নারী নির্যাতন আইনে নারীরা কতটুকু সুরক্ষিত

বিয়ের পর স্বামীদের বিরুদ্ধে ধর্ষণের মামলা- টাকায় ‘সেটেল’

সরকারি চাকরিজীবীদের টার্গেট করে বিয়ে, এরপর যৌতুক ও ধর্ষণ মামলার ভয় দেখিয়ে অর্থ হাতিয়ে নেওয়ার অভিযোগ উঠেছে এক নারীর বিরুদ্ধে। যার প্রতারণার শিকার হয়েছেন একজন বিচারকও।

ঢাকার নারী ও শিশু নির্যাতন দমন ট্রাইব্যুনালে, ৯-এ খোঁজ মিলেছে সেই নারীর। নাম- মদিনা মুনসুর ওরফে সৈয়দা মিশু। হাইকোর্টে মামলা করতে এসে ভুক্তভোগী বিচারকের আইনজীবী জানান, এই নারী তার মক্কেলের বিবাহিত স্ত্রী। তার মক্কেলের ‘পায়ের কাছে আশ্রয় চায়’ বা তার ‘বাসার কাজের মেয়ে হয়েও যেন থাকতে পারে’ এমন ‘ইমোশনাল ব্ল্যাকমেইল’ ও নানাবিধ চাপ সৃষ্টি করে পারিবারিকভাবে বিয়ে করেন। বিয়ের মাত্র সাত দিনের মাথায় বিয়ের কথা গোপন করে তিনি তার স্বামীর বিরুদ্ধে ধর্ষণের মামলা করেন ভাটারা থানায়।

ট্রাইব্যুনালের তথ্য অনুযায়ী, মদিনা মুনসুর পরপর সাতটি বিয়ে করেন। তার বেশিরভাগ স্বামীই সরকারি চাকরিজীবী। যারা বিভিন্ন ক্যাডার সার্ভিসে কর্মরত আছেন। তিনি —২০০৬, ২০১০, ২০১৩, ২০১৫, ২০২০, ২০২২ এবং সর্বশেষ ২০২৫ সালে মোট ৭টি বিয়ে করেন। যদিও একাধিক বিয়ে করা অপরাধ নয়, তবে তার বিরুদ্ধে বিয়ে ও প্রতারণা সংক্রান্ত  মামলা বর্তমানে ঢাকার বিভিন্ন আদালতে  বিচারাধীন রয়েছে।

অভিযোগ রয়েছে, প্রতিবার বিয়ের পর স্বামীর বিরুদ্ধে যৌতুক ও ধর্ষণ মামলা করেন মদিনা মনসুর। ৪র্থ স্বামীর বিরুদ্ধে পটুয়াখালী আদালতে যৌতুকের মামলা, ৫ম স্বামী ও শাশুড়ির বিরুদ্ধে ঢাকার নারী ও শিশু নির্যাতন ট্রাইব্যুনাল,৭-এ নারী নির্যাতনের ‘যৌতুকের কারণে মারধরের’ মামলা, ষষ্ঠ স্বামীর বিরুদ্ধে গুলশান থানায় ‘বিয়ের প্রলোভনে ধর্ষণের মামলা’ (যা ঢাকার নারী ও শিশু নির্যাতন ট্রাইব্যুনাল ৮-এ বিচারাধীন) ও পটুয়াখালী আদালতে যৌতুকের মামলা, ৭ম স্বামীর বিরুদ্ধে  বিয়ের পরে আবার ‘বিয়ের প্রলোভনে ধর্ষণের’ মামলা করেন, যা ঢাকার নারী ও শিশু নির্যাতন দমন ট্রাইব্যুনাল ৯-এ বিচারাধীন রয়েছে, ৭ম স্বামী ও শাশুড়ির বিরুদ্ধে যৌতুক ও অর্থ আত্মসাতের মামলা করেছেন পটুয়াখালী সদর থানায় যার সত্যতা না পাওয়ায় আসামীদের অব্যহতি সুপারিশ করে পুলিশ চূড়ান্ত রিপোর্ট জমা দিয়েছেন আদালতে।

আরও পড়ুন : বিচারকের আদেশ জালিয়াতি: দেউলিয়া আদালতের সেরেস্তাদার রিমান্ডে

১ম-৩য় স্বামীদের বিরুদ্ধে কি কি মামলা করেছেন সে বিষয়ে তদন্ত চলমান। তার স্বামীদের অভিযোগ তিনি বিয়ের পরে মামলা দিয়ে মোটা অংকের টাকায় তা আপোষ করেন। অনেকে চাকরি ও সামাজিক অবস্থান বাঁচানোর ভয়ে তার সাথে আপোষ করতে বাধ্য হন। প্রভাবশালী মহলের কিছু ব্যক্তিও তার ব্ল্যাকমেইল এর শিকার, যাদের কে দিয়ে তিনি তার ধরাকে সরা জ্ঞান করেন।

ভুক্তভোগী বিচারকের আইনজীবী ইশরাত হাসান বলেন, তার (মদিনা মুনসুর ওরফে সৈয়দা মিশু) একটা নির্দিষ্ট কৌশল আছে। অপেক্ষাকৃত কমবয়সী, ব্যাচেলর, এবং সরকারি চাকরিজীবীদের টার্গেট করেন, ব্ল্যাকমেইল করেন। মামলা দিয়ে ভয় দেখান, তারপর টাকায় আপস করান। আমাদের কাছে তার একাধিক কাবিননামা, কোর্টের আপসের নথি এবং প্রতারণার প্রমাণ রয়েছে।

অভিযোগের বিষয়ে মদিনা মুনসুর বলেন, কে মামলা করেছে সেটা আমি জানি না। নারী ও শিশু আদালতে আমি মামলা করেছি। বিষয়টা বিচারাধীন, তাই আমি কিছু বলতে চাই না।

ভুক্তভোগী বিচারকের আইনজীবী ইশরাত হাসান আরও বলেন, তিনি (সৈয়দা মিশু ওরফে মদিনা মনসুর) অন্তত স্বীকার করেছেন যে বিয়ে করেছেন, এতে আমরা খুশি। তিনি ভবিষ্যতে হয়তো বাকি স্বামীদেরও চিনবেন। কারণ এসব বিয়ের আর্থিক আপস ও মামলার রেকর্ড আমাদের কাছে আছে। এই মদিনা মনসুর পুলিশের এক উর্ধতন কমিশনারকে দিয়ে  আমার মক্কেলকে আপোষ করে সংসার করতে চাপ প্রয়োগ করেন এবং আপোষ না করলে এই মামলায় চার্জ শিট দিবেন বলে পরোক্ষভাবে হুমকি দেন- যার প্রমাণ আমাদের কাছে রয়েছে। আমরা উপযুক্ত আদালতে তা দাখিল করবো।

আরও পড়ুন : চীনে নতুন আইন: চিকিৎসা, আইন, শিক্ষা ও অর্থনীতি বিষয়ে কনটেন্ট বানাতে এখন লাগবে সরকারি সনদ

টাকায় ‘সেটেল’ করার কয়েকটি প্রস্তাব পেয়েছেন  বলে জানান- এই  বিচারকের ঢাকা জজ কোর্টের আইনজীবী এডভোকেট নাশিদুস জামান নিশান। তিনি বলেন, মামলার আমলি পর্যায়ে থাকতে এক ভদ্রলোক তার চেম্বারে এসে ১৫ লাখ টাকায় এই মামলা শেষ করে দিতে পারবেন বলে তাকে প্রস্তাব দেন। তিনি এই  মামলা মিথ্যা এবং আইনগত ভাবে মোকাবেলা করবেন বলে জানিয়ে তার প্রস্তাব প্রত্যাখ্যান করেন।

এদিকে, মদিনা মুনসুরের  নিজ আইনজীবী আশফাক আবীর হাসিব জানিয়েছেন, তিনি মামলাটি থেকে সরে দাঁড়িয়েছেন। তার ভাষায়, আমি ফেব্রুয়ারি থেকে এই মামলা চালিয়ে আসছি।এইনিয়েআমিতারমামলায়তাকেদুইবারঅনাপত্তিদিয়েছি।আমার সামনে তার (মদিনা) কার্যক্রমের ‘প্যাটার্ন’ পরিষ্কার হয়েছে। তিনি অর্থ আদায়ের জন্য আইনকে একটি মাধ্যম হিসেবে ব্যবহার করছিলেন। বারবার একই বিষয়ে অভিযোগ করাকে আইন-বিজ্ঞানের ভাষায় ‘prior pattern of false accusation’ বলে।

এই আইনজীবী আরও জানান, তার সর্বশেষ ‘বিয়ের প্রলোভনে ধর্ষণের’ মামলাটি ডিসচার্জ হয়ে যাবে এই আশংকা থেকে তিনি আসামী অর্থাৎ তার ৭ম স্বামীর সাথে দ্রুত বসতে বলেন এবং অনৈতিক সেটেলমেন্টের প্রস্তাব দেন যা একজন কোর্ট অফিসার হিসেবে আমি করতে পারিনা। তার এইসব প্রস্তাব আইনজীবী হিসেবে আমার নৈতিকতা ও আইনের সঙ্গে যায় না। তাই আমি ১২৬ ধারায় আমার মক্কেলের ‘অপরাধ বাসনা’ আদালতকে জানিয়ে মামলা থেকে সরে দাঁড়িয়েছি।

আরও পড়ুন : আগের ‘দন্তহীন’ মানবাধিকার কমিশনকে ‘শক্তিশালী’ করে অধ্যাদেশ অনুমোদন

মামলার বিষয়ে তৎকালীন ভাটারা থানার ওসি মাজহারুল ইসলাম জানান- ‘ভদ্র মহিলা এজাহারে একবারও বলেননি তিনি বিবাহিত বা আসামী (বিচারক) তার স্বামী হয়। তাকে আমরা মামলা করাকালীন আলামত দিতে বললেও তিনি কোন আলামত আমাদেরকে প্রদান করেন নি। ১ম আলামত থেকে কোন কিছু না পাওয়া গেলেও তাকে আরও আলামত দিতে বললেও তিনি দেননি।  পরে তদন্ত করে জানতে পারি তিনি আসামীকে ইতোমধ্যে বিয়ে করেছেন যা তিনি আমাদের কাছে গোপন রেখেছেন।’

‘তদন্তে আরও পাওয়া যায় যে তিনি ইতোমধ্যে একাধিক স্বামীর বিরুদ্ধে বিয়ের প্রলোভনে ধর্ষণের মামলা করেছেন। তিনি মামলার ২ মাস পরে আলামত জমা দেন। এই মামলায় তার পক্ষে প্রতিবেদন প্রদানের জন্য  পুলিশের একাধিক ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাদের কে দিয়ে প্রভাব খাটানোর চেষ্টা করেন। মামলার তদন্তকারী কর্মকর্তাকে পরিবর্তন করান। এর মধ্যে আমার বদলী হয়, তদন্ত কি পর্যায়ে আছে আমি ঠিক জানিনা।’

এই প্রতিবেদকের সাথে এই নারীর আরেকজন স্বামী যিনি বর্তমানে দেশের বাইরে আছেন যোগাযোগ করেন। তিনি জানান- তাকেও একই ভাবে বন্ধুত্ব থেকে প্রেম, পরে পরিনয়ের মাধ্যমে ফাঁসিয়েছেন এই নারী। তাকেও গুলশান থানায় ধর্ষণের মামলা দেন এবং বিয়ে করেন। পরে  তার থেকে ৩০ লক্ষ টাকা নিয়ে পরে মামলা তুলে নেন।  উক্ত নারীর মুঠোফোন ও ল্যাপটপে এমন আরও অনেক ভুক্তভোগীর প্রমাণ থাকতে পারে বলে জানান এই স্বামী।

বর্তমানে ভুক্তভোগী বিচারক আইন মন্ত্রণালয়ে সংযুক্ত আছেন। তার আইনজীবী জানিয়েছেন, এ ঘটনায় তিনি শিগগিরই উচ্চ আদালতে আইনগত প্রতিকার চাইবেন।