আসামী পলাশ রানা

দুই সন্তানের জনক হয়ে গেলেন শিশু!

গাইবান্ধায় চিহ্নিত হ্যাকারকে জামিন করাতে আইনজীবীর বিরুদ্ধে জালিয়াতির অভিযোগ

কোর্ট রির্পোটার, গাইবান্ধা: গাইবান্ধায় চিহ্নিত “হ্যাকারের গডফাদারকে” বাঁচাতে অভিনব কায়দায় জালিয়াতির মাধ্যমে জামিনে মুক্ত করানোর অভিযোগ উঠেছে গাইবান্ধা জেলা বার এসোসিয়েশনের এক আইনজীবীর বিরুদ্ধে। অভিযুক্ত আইনজীবীর নাম শেফাউল ইসলাম রিপন। দুই সন্তানের জনক প্রাপ্তবয়স্ক অভিযুক্ত আসামীকে শিশু হিসাবে জাল যোগ-সাজশী কাগজ দাখিল করে অভিযুক্ত আসামী পলাশ রানা জেলহাজত থেকে জামিনে মুক্তি লাভের পর আদালতপাড়ায় জানাজানি হলে বিষয়টি নিয়ে জনমনে তৈরি হয় মিশ্র প্রতিক্রিয়া।

জানা যায় গত ১৫/০৭/২০২৫ ইং তারিখে আসামী পলাশ রানা সহ ০৪ জনকে সরকারি বিভিন্ন অনুদানের অর্থ, উপবৃত্তি এবং বিভিন্ন লোকের মোবাইল ব্যাংকিং হ্যাক এবং প্রতারণা করে অর্থ আত্মসাতের অভিযোগে বাংলাদেশ সেনাবাহিনী, গোবিন্দগঞ্জ থানা পুলিশসহ যৌথ বাহিনীর বিশেষ অভিযানে আসামী পলাশ রানাকে তার শ্বশুরবাড়ি গোবিন্দগঞ্জ থানাধীন তালুক কানুপুর গ্রাম হতে বিপুল পরিমাণ হ্যাকিং সামগ্রীসহ গ্রেফতার করা হয়।

এর পর ঐদিন গোবিন্দগঞ্জ থানার এসআই (নিরস্ত্র) মো: মমিনুল ইসলাম বাদী হয়ে গোবিন্দগঞ্জ থানায় দন্ডবিধি ৪০৬/৪২০/৪১৬/১৭০/৫১১/৩৪ ধারায় জিআর ৩২৩/২০২৫ নং মামলা দায়ের করলে আসামীদেরকে আদালতের মাধ্যমে জেল হাজতে প্রেরণ করা হয়। উক্ত মামলার এজাহারনামীয় দু’জন ০১ ও ০৩ নং আসামীর জামিনে মুক্তির আবেদন গোবিন্দগঞ্জ সিনিয়র জুডিশিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট (চৌকি) আদালত না-মঞ্জুর করলে ১ নং আসামী পলাশ রানা এবং ০৩ নং আসামী সুমন মিয়ার জামিনের জন্য গাইবান্ধা জেলা ও দায়রা জজ আদালতে ২৭/০৭/২০২৫ ইং তারিখে ক্রিমিনাল মিস কেস নং ৯৩৫/২৫ দাখিল করেন আইনজীবী শেফাউল ইসলাম রিপন। উক্ত মিস কেস শুনানীর ধার্য তারিখ ছিল ১২/০৮/২০২৫।

কিন্তু মিস কেস শুনানীর তারিখের আগেই গত ০৩/০৮/২০২৫ ইং তারিখে পেন্ডিং মিস কেস মামলার ০১ নং আসামী পলাশ রানাকে শিশু হিসাবে মান্য করার জন্য গাইবান্ধার শিশু আদালত-০২ এ আবেদন জানান আইনজীবী শেফাউল ইসলাম রিপন। এসময় দাখিলকৃত কাগজের সাথে যুক্ত করা হয় ২৫ বছর বয়সি পলাশ রানার যোগসাজশী ১৭ বছর ০১ দিন বয়সের জন্ম নিবন্ধন সনদ। যেখানে পলাশ রানার নাম কিঞ্চিত পরিবর্তন করে পলাশ মিয়া লেখা হয়।

আরও পড়ুন : দুদক সংস্কারের প্রস্তাবিত আইন দু’-এক মাসের মধ্যে প্রণয়ন হবে: ড. আসিফ নজরুল

তবে আসামী পলাশ রানার নিযুক্তিয় অভিযুক্ত আইনজীবী শেফাউল ইসলাম রিপন সংবাদ কর্মীদের প্রশ্নের জবাবে নিজেকে নির্দোষ দাবি করে বলেন, একজন আইনজীবী হিসাবে আসামীর জামিন করাতেই তিনি তার পেশাগত জায়গা থেকে চেষ্টা করেছেন এর বেশি কিছু নয়। জন্ম নিবন্ধন সরবরাহ করেছেন অভিযুক্ত পলাশ রানার বাবা, তিনি শুধু সেটাই আদালতে দাখিল করেছেন। শিশু বিবেচনা করার আবেদন করা তার দায়িত্ব, কিন্তু সেটা শিশু হিসাবে গ্রহণ করা না করা আদালতের বিষয়।

তবে মামলা গ্রহণের শুরুতে এজাহার উল্লেখিত বয়স অনুসারে প্রাপ্তবয়স্ক হিসাবে মিস কেস দাখিল করার পরে শুনানীর তারিখের আগেই আসামী যে শিশু সেটি জানবার বিষয়টি সরাসরি জিজ্ঞেস করা হলে তিনি কোন সদুত্তর দিতে পারেননি।

এই রির্পোটারের সাথে পলাশ রানার বাবা মোঃ ইউনুছ আলীর মোবাইলে কথা হলে জানালেন, তিনি তার সন্তানের জন্ম নিবন্ধন সনদ আইনজীবী শেফাউল ইসলাম রিপনকে বা অন্য কোন ব্যক্তিকে কখনোই সরবরাহ করেননি এবং এই জন্ম নিবন্ধন সনদ সম্পর্কে তিনি কিছুই জানেন না। তবে তার ছেলেকে জামিনে মুক্তির জন্য তাকে বড় অঙ্কের ফি প্রদান করতে হয়েছে।

আসামী শিশু হলে মামলা গ্রহণের শুরুতেই আইনজীবীর জানবার কথা এবং আসামীকে সেভাবেই উপস্থান করা হয় বলে জানালেন গাইবান্ধা জেলাবারের একাধিক সিনিয়র আইনজীবী। প্রচলিত নিয়ম অনুযায়ী সংশ্লিষ্ট কোর্টে শিশু হিসাবে মান্য করার দরখাস্ত দাখিল করার পর মূলনথি তলব পূর্বক উক্ত আবেদন শুনানী হবার কথা।

কিন্তু একই তারিখে মিস কেস হতে মামলা টেকব্যাক করে শিশু আদালতে শিশু হিসাবে মান্য করার দরখাস্ত দাখিল, নথি তলব, নথি সামিল এবং শুনানী শেষে আসামীর জামিন মঞ্জুর পূর্বক আসামীর জেলহাজত হতে জামিনে মুক্তির ঘটনা বিরল, কারণ সাধারণত নথি তলবের দরখাস্ত মঞ্জুর হলে মূলনথি সহ পূর্ণাঙ্গ শুনানীর জন্য বিজ্ঞ আদালত নতুন একটি তারিখ দিয়ে থাকেন। এই মামলার ক্ষেত্রে এসব নিয়মের ব্যতিক্রম এবং দ্রততার বিষয়ে গাইবান্ধা বারে প্রাকটিসরত আইনজীবীদের মনে দৃঢ় সন্দেহের সৃষ্টি হয়েছে। বিষয়টি যে পূর্ব পরিকল্পিত সেটি সবার কাছে পরিষ্কার।

আরও পড়ুন : মাইলস্টোন ট্রাজেডি : মৃত্যুর কাছে হার মানলেন অ্যাডভোকেট মাহফুজাও

এ ব্যাপারে শিশু আদলত-০২ এর অতিরিক্ত পাবলিক প্রসিকিউটর আবুবক্কর সিদ্দিক ছানা সাংবাদিকদের জানান উক্ত ঘটনায় দাখিলকৃত জামিনের দরখাস্ত তাকে সিন করানো হয়নি এবং এ বিষয়ে তিনি কোনভাবেই অবগত ছিলেন না। জালিয়াতির বিষয়ে তিনি যথাযথ তদন্ত পূর্বক দোষীদের দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি দাবি করেন।

নাম প্রকাশ না করার শর্তে গাইবান্ধা জেলাবারে কর্মরত একজন ল’ক্লার্ক এই সংবাদদাতাকে জানান, অভিযুক্ত আইনজীবী ঠিক কতগুলো মামলায় এমন জালিয়াতির মাধ্যমে আসামীদের মুক্তির ব্যবস্থা করে মোটা অঙ্কের টাকা কামিয়েছেন তা সঠিক তদন্ত করলেই বেরিয়ে আসবে। খুব সম্প্রতি গত ১০/০৮/২০২৫ ইং তারিখে গোবিন্দগঞ্জ থানার জিআর ২৩১ নং মামলার দুইজন আসামীর মধ্যে এক নাম্বার আসামী আশিক মিয়াকে পলাশ রানার মতই শিশু দেখিয়ে জামিনে মুক্তির ব্যবস্থা করেছেন বলেও জানান ঐ ক্লার্ক। বিষয়টির সত্যতা যাচাইয়ে সংশ্লিষ্ট আদালতে নথি দেখতে গেলে নথি দেখাতে নানা অজুহাতের বর্ণনা দেন সংশ্লিষ্ট কোর্টের স্টাফ।

খোঁজ নিয়ে জানা যায়, আইনজীবী শেফাউল ইসলাম রিপন গত ২৫/০৯/২০২১ ইং তারিখে বাংলাদেশ বার কাউন্সিল কর্তৃক সনদপ্রাপ্ত হয়ে গাইবান্ধা জেলা বার এসোসিয়েশনে যোগদান করেন। জেলাবার এ যোগদানের পর হতেই আইনজীবী রিপন গড়ে তোলেন এক শক্তিশালী মামলা সিন্ডিকেট। গোবিন্দগঞ্জ এবং পলাশবাড়ী থানায় চব্বিশ ঘন্টা তার নিয়োগকৃত তদবিরকারক (দালালরা) মামলা রিসিভ করেন।

মক্কেলের আর্থিক সঙ্গতি বুঝে বিভিন্ন ছক এঁকে জামিনে মুক্তির ব্যবস্থা করে রীতিমত ম্যাজিক্যাল আইনজীবী হিসাবে নিজেকে সকলের নিকট উপস্থাপন করেন অভিযুক্ত এই আইনজীবী এবং তার সিন্ডিকেট। গোবিন্দগঞ্জ চৌকি আদালতসহ বিভিন্ন জায়গায় চাউর আছে রিপন উকিল হাই চ্যানেলের মাধ্যমে বড় বড় মামলার আসামীদের দ্রুত জামিনের ব্যবস্থা করে দেবার যোগ্যতা রাখেন।

নিয়মিত ফেসবুক লাইভে আইনজীবী শেফাউল ইসলাম সাবেক সংসদ সদস্য ব্যারিস্টার সুমন স্টাইলে বিভিন্ন সামাজিক কর্মকান্ডের মাধ্যমে নিজেকে একজন বিশিষ্ট ব্যক্তি হিসাবে প্রচার ও প্রকাশের চেষ্টা করেন। বিভিন্ন সভা-সমিতি, ওয়াজ মাহফিলে প্রধান অতিথি হিসাবে উপস্থিত হয়ে হাজার হাজার টাকা দান এবং বিভিন্ন রাস্তাঘাট সংস্কারের লাইভ ভিডিও প্রচারের মাধ্যমে সমাজের চোখে নিজেকে ভালো হিসাবে জাহির করতে সচেষ্ট থাকেন।

আরও পড়ুন : ডাক্তার কন্যাকে অবৈধভাবে বন্দী করার অভিযোগে বাবা-মাকে হাইকোর্টে হাজিরের নির্দেশ

হ্যাকিংয়ের শিকার কয়েকজন ভিকটিমের সাথে এই সংবাদদাতার কথা হলে তাদের একজন সরকারি অনুদানের বয়স্ক ভাতাভোগী দরিদ্র শামছুল ইসলাম জানান, তিনি নগদ একাউন্টের মাধ্যমে বয়স্ক ভাতার টাকা পেয়ে থাকেন। গত জুন মাসের টাকা মোবাইলে কল করে অপরিচিত প্রতারক চক্র তার মোবাইল হতে ১৮০০ টাকা উত্তোলন করে নেয়। এসব আসামীদের তিনি সর্বোচ্চ সাজা দাবি করেন।

গাইবান্ধা জেলা বারের সিনিয়র আইনজীবী এবং বাংলাদেশ ল’ইয়ার্স কাউন্সিল গাইবান্ধা জেলা শাখার সভাপতি অ্যাডভোকেট সাইদ-আল-আসাদ এই সংবাদদাতাকে বলেন, অভিযোগের বিষয়টি অত্যন্ত গুরুতর এবং স্পর্শকাতর যা আইন পেশার ভাবমূর্তির সাথে ওতপ্রোতভাবে জড়িত। শুধুমাত্র আর্থিকভাবে লাভবান হবার কারণে একজন আইনজীবী জেলার সর্বোচ্চ আদালতে জালজালিয়াতির মাধ্যমে আসামীকে জামিনের ব্যবস্থা করে দিবেন বিষয়টি গুরুতর অসদাচারণ, লজ্জাজনক এবং আইনপেশার ক্ষেত্রে গভীর উদ্বেগের বিষয় বটে।

তিনি আরো বলেন, একজন জুনিয়র আইনজীবীর কিভাবে সাহসহয়ে এত বড় অপকর্মের সাথে জড়িত হবার। বিষয়টি যথাযথ তদন্তের মাধ্যমে অভিযুক্তদের দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি নিশ্চিত করা না গেলে এ পেশার ভাবমূর্তি যেমন ক্ষুন্ন হবে অপরদিকে জনসাধারণের মাঝে আইনজীবী সমাজ সম্পর্কে একপ্রকার ভুল বার্তা পৌছাবে। অভিযুক্ত আইনজীবী ইতিপূর্বে এ ধরণের কর্মকান্ডের সাথে জড়িত ছিলেন কিনা সেটিও খতিয়ে দেখা একান্ত প্রয়োজন।