আইন উপদেষ্টা অধ্যাপক আসিফ নজরুল বলেছেন, পতিত ফ্যাসিবাদী আওয়ামী লীগ জনগণকে নির্যাতন করার শক্তিকেই সাংবিধানিক ক্ষমতা হিসেবে ভেবে নিয়েছিল। জনগণের ইচ্ছার কোনো গুরুত্ব তারা দিত না, বরং নির্যাতনের ক্ষমতাকেই নিজেদের অধিকার হিসেবে প্রতিষ্ঠা করার চেষ্টা করেছিল।
মঙ্গলবার (২৬ আগস্ট) বিকেলে সুপ্রিম কোর্ট বার অ্যাসোসিয়েশন মিলনায়তনে ‘রেভল্যুশনারি কনস্টিটিউশনালিজম অ্যান্ড হোয়াই ইট ওয়াজ এসেনশিয়াল টু ডিক্লেয়ার দ্য ফিফটিনথ অ্যামেন্ডমেন্ট আনকনস্টিটিউশনাল’ শীর্ষক বইয়ের প্রকাশনা উৎসবে তিনি এ কথা বলেন।
বইটির লেখক সুপ্রিম কোর্টের জ্যেষ্ঠ আইনজীবী শরিফ ভূঁইয়া। বইটি প্রকাশ করেছে ইউনিভার্সিটি প্রেস লিমিটেড। অনুষ্ঠানে প্রধান অতিথি ছিলেন আইন উপদেষ্টা আসিফ নজরুল। এ সময় বাংলাদেশের সংবিধানের অন্যতম প্রণেতা ও গণফোরামের ইমেরিটাস সভাপতি ড. কামাল হোসেন উপস্থিত ছিলেন।
আইন উপদেষ্টা বলেন, “সংবিধানের পঞ্চদশ সংশোধনীতে আওয়ামী লীগ যা ইচ্ছা তাই করেছে। আওয়ামী লীগের রাজনীতি ছিল সব সময় জিয়াউর রহমানকে গালাগালি করা এবং শেখ মুজিবুর রহমানকে পৃথিবীর সকল কিছুর ঊর্ধ্বে নিয়ে যাওয়া। কিন্তু সংবিধান সংশোধনের সময় শেখ হাসিনা অনেক ক্ষেত্রে শেখ মুজিবকে বাদ দিয়ে জিয়াউর রহমানকে বেছে নিয়েছিলেন।”
উদাহরণ টেনে তিনি বলেন, বাহাত্তরের সংবিধানে অবসরোত্তর বিচারকদের সরকারি চাকরিতে যোগদানের বিধান ছিল না। রাষ্ট্রপতি জিয়াউর রহমান সেটি প্রবর্তন করেছিলেন। সুপ্রিম জুডিশিয়াল কাউন্সিলও তাঁর প্রবর্তিত একটি প্রতিষ্ঠান। শেখ হাসিনা প্রকাশ্যে জিয়াউর রহমানের সমালোচনা করলেও বহু ক্ষেত্রে বঙ্গবন্ধুর পরিবর্তে তাঁকেই অনুসরণ করেছিলেন।
আসিফ নজরুল আরও বলেন, “পঞ্চদশ সংশোধনী ভয়াবহ। মাঝে মাঝে আমার মনে হতো, এমন এক সাংবিধানিক সংশোধনী আওয়ামী লীগের লোকজন কি এতটাই বোকা হয়ে করেছে, নাকি উদ্ধত হয়ে? আমার মনে হয় তারা উদ্ধতই ছিল। তারা ভেবেছিল, তাদের ক্ষমতা এতই অটল যে একটি নির্যাতনযন্ত্র চালু করলেই জনগণ মুখ খুলতে পারবে না।”
আরও পড়ুন : ভূমি সেবায় সর্বোচ্চ সেবা নিশ্চিতের আহ্বান: রাবার শিল্পের জটিলতা নিরসনে উদ্যোগ
অনুষ্ঠানে আলোচক ছিলেন সুপ্রিম কোর্টের আপিল বিভাগের অবসরপ্রাপ্ত বিচারপতি মো. আবদুল মতিন। তিনি বইটির প্রশংসা করে বলেন, “সরকার নিপীড়কের ভূমিকায় অবতীর্ণ হলে জনগণের দায়িত্ব তাকে উৎখাত করা। বাংলাদেশের জনগণ নিপীড়ক সরকারকে উৎখাত করেছে।”
জুলাইয়ের ঘটনাকে বিপ্লব হিসেবে আখ্যা দিয়ে তিনি বলেন, “যে বিপ্লবে বায়তুল মোকাররমের খতিবকে পালাতে হয়, দেশের প্রধানমন্ত্রীকে দলবলসহ পালাতে হয়, সেটিকে বিপ্লব ছাড়া আর কী বলা যায়।”
পঞ্চদশ সংশোধনী অসাংবিধানিক ঘোষণার দাবিতে বাদী ছিলেন জাতীয় ঐকমত্য কমিশনের সদস্য বদিউল আলম মজুমদার। তিনি আলোচনায় বলেন, একজন সচেতন নাগরিক হিসেবে তাঁর মনে হয়েছিল একটি সংসদ ভবিষ্যৎ সংসদের ক্ষমতা সীমিত করতে পারে না। ২০১৩ সালে তিনি লিখেছিলেন, পঞ্চদশ সংশোধনীর নৈতিক ভিত্তি নেই, এর আইনি বৈধতাও প্রশ্নবিদ্ধ।
বইয়ের লেখক শরিফ ভূঁইয়া অনুষ্ঠানে বলেন, “এই বইয়ের তিনটি অধ্যায় সাজানো হয়েছে তিন সময়ে লেখা প্রবন্ধ থেকে—বর্তমান সরকারের আইনত ভিত্তি কী, এ সরকার কত দিন থাকতে পারবে এবং স্পিকার পদত্যাগের পর সাংবিধানিক শূন্যতা তৈরির প্রসঙ্গ। এর সঙ্গে পঞ্চদশ সংশোধনীর মামলা নিয়ে কাজ করার অভিজ্ঞতাও যুক্ত করা হয়েছে।”
অনুষ্ঠানে চেয়ার অব দ্য সেশন ছিলেন সুপ্রিম কোর্টের জ্যেষ্ঠ আইনজীবী সারা হোসেন। তিনি বলেন, “নতুন সংবিধান না পেলে নির্বাচন করা যাবে না, এগোনো যাবে না—এমন বক্তব্য এখন শোনা যাচ্ছে। কিন্তু এর আগে যারা এ ধরনের দাবি তুলছেন, তাঁদের সংবিধানটি অন্তত পড়ে দেখা উচিত।”
অনুষ্ঠানে আরও বক্তব্য দেন বিচার প্রশাসন প্রশিক্ষণ ইনস্টিটিউটের মহাপরিচালক বিচারপতি এমদাদুল হক, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আইন অনুষদের ডিন অধ্যাপক মোহাম্মদ একরামুল হক, লেখক ও অনুবাদক মিল্লাত হোসেন প্রমুখ। ধন্যবাদ জ্ঞাপন করেন ইউপিএল-এর ব্যবস্থাপনা পরিচালক মাহরুখ মহিউদ্দীন।