হালিম উর রশিদ নান্নু
হালিম উর রশিদ নান্নু

গাজীপুর জেলা আদালতে এজলাস সংকট ও দুই শিফটে বিচার কার্যক্রম: বাস্তবতা, চ্যালেঞ্জ ও করণীয়

হালিম উর রশিদ নান্নু : গাজীপুর জেলা বাংলাদেশের একটি দ্রুত বিকাশমান এবং ঘনবসতিপূর্ণ জেলা। শিল্প-কারখানা, নগরায়ণ, ও অভ্যন্তরীণ অভিবাসনের ফলে এ জেলার জনসংখ্যা ও আর্থ-সামাজিক কার্যক্রম ব্যাপক হারে বৃদ্ধি পেয়েছে। এর স্বাভাবিক প্রভাব পড়েছে বিচারব্যবস্থার উপরও। প্রতিদিন অসংখ্য ফৌজদারি ও দেওয়ানি মামলা দায়ের হচ্ছে, যার সুষ্ঠু নিষ্পত্তির জন্য প্রয়োজন পর্যাপ্ত বিচারক, কোর্ট রুম, সহায়ক কর্মী ও কাঠামোগত সুযোগ-সুবিধা। কিন্তু বাস্তবতা হলো— গাজীপুর জেলা আদালতে এজলাস কক্ষের মারাত্মক স্বল্পতা বিরাজ করছে, যা বিচার কাজ পরিচালনায় বড় প্রতিবন্ধকতা হয়ে দাঁড়িয়েছে।

বিচার কাজ দুই শিফটে পরিচালনার বাস্তবতা

দীর্ঘদিন ধরে এই সংকট মোকাবেলায় দুই শিফটে বিচার কার্যক্রম চালু করা হয়েছে। অর্থাৎ, কিছু কোর্ট সকাল শিফটে এবং কিছু কোর্ট দুপুর বা বিকেল শিফটে কার্যক্রম পরিচালনা করছে। বিচার বিভাগের এই উদ্যোগ অবশ্যই প্রশংসনীয়, কারণ এতে অন্তত সীমিত পরিসরে হলেও বিচার কার্যক্রম চালু রাখা সম্ভব হচ্ছে। এতে কিছু সুফল পাওয়া যাচ্ছে:

  • মামলাজট নিরসনের গতি কিছুটা বাড়ছে,

  • বিচারক ও কর্মীদের মধ্যে দায়িত্ববোধ বৃদ্ধি পাচ্ছে।

তবে এই পদ্ধতির কিছু সীমাবদ্ধতাও রয়েছে। যেমন:

  • বিচারপ্রার্থীদের অপেক্ষার সময় বাড়ছে,

  • বিচারক ও আইনজীবীদের মানসিক ও শারীরিক চাপ বৃদ্ধি পাচ্ছে,

  • পর্যাপ্ত আলো, নিরাপত্তা, ও প্রযুক্তিগত সহায়তার অভাব থাকায় দ্বিতীয় শিফটে কার্যক্রম কিছুটা ঝুঁকিপূর্ণ হয়ে ওঠে,

  • কর্মীদের মধ্যে কাজের আগ্রহ কমে যেতে পারে, ফলে বিচার প্রক্রিয়ার মান ক্ষতি গ্রস্থ হতে পারে।

এজলাস সংকটের পেছনে কারণসমূহ

গাজীপুরের এজলাস সংকটের মূল কারণগুলো হলো:

  • অপর্যাপ্ত অবকাঠামো: মামলা বৃদ্ধির তুলনায় কোর্ট ভবনের সম্প্রসারণ হয়নি।

  • জনবলের ঘাটতি: বিচারক, বেঞ্চ সহকারী, পেশকার ও অন্যান্য কর্মীদের ঘাটতি রয়েছে।

  • দ্রুত নগরায়ণের চাপ: গাজীপুরের ঘনবসতি ও শিল্পাঞ্চলের বিস্তার নতুন মামলা বাড়িয়ে দিচ্ছে।

  • প্রশাসনিক অবহেলা: দীর্ঘ সময় ধরে গাজীপুর আদালতের সমস্যা সম্পর্কে জানানো হলেও কার্যকর সমাধান হয়নি।

সম্ভাব্য সমাধান ও করণীয়

এই সমস্যা সমাধানের জন্য স্বল্প, মধ্য ও দীর্ঘমেয়াদি পদক্ষেপ গ্রহণ করা জরুরি:

স্বল্পমেয়াদি করণীয়:

  • বিচারকদের কাজের সময় সুনির্দিষ্টভাবে ভাগ করে চাপ কমানো।

  • প্রয়োজনীয় নিরাপত্তা ও আলো-জ্বালানির ব্যবস্থা নিশ্চিত করা।

মধ্যমেয়াদি করণীয়:

  • দ্রুত নতুন আদালত ভবনের নির্মাণ কাজ শুরু করা।

  • বিচারক ও কর্মীদের পদ সৃষ্টির মাধ্যমে নিয়োগ বৃদ্ধি করা।

দীর্ঘমেয়াদি করণীয়:

  • একটি পূর্ণাঙ্গ, আধুনিক, ডিজিটাল জুডিসিয়াল কমপ্লেক্স গড়ে তোলা।

  • মামলা ব্যবস্থাপনা সফটওয়্যার ও ভার্চুয়াল কোর্ট পদ্ধতি কার্যকরভাবে বাস্তবায়ন।

বিচারপ্রাপ্তি একজন নাগরিকের সাংবিধানিক অধিকার। সেই অধিকার নিশ্চিত করতে হলে কেবল আইন নয়, এর যথাযথ বাস্তবায়ন এবং বিচার কাঠামোর সক্ষমতাও থাকতে হবে। গাজীপুরের মতো গুরুত্বপূর্ণ জেলায় বিচার কার্যক্রমে এজলাস সংকট যেমন বিচারপ্রার্থীদের ভোগান্তির কারণ, তেমনি এটি বিচার বিভাগের উপর চাপ সৃষ্টি করছে। তাই এই সংকট থেকে উত্তরণের জন্য সরকারের সর্বোচ্চ পর্যায়ে বিষয়টি গুরুত্ব সহকারে বিবেচনা করা অত্যন্ত জরুরি। তবেই “ন্যায়বিচার সকলের জন্য”—এই লক্ষ্য বাস্তবায়ন সম্ভব হবে।

লেখক : হালিম উর রশিদ নান্নু;সদস্য, গাজীপুর জেলা আইনজীবী সমিতি।