এভাবে খামখেয়ালিপনা করে ন্যায়বিচারকে পদদলিত করা হয়! অথবা কাউকে বাঁচানোর জন্য এগুলো করা হয়। সন্দেহ নাই সাবেক এই প্রধান বিচারপতির লেখা একটা রায়ে বাংলাদেশ এক গভীর সংকটে পতিত হয়েছিলো। যদিও এই রায়ে একমত ছিলেন তিনিসহ আরো ৩ জন বিচারপতি। (এই লেখার শেষের দিকে এ বিষয়ে বিশদ বর্ণনা আছে)
সাধারণ মানুষ বিচারপতি এ বি এম খায়রুল হকের লেখা তত্ত্বাবধায়ক সরকার পদ্ধতি বাতিলের রায়ের বিষয়টাই শুধু জানেন। তবে আইন আদালত সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিবর্গ তার বিতর্কিত আরো অনেক রায়ের কথা জানেন।
তিনি একটা মামলায় হাইকোর্ট বিভাগে রায় দিয়ে এসে সেটা আপীল বিভাগেও নিজের দেয়া রায়ের আপীল নিজেই শুনেছেন। একটা বিশেষ ক্যাডারের কর্মকর্তাদের খুশি করতে আইন ও সংবিধানের ২৭ অনুচ্ছেদের তোয়াক্কা না করে সম্পূর্ণ maliciously একটা রায় দিয়েছেন আইন বিশেষজ্ঞ অনেকেরই অভিমত। যে রায়ের ফলের রাষ্ট্রের সিভিল সার্ভিস এক দীর্ঘ সংকটে পতিত হয়েছে। যার ফলাফল এখনও এই রাষ্ট্রকে বয়ে বেড়াতে হচ্ছে।
এমন অনেক বিতর্কিত রায়ের নজির তিনি স্থাপন করেছেন। এখন প্রশ্ন হলো তার এসমস্ত অপরাধের প্রেক্ষিতে তাকে হত্যা মামলার আসামী করা যাবে? এই হত্যা মামলায় ন্যায়বিচার নিশ্চিত করা হলে তার সম্পৃক্ততা প্রমাণ করা যাবে?
কেউ যত বড় অপরাধই হোক না কেনো আমি তার ন্যায়বিচার চাই। আইনের একজন ছাত্র হিসেবে আমি সবসময়ই ন্যায়বিচারের সমর্থক; প্রতিহিংসা বা জিঘাংসা চরিতার্থের সমর্থক নই। তাহলে এবার পরের প্রশ্নে আসা যাক।
আরও পড়ুন : সাবেক প্রধান বিচারপতি খায়রুল হক কারাগারে
তিনি এত অপরাধ করেও কি দায়মুক্ত থেকে যাবেন? এই প্রশ্নের সরল উত্তর হলো অবশ্যই না। তাহলে সাবেক এই প্রধান বিচারপতির কর্মকাণ্ড কোন আইনের অধীনে অপরাধ? সরল উত্তর হলো উনার বিরুদ্ধে গুরুতর ২ টা অভিযোগের একটা পেনাল কোডের ২১৯ ধারার এবং অপরটা ৪৬৬ ধারার সুস্পষ্ট অপরাধ।
এবার আসুন প্রথমে দেখে নেয়া যাক পেনাল কোডের ২১৯ ধারায় কি আছে। এখানে বলা হয়েছে,
Whoever, being a public servant, corruptly or maliciously makes or pronounces in any stage of a Judicial proceeding, any report, order, verdict, or decision which he knows to be contrary to law, shall be punished with imprisonment of either description for a term which may extend to seven years, or with fine, or with both.
অর্থাৎ একজন পাবলিক সার্ভেন্ট কর্তৃক বিচারিক কার্যক্রমের যেকোনো পর্যায়ে দুর্নীতি ও অনিয়মের আশ্রয় নিয়ে আইন বিরুদ্ধ কোনো রায় বা সিদ্ধান্ত দিলে তবে তিনি ৭ বছর পর্যন্ত কারাদণ্ড অথবা অর্থদণ্ড অথবা উভয় দণ্ডে দণ্ডিত হতে পারেন। তবে এই ধারার অপরাধ জামিনযোগ্য।
এখন অনেকে হয়তো প্রশ্ন তুলবেন একজন প্রধান বিচারপতি কি পাবলিক সার্ভেন্ট? তাহলে আসুন পেনাল কোডের ২১ ধারায় পাবলিক সার্ভেন্ট এর সংজ্ঞা দেখে নেয়া যাক। এখানে বলা হয়েছে, “Every Judge including any person empowered by any law to perform, whether by himself or as a member of any body of persons, any adjudicatory function.” এখানে পরিষ্কার করে বলা হয়েছে প্রত্যেক বিচারকই পাবলিক সার্ভেন্ট।
এছাড়াও তার বিরুদ্ধে আরেকটা গুরুতর অভিযোগ হলো তিনি তত্ত্বাবধায়ক সরকার বাতিলের রায়ের সংক্ষিপ্ত আদেশ পরবর্তীতে আংশিক জালিয়াতির আশ্রয় নিয়েছিলেন যা পেনাল কোডের ৪৬৬ ধারার অপরাধ।
পেনাল কোডের ৪৬৬ ধারায় বলা হয়েছে,
Whoever forges a document, purporting to be a record or proceeding of or in a Court of Justice, or a register of birth, baptism, marriage or burial, or a register kept by a public servant as such, or a certificate or document purporting to be made by a public servant in his official capacity, or an authority to institute or defend a suit, or to take any proceedings therein, or to confess judgment, or a power of attorney, shall be punished with imprisonment of either description for a term which may extend to seven years, and shall also be liable to fine.
অর্থাৎ কেউ আদালতের রায় জালিয়াতি করলে তার শাস্তি সাত বছরের কারাদণ্ড এবং একইসাথে অর্থদন্ডেরও বিধান আছে। ৪৬৬ ধারার অপরাধ জামিন অযোগ্য।
আরও পড়ুন : কাউকে গ্রেপ্তার করলে ১২ ঘণ্টার মধ্যে পরিবারকে জানাতে হবে
তাহলে এটা পরিষ্কার যে, সাবেক প্রধান বিচারপতির বিরুদ্ধে যে অভিযোগ উত্থাপিত হয়েছে তা মূলত পেনাল কোডের ২১৯ ও ৪৬৬ ধারার অপরাধ। তার বিচারিক জীবনে এরকম বিতর্কিত প্রত্যেকটা রায়ের বিরুদ্ধে ২১৯ ধারার অভিযোগ আনয়ন করা যাবে।
এখন আরেকটা প্রশ্ন হলো, সুস্পষ্ট ধারার অভিযোগ স্বত্ত্বেও কেনো তার বিরুদ্ধে যেনোতেনোভাবে একটা হত্যা মামলায় গ্রেপ্তার দেখানো হলো? এটা কি তাকে বাঁচানোর চেষ্টার অংশ হিসেবে করা হলো?
আমার দৃঢ় বিশ্বাস ন্যায়বিচারের সর্বোচ্চ স্ট্যান্ডার্ড বজায় রেখে বিচারিক প্রক্রিয়া এগিয়ে নিলে তার বিরুদ্ধে ২১৯ ও ৪৬৬ ধারার অপরাধ প্রমানিত হবে এবং একাধিক অভিযোগ প্রমাণিত হবে। তারপরেও আমার জোড়ালো চাওয়া হলো তিনি যেনো কোনো অবস্থাতেই ন্যায়বিচার বঞ্চিত না হন।
এগুলো তো গেলো তত্ত্বাবধায়ক সরকার বাতিলের রায় নিয়ে সাবেক প্রধান বিচারপতি এ বি এম খায়রুল হকের দায়-দায়িত্বের বিষয়। এবার আরেকটি প্রশ্ন উত্থাপন করি। তত্ত্বাবধায়ক সরকার বাতিলের মামলায় সাত জন বিচারপতির মধ্যে সংখ্যাগরিষ্ঠ চার জন বিচারপতি তত্ত্বাবধায়ক সরকার বাতিলের পক্ষে রায় দিয়েছেন। এই রায় লিখেছেন বিচারপতি এ বি এম খায়রুল হক। অর্থাৎ তিনি ‘অথর (লেখক) জাজ’।
কিন্তু আরো তিন জন বিচারপতি এই রায়ে একমত হয়েছেন। তারা হলেন বিচারপতি মোজাম্মেল হোসেন, বিচারপতি এস কে সিনহা এবং বিচারপতি সৈয়দ মাহমুদ হোসেন। পরবর্তীতে এই তিন জনই প্রধান বিচারপতি হয়েছিলেন। বিচারপতি মোজাম্মেল হোসেন ও বিচারপতি সৈয়দ মাহমুদ হোসেন নিজেদের কোনো মতামত বা পর্যবেক্ষণ ছাড়াই বিচারপতি এ বি এম খায়রুল হকের লেখা রায়ের সাথে একমত পোষণ করেন।
অপরদিকে বিচারপতি এস কে সিনহা বিচারপতি এ বি এম খায়রুল হকের রায়ের সাথে সহমত পোষণ করে তার মতামত ও পর্যবেক্ষণসহ রায় লিখেন। তাহলে আমার প্রশ্ন হলো এই তিন সাবেক প্রধান বিচারপতির ক্ষেত্রে কি হবে? এই রায়ের মাধ্যমে যদি কোনো অপরাধ সংঘটিত হয় তাহলে কি সেই অপরাধের দায় কেবলমাত্র বিচারপতি এ বি এম খায়রুল হকের? অন্য তিন জন বিচারপতির কি কোনো দায় নাই? তারা কি একই অপরাধে অভিযুক্ত হবেন না? শুধু প্রশ্নগুলো রেখে গেলাম।
আরও পড়ুন : সরকারি চাকরি (দ্বিতীয় সংশোধন) অধ্যাদেশ ২০২৫-এর গেজেট প্রকাশ
উল্লেখ্য যে, এই রায়ে অবশিষ্ট তিন জন বিচারপতি তত্ত্বাবধায়ক সরকারব্যবস্থা বাতিলের বিপক্ষে অবস্থান নিয়ে ভিন্নমত পোষণ করে রায় লিখেছেন। বিচারপতি এম এ ওয়াহ্হাব মিয়া, বিচারপতি মোহাম্মদ ইমান আলি ও বিচারপতি নাজমুন আরা সুলতানা ভিন্নমত পোষণ করেছেন। বিচারপতি এম এ ওয়াহ্হাব মিয়া সবথেকে শক্তিশালী যুক্তি দিয়ে ডিসেন্টিং রায় লিখেছেন। বিচারপতি মোহাম্মদ ইমান আলীও বিচারপতি এম এ ওয়াহ্হাব মিয়ার সাথে সহমত পোষণ করে বেশ কিছু শক্তিশালী যুক্তি দিয়ে আলাদা রায় লিখেছেন। বিচারপতি নাজমুন আরা সুলতানা বিচারপতি এম এ ওয়াহ্হাব মিয়ার রায়ের সাথে একমত পোষণ করেছেন।
তত্ত্বাবধায়ক সরকার অনির্বাচিত এটা বলেই মূলত তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা বাতিলের রায় দেয়া হয়। ‘তত্ত্বাবধায়ক সরকার অনির্বাচিত’ এটার বিরোধিতা করে বিচারপতি এম এ ওয়াহ্হাব মিয়া যুক্তি উপস্থাপন করে বলেছেন, সাধারণ ক্ষেত্রেও তো নির্বাচনের আগে বিদায়ী প্রধানমন্ত্রী ও তাঁর ক্যাবিনেট নির্বাচিত প্রতিনিধিত্বের চরিত্র হারায়। মেয়াদ শেষে তো এই সরকার অনির্বাচিত হয়ে যান।
কারণ ওয়েস্টমিনিস্টার সিস্টেমে প্রধানমন্ত্রী তখন রাষ্ট্রপতির অনুরোধে নতুন প্রধানমন্ত্রী না আসা পর্যন্ত দায়িত্ব পালন অব্যাহত রাখেন। তাই তত্ত্বাবধায়ক সরকারও নির্বাচিত না হলেও পরবর্তী নির্বাচন আয়োজনের দায়িত্ব পালন করলে ক্ষতি কি? তাছাড়া রাষ্ট্রপতি তো নিৰ্বাচিত স্ট্যাটাস নিয়েই সবার উপরে থাকেন। সুতরাং তত্ত্বাবধায়ক সরকার অনির্বাচিত এই অযুহাতে বাতিল করার কোনো সুযোগ নাই।
আরও পড়ুন : ফৌজদারি কার্যবিধির ২৪৭ ধারা : সিআর মামলায় ফরিয়াদির প্রতি অন্যায় চাপ
এখানে গুরুত্বপূর্ণ আরেকটা তথ্য হলো, দেশের স্বনামধন্য ৮ জন আইনজীবী এমিকাস কিউরি বা আদালতের বন্ধু হিসেবে এই মামলায় যুক্তিতর্ক উপাস্থাপন করেন। তাঁরা হলেন ড. কামাল হোসেন, ব্যারিস্টার রফিকুল হক, ড. এম জহির, বিচারপতি টি এইচ খান, মাহমুদুল ইসলাম, ব্যারিস্টার এম আমীর -ঊল ইসলাম, ব্যারিস্টার রোকনউদ্দিন মাহমুদ এবং ব্যারিস্টার আজমালুল হোসেন কিউসি।
শুধুমাত্র আজমালুল হোসেন কিউসি তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থাকে বেআইনী ও অসাংবিধানিক হিসেবে তার যুক্তি তুলে ধরে ধরেন। অবশিষ্ট ৭ জন আইনজীবী তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা বহাল রাখার পক্ষে যুক্তি উপস্থাপন করেন।
আরো গুরুত্বপূর্ণ তথ্য হলো তৎকালীন এটর্নী জেনারেল মাহবুবে আলমও তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা বহাল রাখার পক্ষে যুক্তিতর্ক উপস্থাপন করেছিলেন। এটর্নী জেনারেল তৎকালীন সরকারের নিয়োগ দেয়া রাষ্ট্রের সর্বোচ্চ আইন কর্মকর্তা। এত কিছুর পরও এমন একটি রায়ের মাধ্যমে রাষ্ট্রকে খাদের কিনারায় নিয়ে যাওয়া হয়েছিলো!
লেখক : সাঈদ শুভ; বিচারক ও গবেষক (বর্তমানে জেলা লিগ্যাল এইড অফিসার হিসেবে চাপাইনবাবগঞ্জে কর্মরত)। ই-মেইল: sayeed.judge@gmail.com