তত্ত্বাবধায়ক সরকারব্যবস্থা বাতিল করে দেওয়া রায়ের বিরুদ্ধে আপিল শুনবেন সর্বোচ্চ আদালত। এ জন্য আগামী ২১ অক্টোবরে শুনানির দিন ধার্য করেছেন আপিল বিভাগ।
আজ বুধবার (২৭ আগস্ট) প্রধান বিচারপতি সৈয়দ রেফাত আহমেদের নেতৃত্বাধীন সাত সদস্যের আপিল বিভাগ এই আদেশ দেন।
তত্ত্বাবধায়ক সরকারব্যবস্থা বাতিল করে ১৪ বছর আগে আপিল বিভাগ রায় দেন। এই রায় পুনর্বিবেচনা (রিভিউ) চেয়ে করা আবেদনের ওপর শুনানি নিয়ে লিভ মঞ্জুর (আপিলের অনুমতি) করে এই আদেশ দেওয়া হয়।
রিভিউতে লিভ মঞ্জুর করে আপিল শুনানি, নাকি রিভিউ আবেদনের শুনানি নিয়ে চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত দেওয়া হবে, এ প্রসঙ্গ আজ শুনানিতে ওঠে। এ বিষয়ে রিভিউ আবেদনকারীপক্ষের আইনজীবীরা বলেন, লিভ না দিয়ে রিভিউ আবেদন নিষ্পত্তি করে আদালত সিদ্ধান্ত দিতে পারেন।
সংবিধানের বেশ কয়েকটি অনুচ্ছেদ তুলে ধরে অ্যাটর্নি জেনারেল মো. আসাদুজ্জামান বলেন, লিভের প্রয়োজন নেই। প্রেসক্রাইভ ল নেই। প্র্যাকটিস (প্রথা) এটাও আছে—লিভ মঞ্জুর করে রায়ের বিষয়ে সিদ্ধান্ত দেওয়ার। আবার লিভ মঞ্জুর না করেও দেওয়া হয়।
শুনানি নিয়ে একপর্যায়ে প্রধান বিচারপতি সৈয়দ রেফাত আহমেদ বলেন, ‘আমরা প্রথা অনুসরণ করব। লিভ দিয়ে পুরো বিষয়টি শুনব।’
পরে আদালত লিভ মঞ্জুর করে আদেশ দেন।
আরও পড়ুন : নির্বাচনকালীন সরকার নিয়ে কার্যকর সমাধান চায় আপিল বিভাগ
২০১১ সালের ১০ মে তৎকালীন প্রধান বিচারপতি এ বি এম খায়রুল হকের নেতৃত্বাধীন আপিল বিভাগের সাত বিচারপতির পূর্ণাঙ্গ বেঞ্চ সংখ্যাগরিষ্ঠ মতামতের ভিত্তিতে সংবিধানের ত্রয়োদশ সংশোধনী (তত্ত্বাবধায়ক সরকারব্যবস্থা) বাতিল ঘোষণা করে রায় দেন।
এই রায় পুনর্বিবেচনা চেয়ে গত বছরের অক্টোবরে একটি আবেদন করেন বিএনপির মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর। এর আগে রায় পুনর্বিবেচনা চেয়ে আবেদন করেন সুশাসনের জন্য নাগরিকের (সুজন) সম্পাদক বদিউল আলম মজুমদারসহ পাঁচ বিশিষ্ট ব্যক্তি।
আপিল বিভাগের ওই রায় পুনর্বিবেচনা চেয়ে গত বছরের ২৩ অক্টোবর আরেকটি আবেদন করেন জামায়াতে ইসলামীর সেক্রেটারি জেনারেল মিয়া গোলাম পরওয়ার। এ ছাড়া নওগাঁর রানীনগরের নারায়ণপাড়ার বাসিন্দা বীর মুক্তিযোদ্ধা মো. মোফাজ্জল হোসেন আপিল বিভাগের রায় পুনর্বিবেচনা চেয়ে গত বছর একটি আবেদন করেন।
রিভিউ আবেদনের ওপর গতকাল মঙ্গলবার ও আজ শুনানি হয়। শুনানি নিয়ে আজ লিভ মঞ্জুর করে আদেশ দেওয়া হয়। আদালত বলেছেন, আগামী ২১ অক্টোবর আপিল শুনানির জন্য কার্যতালিকার শীর্ষে থাকবে।
আদালতে বিএনপির পক্ষে করা রিভিউ আবেদনের পক্ষে শুনানি করেন জ্যেষ্ঠ আইনজীবী জয়নুল আবেদীন ও মো. রুহুল কুদ্দুস। সঙ্গে ছিলেন আইনজীবী কায়সার কামাল।
জামায়াতের পক্ষে শুনানি করেন আইনজীবী মোহাম্মদ শিশির মনির।
রাষ্ট্রপক্ষে অ্যাটর্নি জেনারেল মো. আসাদুজ্জামান শুনানিতে অংশ নেন। সঙ্গে ছিলেন অতিরিক্ত অ্যাটর্নি জেনারেল মোহাম্মদ আরশাদুর রউফ।
পাঁচ বিশিষ্ট নাগরিকের পক্ষে জ্যেষ্ঠ আইনজীবী শরীফ ভূইয়া শুনানি করেন। অপর রিভিউ আবেদনকারীর পক্ষে আইনজীবী এ এস এম শাহরিয়ার কবির উপস্থিত ছিলেন।
এ মামলায় ইন্টারভেনার (ব্যাখ্যাকারী) হিসেবে যুক্ত হয়েছেন জ্যেষ্ঠ আইনজীবী এহসান এ সিদ্দিক। পরে তিনি বলেন, বিএনপির করা রিভিউ আবেদনে লিভ মঞ্জুর করেছেন আপিল বিভাগ। অর্থাৎ এখন আপিলের ওপর শুনানি হবে। আগামী ২১ অক্টোবর শুনানির দিন ধার্য করেছেন আদালত। আপিলের সঙ্গে অপর রিভিউ আবেদনগুলোও শুনানির জন্য আসবে।
মামলার পূর্বাপর
১৯৯৬ সালে ত্রয়োদশ সংশোধনীর মাধ্যমে সংবিধানে তত্ত্বাবধায়ক সরকারব্যবস্থা অন্তর্ভুক্ত করা হয়। এই সংশোধনীর বৈধতা নিয়ে সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবী এম সলিমউল্লাহসহ অন্যরা ১৯৯৮ সালে হাইকোর্টে রিট করেন। প্রাথমিক শুনানি নিয়ে হাইকোর্ট রুল দেন।
হাইকোর্টের বিশেষ বেঞ্চ চূড়ান্ত শুনানি শেষে ২০০৪ সালের ৪ আগস্ট রায় দেন। সংবিধানের ত্রয়োদশ সংশোধনীকে বৈধ ঘোষণা করে দেওয়া রায়ে বলা হয়, ১৯৯৬ সালের ত্রয়োদশ সংশোধনী সংবিধানসম্মত।
এই রায়ের বিরুদ্ধে সরাসরি আপিলের অনুমতি দেওয়া হয়। এর ধারাবাহিকতায় ২০০৫ সালে আপিল করে রিট আবেদনকারীপক্ষ।
এ আপিল মঞ্জুর করে ২০১১ সালের ১০ মে আপিল বিভাগ রায় ঘোষণা করেন। ঘোষিত রায়ের পর তত্ত্বাবধায়ক সরকারব্যবস্থার বিলোপসহ বেশ কিছু বিষয়ে আনা পঞ্চদশ সংশোধনী আইন ২০১১ সালের ৩০ জুন জাতীয় সংসদে পাস হয়। ২০১১ সালের ৩ জুলাই এ-সংক্রান্ত গেজেট প্রকাশ করা হয়।
এদিকে পঞ্চদশ সংশোধনী আইন চ্যালেঞ্জ করে গত বছরের ১৮ আগস্ট সুজন সম্পাদক বদিউল আলম মজুমদারসহ পাঁচ বিশিষ্ট ব্যক্তি রিট করেন। রিটের প্রাথমিক শুনানি নিয়ে হাইকোর্ট রুল দেন।
পঞ্চদশ সংশোধনী আইনের ১৬টি ধারার বৈধতা নিয়ে নওগাঁর রানীনগরের নারায়ণপাড়ার মোফাজ্জল হোসেন গত বছরের অক্টোবরে একটি রিট করেন। যার পরিপ্রেক্ষিতে রুল হয়। রুলের ওপর চূড়ান্ত শুনানি শেষে গত বছরের ১৭ ডিসেম্বর হাইকোর্ট রায় ঘোষণা করেন।
রায়ে নির্দলীয় তত্ত্বাবধায়ক সরকারব্যবস্থা বিলুপ্তি-সংক্রান্ত পঞ্চদশ সংশোধনী আইনের ২০ ও ২১ ধারা সংবিধানের সঙ্গে সাংঘর্ষিক ও বাতিল ঘোষণা করা হয়। একই সঙ্গে সংবিধান সংশোধনের ক্ষেত্রে গণভোটের বিধান পুনর্বহাল এবং পঞ্চদশ সংশোধনী আইনের আরও চারটি ধারা বাতিল ঘোষণা করা হয়।