জি. এম. আদল :
বাল্য বিবাহ নারীর শৈশব-কৈশোর আর স্বপ্নময়তার দিনগুলোকে কেড়ে নেয়, অমানবিক মাপজোক করে ঠিক করে দেয় তার চোখের দৃষ্টিসীমানা, গভীর কালো এক পর্দা টেনে দেয় মনের আকাশটাতে, আর সব মিলিয়ে যখন সামগ্রিক রাষ্ট্র আর সামাজিকতার প্রেক্ষাপটে বিবেচনা করা হয়, তখন বিষয়টি দাঁড়ায় এক জাতীয় সমস্যা হয়ে।
বাল্যবিবাহ নিয়ে প্রতিদিন বহু সংবাদ পড়ি, যারা বাল্য বিবাহ রোধ নিয়ে কাজ করে তাদের কাছে নানা অভিজ্ঞতার গল্প শুনি ।তেমনি একজন সংগঠক জহিরুল ইসলাম রাসেল ভাইয়ের কাছ থেকে একটি মেয়ের বাল্য বিবাহ প্রতিরোধ করতে গিয়ে একজন স্কুল শিক্ষিকার এক অন্যরকম অভিজ্ঞতার কথা শুনেছিলাম – “একবার এক ছাত্রীর বিবাহ আটকাতে গিয়েছিলাম। প্রথমে আমাকে মেয়ের মা বলল আপনাদের তো বিয়ে হচ্ছে না আবার আমার মেয়ের বিয়েতে বাধাঁ দিতে এসেছেন। ওদিকে আমার পুরুষ কলিগ কে মেয়ের বাবা বলছে আমার মেয়ের যদি বিয়ে না হয় তাহলে কিন্তু স্যার আপনাকে বিয়ে করতে হবে।”
কি ভয়ংকর, অমানবিক ব্যাপার! স্রষ্টা রক্ষা কর। ঘটনা শুনে হাসবো না কাদঁবো? বুঝে উঠতে পারছিলাম না। যাহোক এতো সমস্যা মোকাবেলা করেও যারা বাল্য বিবাহ প্রতিরোধে কাজ করে যাচ্ছন তাদের প্রতি অন্তরের অন্তঃস্থলের নিরন্তর ভালবাসা, শ্রদ্ধা ও শুভ কামনা।
বাল্যবিয়ে বন্ধ করা উচিৎ কারণ –
বাল্যবিয়ের ফলে মেয়েদের শারীরিক কি ধরনের সমস্যা দেখা দিতে পারে সে সম্পর্কে মানুষকে জানাতে হবে। বাল্যবিবাহ দেয়া মানে মেয়েটিকে অনেকটা স্বেচ্ছায় মৃত্যুরকোলে ঠেলে দেয়া। বাল্য বিবাহের ফলে অল্প বয়সে সন্তান প্রসবের সময় প্রচুর মৃত্যুর ঝুঁকি থেকে যায়। অপরিনত বয়সে গর্ভ ধারন করলে মা ও শিশুর উভয়ের মৃত্যু ঝুঁকি থাকে। নবাগত শিশুটি ওজন কম এবং অপুসটি জনিত সমস্যা সহ নানা শারিরীক সমস্যা হতে পারে।
অসুরক্ষিত যৌন সম্পর্কের কারনে বিভিন্ন রোগে আক্রান্ত হতে পারে সে।
বাল্যবিয়ে যে কত বড় অপরাধ এবং এর যে কঠিন শাস্তি রয়েছে এ সম্পর্কে মানুষকে জানাতে হবে। ‘বাল্যবিবাহ নিরোধ আইন ২০১৭’- তে বলা হয়েছে, মেয়েদের বিয়ের ন্যূনতম বয়স ১৮ বছর এবং ছেলেদের ২১ বছর। তবে, বিশেষ ক্ষেত্রে যেকোনো অপ্রাপ্তবয়স্ক মেয়ের সর্বোত্তম স্বার্থে আদালতের নির্দেশে এবং মা-বাবার সম্মতিতে বিয়ে হতে পারবে। আদালত নিজ উদ্যোগে বা কারও অভিযোগের ভিত্তিতে বাল্যবিবাহ থামিয়ে দিতে পারবেন। বাল্যবিবাহের ওপর নিষেধাজ্ঞা আরোপ করে পর্যালোচনাও করতে পারবেন।
আইন লঙ্ঘনে কার কি সাজা
- মা-বাবা আইন লঙ্ঘন করলে সর্বোচ্চ দুই বছর কারাদণ্ড বা ৫০ হাজার টাকা জরিমানা বা উভয় দন্ডের বিধান রয়েছে আইনে।
- দু’জন অপ্রাপ্তবয়স্ক ছেলে বা মেয়ে বাল্যবিবাহ করলে তাদের ১৫ দিনের আটকাদেশ ও অনধিক পাঁচ হাজার টাকা জরিমানা করা যাবে।
- কোনো প্রাপ্তবয়স্ক ব্যক্তি অপ্রাপ্তবয়স্ক কাউকে বিয়ে করলে দুই বছর কারাদন্ড বা এক লাখ টাকা জরিমানা বা উভয় দণ্ড হতে পারে।
- বিয়ে পড়ানোর সঙ্গে জড়িত ব্যক্তিরা আইন না মানলে দুই বছর কারাদণ্ড বা ৫০ হাজার টাকা জরিমানা বা উভয় দণ্ড দেয়া যাবে।
- যেহেতু বিভিন্ন শিক্ষাগত যোগ্যতার সনদ, জন্মনিবন্ধন সনদ বা পাসপোর্ট যেকোনো একটি বিয়ের বয়স নির্ধারণের ক্ষেত্রে বিবেচ্য সেহেতু এসব সনদ জাল-জালিয়াতি করে বিয়ের ব্যবস্থা করলে এ সংক্রান্ত মামলার বিচার অন্যান্য ফৌজদারি অপরাধের মতোই হবে।
- এছাড়া ভ্রাম্যমাণ আদালতেও বিচার করা যাবে।
বাল্যবিয়ে বন্ধের ক্ষেত্রে স্থানীয় জন প্রতিনিধি যেমন চেয়ারম্যান, মেম্বার, কাউন্সিলররা বিশেষ ভূমিকা রাখতে পারেন। এক্ষেত্রে আইন শৃংখলা বাহিনীর কঠোর অবস্থান নিতে হবে। কোন ব্যক্তিকে এ ক্ষেত্রে ছাড় দেয়া যাবে না। সর্বোপরি সাধারণ নাগরিকসহ সকল শ্রেণীর মানুষের সম্পৃক্ততাই পারে বাল্যবিয়ে নামের এ অভিশাপ থেকে দেশ ও জাতিকে মুক্ত করতে।
ডিজিটাল সেবার বদৌলতে ঘরে বসেও এ অন্যয়ের প্রতিরোধ করতে পারেন আপনি। কিছুদিন আগ দেশে ৯৯৯ জরুরি সেবার একটি হটলাইন সারভিস চালু হয়েছ।বাল্যবিবাহ নামের এই অন্যায় কোথাও হতে দেখলে এই নাম্বারে জানাতে পারেন আপনি, প্রশাসন যতযথ ব্যবস্থা নিবে। আপনি যদি একজন সচেতন নাগরিক হোন তহলে আপনাকে বলছি, যদি দেখেন আশেপাশে বাল্যবিয়ে, ১০৯ নম্বর এ কল দিবেন যে কোনো মোবাইল নম্বর থেকে সম্পূর্ণ টোল ফ্রি (বিনামূল্যে)।
লেখক: শিক্ষানবিশ আইনজীবী, ঢাকা জাজ কোর্ট।